ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিগুলোতে চান্স পাওয়ার পর সচরাচর যে সমস্যাটি স্টুডেন্টরা ফেস করে তা হল সাবজেক্ট চয়েস দেওয়া। এসময় আমরা পরিবারের গুরুজনদের থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন পাশের বাসার আংকেল আন্টি, বিভিন্ন পরিচিত মামা, চাচা, বড় ভাই কারো উপদেশ নিতে বাদ রাখি না। কেউ হয়ত বলবে “অমুক সাবজেক্টে কোনো জব নাই এদেশে। আমার অমুক বন্ধুর ছেলে তমুক সাবজেক্টে পড়ে কিছু করতে পারে নাই। বেকার পড়ে আছে”। এরকম নানা অভিযোগ।

তোমাদের একটা কথা আগেই পরিস্কার করে জানিয়ে দেই। সব সাবজেক্টেরই জব ভ্যালু আছে। কারণ জব না থাকলে সাবজেক্টটা পড়ানো হত না। আর কে জব পেল না বেকার বসে থাকল তা নির্ভর করে রেজাল্ট আর স্কিলের উপর। এখানে সাবজেক্টকে দোষারোপ করা মূর্খতার পরিচয়।

একজন এডমিশন ক্যান্ডিডেট ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে ভর্তির প্রিপারেশন নেওয়ার সময়েও জানে না কয় ধরণের ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট আমাদের দেশে পড়ানো হয়। তাই যখন নিজের পছন্দের সাবজেক্ট চয়েসের বিষয়টা আসে কিংবা যখন কারো নিজের একান্ত প্রিয় সাবজেক্ট পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, তখন সে দ্বিধায় ভোগে যে আসলে কিভাবে সাবজেক্ট চয়েস দিবে। কারণ অনেক সাবজেক্ট সম্পর্কেই তার প্রাথমিক কোনো ধারণা থাকে না।

তোমাদের জন্য তাই এবার উদ্যোগ নিয়েছি কুয়েটে যে সাবজেক্টগুলো পড়ানো হয় সেগুলোর একটা ধারণা দেওয়ার আর চার বছরের কোর্স প্লানের একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়ার যাতে তোমরা তোমাদের পছন্দের বিষয় বেছে নিতে অন্যের উপদেশ থেকে নিজের ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দিতে পারো।

Department of Electronics & Communication Engineering (ECE)

অনেক কথা বললাম। এবার আমি সরাসরি চলে যাব আমার নিজের ডিপার্টমেন্ট নিয়ে কিছু বলতে। কুয়েটের একেবারে শুরুর দিককার ডিপার্টমেন্টগুলোর মধ্যে ECE অন্যতম। এটা EEE (Electrical and Electronic Engineering) ফ্যাকাল্টির আন্ডারে যে পাঁচটা ডিপার্টমেন্ট আছে তাদের একটা। প্রতি বছর ৬০ জন স্টুডেন্ট এই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়। ২০০১ সাল থেকে এর আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি চালু হয় এবং পোস্টগ্রাজুয়েট ডিগ্রি চালু হয় ২০১১ সাল থেকে।

ECE একটা ভারসেটাইল ডিপার্টমেন্ট। ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো কোর্স এখানে করানো হয় যার মধ্যে ECE ছাড়াও একটা বড় অংশ জুড়ে আছে EEE আর CSE (Computer Science Engineering)। চার বছরে কি কি কোর্স করানো হয় তার একটা তালিকা এই পোস্টের সাথে সংযুক্ত PDF ফাইলটিতে দেওয়া আছে। আর আমি নিচে এই ডিপার্টমেন্টে কি পড়ানো হয় সে সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু আলোচনা করব।

ECE এর ফুল ফর্ম দেখলেই বোঝা যায় যে এর মেজর হলো ইলেক্ট্রনিক্স আর কমিউনিকেশন। এখানে তোমরা মূলত শিখবা মাইক্রো ইলেক্ট্রনিক্স আর কমিউনিকেশন বেজড ইলেক্ট্রনিক্স সম্পর্কে। ফার্স্ট ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টারে মোট পাঁচটি কোর্স আছে। এগুলো হলঃ EEE, ECE ফিজিক্স, ম্যাথ আর হিউম্যানিটিস। এছাড়া EEE, ECE আর ফিজিক্সএর তিনটা ল্যাবরেটরি কোর্স রয়েছে ।

