এতদিন সবার সফলতার গল্প পড়তাম অনুপ্রেরণার জন্য। আজ নিজেই লিখব নিজের সফলতার গল্প। এক বছর আগে এই দিনে আমি মানুষের সফলতার গল্প পড়তাম আর নিজেকে অনুপ্রাণিত করতাম।
মনে মনে ইচ্ছা জাগত নিজের একটি গল্প লেখার কিন্তু সফলতা ছাড়া তো আর গল্প লেখা যায় না। আজ বোধহয় সেই সময় এসেছে নিজের বলার মত একটি গল্প হয়েছে।
সময়টা ২০১৬। এসএসসি এক্সামে রাঙামাটি থেকে আমার উপজেলার মধ্যে কমার্স থেকে সর্বোচ্চ জিপিএ নিয়ে বোর্ড বৃত্তি পাই।
ইচ্ছা ছিল শহরের একটি নামকরা কলেজে পড়ার। সেই ইচ্ছাটা পূরণ করতে ভর্তি হলাম চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সরকারি হাজী মুহাম্মদ মুহসিন কলেজে। নতুন পরিবেশ, নতুন শহর, নতুন বন্ধু-বান্ধব সবকিছুই আমার জন্য ছিলো নতুন ।
পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়া আমার জন্য তেমন একটা সহজ ছিল না। সবকিছু কেমন জানি রঙ্গিন রঙ্গিন লাগতো। এইচএসসি এক্সামটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
ফার্স্ট ইয়ার আড্ডা ঘোরাঘুরি এসবে চলে গেল। তার মাঝে ছিল স্যারদের পিছনে দৌড়াদৌড়ি। যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেস্ট এক্সাম চলে আসলো।
তারপর বুঝতে পারলাম আমাকে পড়তে হবে অন্যথায় আমার পরীক্ষায় পাশ করাটাও মহা মুশকিল হয়ে যাবে। তখন থেকেই ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে ভার্সিটির বড় ভাইদের পোস্ট দেখে ভার্সিটিতে পড়ার ইচ্ছা জাগলো ।
মেইনলি, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার। কিন্তু তার জন্য দরকার ভালো জিপিএ । তাই এইচ এস সি তে ভালো করার জন্য টেস্টের পর থেকে পরবর্তী তিন মাস ভালো করে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
ওই তিন মাসে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত পড়েছিলাম।
এরপর এইচ.এস.সি এক্সাম চলে আসলো। এক্সাম দিয়ে মনে হয়েছিলো আমার আর ঢাবিতে পড়া হবে না।
আর যারা ২০১৮ সালে এইচএসসি দিয়েছিলেন তারা ভালো করেই জানেন প্রশ্ন কেমন হয়েছিল। এক্সাম শেষ হওয়ার পর কোচিং নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছিলাম। একজন বলে এইটা ভালো তো আরেকজন বলে ওইটা ভালো।
শেষমেষ ভালো একটা কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। সার্ভিস মোটামুটি ভালোই দিয়েছিল। ভালো কিছু বন্ধু পেয়েছিলাম যাদের পড়ালেখা দেখে আমি পড়ার প্রতি আগ্রহ খুঁজে পেতাম।
যাইহোক, খুব ভালোভাবে প্রিপারেশন নিতে থাকলাম। সবকিছু ঠিক ভাবে চললেও বিপত্তিটা ঘটে এইচএসসি রেজাল্টের পর। জিপিএ আসলো ৩.৮৩। রেজাল্ট দেখে তো মাথায় সাত আসমান ভেঙ্গে পড়লো।
ভাবলাম, এই রেজাল্ট নিয়ে ঢাবির চিন্তা করলেও তো পাপ হবে। জিপিও মার্ক ১৩ কম।অনেকেই বলা শুরু করলো ঢাবির চিন্তা বাদ দিয়ে চবির জন্যে পড়ো।
কিন্তু এতদিনে তো ঢাবি মনে প্রাণে মিশে গেছে। ঢাবি ছাড়া কিছু ভাবতেই পারছিলাম না।
রেজাল্ট এর পর দিন কোচিংয়ে গেলাম চারিদিকে গোল্ডেন আর a+ এর ছড়াছড়ি । স্যার সরাসরি বলছিল যারা ৪.৫০ এর উপরে পেয়েছ, তারা ক্লাসে থাকো বাকিরা বাহিরে যাও।
ঐদিন বুঝছিলাম অপমান কাকে বলে। যেসব বন্ধুরা আমার নোট করা খাতা নিয়ে পরিক্ষার আগের রাতে পড়তো, তারাও এখন আমাকে সাজেশন দিতে আসলো।
পড়াশোনার গতি আরো বাড়িয়ে দিলাম। ঢাবির গ ইউনিটে প্রথম এক্সাম দিলাম। ফলাফল ইংলিশে আসলো ফেইল। অথচ আমার কোচিংয়ের ফ্রেন্ডরা সবাই ঢাবিতে চান্স পায়।