EEE (Basic Electrical Engineering): ফার্স্ট সেমিস্টারে EEE কোর্সে EEE এর ব্যাসিক শেখানো হয়। কোর্সটা দুই পার্টে ভাগ করা। এক পার্টে শেখানো হয় AC Current এবং অন্য পার্টে DC Current। AC পার্টে অল্টারনেটিং কারেন্ট মেকানিজম, অল্টারনেরটিং কারেন্টের বিভিন্ন সার্কিট ইলেমেন্ট কিভাবে কাজ করে তা শেখানো হয়। ডিসি পার্টে শেখানো হয় সার্কিট সল্ভের অনেকগুলো নেটওয়ার্ক এনালাইসিস আর থিওরেম। যেখানে ওহম’স ল থেকে শুরু করে আছে বিভিন্ন কমপ্লিকেটেড থিওরেম যেমন-ব্রাঞ্চ কারেন্ট মেথড,লুপ কারেন্ট মেথড, নোডাল এনালাইসিস, মেশ এনালাইসিস, সুপারপজিশন থিওরেম, মাক্সিমাম পাওয়ার ট্রান্সফার থিওরেম ইত্যাদি।

EEE এর ল্যাব ওয়ার্কে মূলত থিওরিতে যেসব পড়ানো হয় তা প্রাক্টিকালি এপ্লাই করা হয়। ইন্টারমিডিয়েটে তোমরা বিভিন্ন সার্কিট ম্যাথমেটিকালি সল্ভ করেছো। এখানে তা প্রাক্টিকালি করবা। বিভিন্ন থিওরেম কিভাবে কাজ করে তা দেখানো হয়। এগুলোর উপর রিপোর্ট লিখতে হয়।

ECE(Solid State Electronics): তোমাদের ইন্টারমিডিয়েটে ফিজিক্সে ইলেক্ট্রনিক্স নামে একটা চ্যাপ্টার ছিল। এই কোর্সটা ঐ চ্যাপ্টার থেকেই শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে আরো বিস্তারিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেমিকন্ডাক্টর কিভাবে কাজ করে, পিএন জাংশনের বিস্তারিত আলোচনা, সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে কারেন্ট কিভাবে ফ্লো হয়, ডিজিটাল ইলেক্ট্রনিক্স, মাইক্রোপ্রসেসরে এর ব্যবহার, ট্রাঞ্জিস্টরের ব্যাসিক, কিভাবে ট্রাঞ্জিস্টর কাজ করে ইত্যাদি এই কোর্সে শেখানো হয়।

ECE এর ল্যাব অনেক ইন্টারেস্টিং। অনেক কিছু এখানে শেখানো হয় এখানে। সার্কিট সেটআপ করা, কারেন্ট এসি থেকে ডিসি তে কনভার্ট করা, ট্রাঞ্জিস্টরের ক্যারেক্টারিস্টিক্স চেক করা, এসি কারেন্ট ওয়েভ ওসিলোস্কপ দিয়ে এনালাইসিস করা, ডাটা ক্যাল্কুলেশন করা, অনেক নতুন যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে এখানে জানা যায় । বিভিন্ন রকমের এক্সপেরিমেন্ট করা হয় যার উপর রিপোর্ট লিখতে হয়।
Physics: এই কোর্সে মডার্ন ফিজিক্স শেখানো হয়। তোমরা ইন্টারে ফিজিক্স সেকেন্ড পেপারে ৮ম আর ৯ম অধ্যায়ে মডার্ন ফিজিক্স আর নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়েছো। এখানে এগুলো অনেক অনেক বিস্তারিত আকারে পড়ানো হয়। বিভিন্ন টপিকের মধ্যে আছে থিওরি অফ রিলেটিভিটি, স্রোডিঞ্জারস ইকুয়েশন, কোয়ান্টাম থিওরি, তেজস্ক্রিয়তা, আলোক বিজ্ঞান, পর্যাবৃত্ত গতি ইত্যাদি।
Physics ল্যাবে বেশ কিছু যন্ত্রের কাজ ও ব্যবহার শেখানো হয় যেমন- পোস্ট অফিস বক্স, ক্যারি ফসটার ব্রিজ, টিউনিং ফরক, অপটিকাল ইকুইপমেন্টস ইত্যাদি।