এবং খুব ভালো ভালো পজিশনে। তাদের সফলতা দেখে ভাল লাগলেও মনে মনে প্রচুর হতাশ ছিলাম।একে একে সবাই পোস্ট দিতে লাগল ..এইগুলা দেখে আরো হতাশায় ভুগতাম।
ফেইসবুক আইডি দিলাম অফ করে।পরের দিন ঢাকায় চলে গেলাম। ঢাবির ডি ইউনিটের এর জন্য উঠেপড়ে লাগলাম।যেভাবেই হোক চান্স পেতে হবে। আব্দুল্লাহপুর থেকে গিয়ে ফার্মগেট কোচিং করতাম। হাতে ছিল মাত্র ২০ দিন।
নতুন করে জিকে পড়তে লাগলাম। হতাশা আর নতুন পরিবেশ তারপর আবার ঢাকার জ্যাম। গাড়িতেই ৩-৪ ঘন্টা চলে যেত।
এভাবেই পরিক্ষা চলে আসলো। ঢাবির ডি ইউনিটে এক্সাম দিলাম। কিন্তু ভাগ্যের কাছে হেরে যেতে হলো। এইবার পাস করলেও জিপিএ মার্ক ১৩ কম থাকায় পজিশন আসলো ১৩১২।
হতাশা আরো বাড়তে লাগলো।
আমার কাছের এক ফ্রেন্ড তো ঢাবিতে চান্স পেয়ে আমাকে বলছিলো ৩.৮৩ নিয়ে ঢাবির কথা চিন্তা করলি ক্যামনে। তোর মাথায় কিছুই নাই। তুই পাবলিক ভার্সিটির আশা ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেটে ভর্তি হয়ে যা।
আরও অনেক কিছুই বলছিলো। একেকটা কথা জাস্ট বুকের মধ্যে ধুক ধুক করে লাগছিলো । আমি শুধু একটা কথাই বলেছিলাম Time will say everything ।
চবি ছাড়া আর কোথাও অ্যাপ্লাই করি নাই। তাই শেষ সুযোগ ছিল চবি। ৩ টা ইউনিটে এক্সাম দিলাম। পজিশন আসলো দূরে দূরে।
কিন্তু চবি নিয়ে আমার কোন হতাশা ছিল না। এত দুঃসংবাদের মাঝেও একটি সুখবর পেলাম। Du – D unit ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করেছে।যারা পাশ করেছিল তাদের আবার এক্সাম নিবে।
আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। আবার প্রস্তুতির জন্য ১৮ দিন সময় পেলাম। ফ্যামিলি প্রবলেম এর কারণে আপুর বাসায় থেকে প্রস্তুতি নিতে হলো।
কোন দিকে সকাল আর কোন দিকে রাত হতো কিছুই বুঝতে পারতাম না।
সন্ধ্যায় পড়তে বসলে পড়তে পড়তে অনেক সময় সকাল হয়ে যেত। ৫ দিনে জোবায়ের জিকে শেষ করেছিলাম।
এইটাই আমার লাস্ট চান্স ছিল তাই প্রস্তুতির কোন কমতি রাখি নাই। অবশেষে পরীক্ষার দিন এলো ।পরীক্ষা আগেরবারের মতই হলো। মোটামুটি একটা আশা রেখেছিলাম।
কিন্তু এবার অবস্থা আরো ভয়ানক। পজিশন আসলো ৭৩১….। ২ টা মার্ক্সের জন্য আমার চান্স হয় নাই।
অথচ আমার সমান মার্ক্স এক্সামে পেয়ে ১৫০ এর ভিতর ভালো সাবজেক্টে চান্স পেয়েছে। আমি হেরে গেলাম জিপিএ এর কাছে।
এরপর থেকে চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখতে লাগলাম। একেকটা দিন মনে হতে লাগলো একেকটা মাস।
বন্ধুরা যেখানে ঢাবি, জাবি, চবিতে চান্স পেয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে ফেবু কাপাচ্ছে সেইখানে আমার তাদের ছবি দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
রাত গিয়ে ভোর হতো কিন্তু আমার ঘুম আসত না। মেসেঞ্জারে কথা বলার মত কাউকে পেতাম না। ফ্রেন্ড যারা ছিল তারা সবাই সবার মত ব্যস্ত হতে শুরু করলো। বাসা থেকে বের হতেও পারতাম না।
যদি কেউ আবার জিজ্ঞেস করে বসে কোথায় চান্স হয়েছে এই ভয়ে। ডিপ্রেশনের একদম চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম।
অনেকেই বলতো আমার জন্য নাকি আরো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। কিন্তু বিশ্বাস হতো না। যেখানে ঢাবিতে চান্স পাইনি তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!
ন্যাশনাল ভার্সিটিতে পড়ার কোনোদিন ইচ্ছা ছিল না।
ফ্যামিলির চাপে ন্যাশনাল ভার্সিটিতে এপ্লাই করি এবং ভাগ্যক্রমে মহসিন কলেজে একাউন্টিংয়ে চান্স পেয়ে যাই। কিন্তু তাতে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না।
আমার প্রিয় এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ওই একটা সিদ্ধান্তই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। কলেজে যেতাম, ক্লাস করতাম আর বাসায় এসে সেকেন্ড টাইম পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতাম।
বাসায় সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কেউ রাজি ছিল না। তাই গোপনেই প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। কিন্তু বিপদ যেনো পিছু ছাড়ে না।
বাবা দুইবার ব্রেন স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাছাড়া কাছের বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে অবহেলা, তিক্ত কথাবার্তা যেনো আমাকে প্রস্তুতি থেকে থামিয়ে দেওয়ার সুযোগ খুজতেছিলো।
যাই হোক, পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু করি রোজার মাস থেকে আবার আগের মত ১৫-১৬ ঘন্টা পড়াশোনা শুরু করি। চার মাস এভাবে চলতে থাকলো ।
তারপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। জাহাঙ্গীরনগর ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলো। ফাস্ট পরীক্ষা ছিল E ইউনিট ।
প্রচুর নার্ভাসনেস কাজ করছিল। কিন্তু মনে একটা বিশ্বাস ছিল যে, পরিশ্রম করেছি আল্লাহ আমাকে ফিরাবেন না। পরীক্ষা ভালই দিলাম।
কিন্তু এক্সাম হল থেকে বের হয়ে চারপাশে যা শুনছিলাম,তা শুনে চোখ দিয়ে পানির বদলে রক্ত বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিলো।
কোশ্চেন ইজি হয়েছে, সবার এক্সাম ভালো হয়েছে, একজনকে তো বলতে শুনেছিলাম ৭৫ টা শিউর। টপ ১০ এর বাহিরে তার নাম যাবেই না।
এর পরের দিন ছিল বি ইউনিটের এক্সাম । সকালে E ইউনিটের রেজাল্ট দিলেও ভয়ে চেক করিনি।
বি ইউনিট এ এক্সাম দিয়ে এসে রেজাল্ট চেক করলাম রেজাল্ট দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এটা আমার রেজাল্ট। পজিশন আসলো ১২৫ তম।
চোখ দিয়ে অটোমেটিক পানি বের হয়ে গেল। সাথে সাথে বাসায় কল দিয়ে মাকে জানালাম। তিনি আমার জন্য সবচেয়ে বেশি দোয়া করেছিলেন।
পাশাপাশি আমি ন্যাশনাল ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সাম দিয়েছিলাম। কয়েক দিন আগে রেজাল্ট দিয়েছে সিজিপিএ ৩.১৭ নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস গ্রেডে উত্তীর্ণ হই।
চান্স পাওয়ার পরের তিন মাসের কথা যদি বলি তাহলে বলবো, যেইসব ফ্রেন্ডরা কোনদিন আমাকে একটা মেসেজ বা কলও দেয়নি তারা সেদিন কল করে অভিনন্দন জানিয়েছিলো।
এক বছর আগে যেখানে আমার ইনবক্স খালি থাকতো সেই ইনবক্স এখন ম্যাসেজে ভরপুর থাকে কিন্তু আমি রিপ্লে দেওয়ার সময় পাইনা।
যাদের একসময় ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিলে এক্সপেক্ট করত না আজ তারাই আমার ফলোয়ার হয়ে ঝুলে থাকে।
এই এক বছর সময়টা আসলে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। স্বার্থের জন্য যারা মানুষকে মনে রাখে,তারা আসলে বন্ধু হয় না।
মনে রাখবেন,আপনার দুঃসময়ে যে আপনার পাশে থাকবে সে-ই আপনার আসল বন্ধু।
এই এক বছরে পরিচিত হয়েছি অনেক নতুন নতুন মানুষের সাথে। এবং অনেক কাছের বন্ধুকেও ভুলে যেতে হয়েছে শুধুমাত্র তার যোগ্য হতে পারি নাই বলে। আজ বুঝতে পারছি আল্লাহ আসলেই আমার জন্য ভালো কিছু রেখেছিল।
জীবনের উপর মাঝে মাঝে কালো মেঘ জমে।সেই কালো মেঘের আড়ালেও কিন্তু সূর্য থাকে। মাঝে মাঝে পিছিয়ে যাওয়ার মানে এই না যে, আপনি হেরে যাচ্ছেন।
এর অর্থ আপনি আরো জোড়ে লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই পৃথিবীতে যদি আপনার সবচেয়ে আপনজন কেউ থাকে, সেটা আপনি নিজেই। কারণ অন্ধকারে আপনার ছায়াও আপনাকে ছেড়ে চলে যায়।
মনে রাখবেন,
Short time pleasures
Creat long time pains.
Short time pains
Creat long time pleasures.
লাইফে একবার না একবার তো আপনাকে কষ্ট করতেই হবে সেটাকে আপনি কোনোভাবেই স্কিপ করতে পারবেন না।
যারা এই দীর্ঘ পোস্টটি পড়েছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। কোন ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
Al Hasanat Depon
Jahangirnagar University