Mathematics: ক্যালকুলাস। ইন্টেগ্রাল আর ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস । অনেকগুলো নতুন টপিক পড়ানো হয় ক্যালকুলাসের। অন্তরীকরণ আর যোগজের বিভিন্ন ফর্মুলা, থিওরেম আর এগুলোর প্রচুর ম্যাথ রয়েছে।

Humanities: ফার্স্ট সেমিস্টারে হিউম্যানিটিসে ইকোনমিক্স থাকে। মাইক্রোইকোনমিক্স আর ম্যাক্রোইকোনোমিক্সের বিভিন্ন টপিক যেমন- চাহিদা,যোগান, উৎপাদন, এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক, GDP, প্রোডাকশন পসিবিলিটি ফ্রন্টায়ার, মার্কেটিং ইত্যাদি পড়ানো হয়।

উপরে যেসব কোর্স আলোচনা করলাম তার সবই কেবল ফার্স্ট ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টারের। এছাড়াও চার বছরের বাকি সেমিস্টারগুলোতে অনেক নতুন কোর্স আছে। এগুলো হলঃ Chemistry, Analog Electronics, Computer Fundamentals & Programming, Object Oriented Programming, Digital Electronics, Signals and Systems, Internet Programming, Microprocessor and Microcomputers, Nanotechnology, Optical Fiber Communication, Wireless Communication, Telecommunication Engineering এবং আরো অনেক বিষয়।

অন্যান্য ভার্সিটির তুলোনায় কুয়েটের ECE ডিপার্টমেন্টের ল্যাব ফ্যাসিলিটিস সবচেয়ে বেশি । এখানে এমন কিছু ইকুইপমেন্ট আছে যা সারা বাংলাদেশে আর কোনো ভার্সিটিতে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন ল্যাবগুলোর মধ্যে রয়েছে i) Microwave and Antenna laboratory ii) Communication System Laboratory iii) Electronics Circuit Device & Design Laboratory iv) Digital System Design & Signal Processing Laboratory v) Microprocessor & Control Laboratory vi) Computer centre.

ল্যাবগুলো উচ্চমানের এবং যাবতীয় সকল যন্ত্র আর সুযোগ-সুবিধা এ ল্যাবগুলোতে পাওয়া যাবে

আগেই বলেছি ECE একটা ভারসেটাইল সাবজেক্ট। কেন বলেছি তা উপরের কোর্স আর PDF দেখলেই পরিস্কার হয়ে যাবে। তবুও অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে যে ECE পড়লে কেবল মোবাইল কোম্পানি ছাড়া আর কোথাও কোনো জব নাই। যারা এটা বলে তাদের আসলে এই সাবজেক্ট নিয়ে কোনো ধারণাই নেই। ECE পড়ে একজন যেমন EEE এর বিভিন্ন সেক্টরে জব করতে পারে, ঠিক তেমনি একটা বড় অংশ যায় সফটওয়্যার খাতে। সারা পৃথিবীতে মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্সের চাহিদা তুঙ্গে আর আর ECE সাবজেক্টটাই মাইক্রইলেক্ট্রোনিক্সের উপর ভিত্তি করে তৈরি। রিসার্চের জন্যও এই সাবজেক্টে রয়েছে প্রচুর অপশন ।

এমন হতে পারে EEE বা CSE পড়ার স্বপ্ন ছিল কিন্তু মেরিট পজিশনের কারণে অনেকে EEE কিংবা CSE পায় না। তাদের জন্য একটা আদর্শ সাবজেক্ট হতে পারে ECE । তাছাড়া প্রত্যেক ব্যাচে ৬০ জন বলেই কিনা, কুয়েটে ECE ডিপার্টমেন্টের বন্ডিং অনেক বেশি। এখানে সবাই সবাইকে খুব ভাল ভাবে চেনে। আর পড়াশোনা ছাড়াও অনেক মজার এক্টিভিটিজ আমরা করে থাকি। ডিপার্টমেন্টের টিচারদের আন্ডারে রয়েছে MEC (Manipulation of Electrons Club) যেখানে ইলেক্ত্রনিক্সের বিভিন্ন প্রজেক্টে অংশ নিতে স্টুডেন্টদের উৎসাহী করা হয়। কাজেই সাবজেক্ট হিসেবে ECE অনেক ভাল একটা চয়েস।

ওয়াসি
ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
ব্যাচ – ২০১৬, কুয়েট