আমি গালিব হাসনাইন ধ্রুব। আলহামদুলিল্লাহ এই বছর বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় ৬৬০তম স্থান অর্জন করে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আমার স্কুল ছিল গভঃ ল্যাবরেটরী হাই স্কুল, রাজশাহী। কলেজ ছিল রাজশাহী কলেজ।

আম্মুর ইচ্ছা ছেলে চিকিৎসক হবে। কারণ ফ্যামিলিতে কোনো ডাক্তার নাই, পাশাপাশি অনেক টাকা পয়সা সাথে সেটা হালাল😆 তার মতে বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ার হলে সৎ পথ থেকে তাড়াতাড়ি বিচ্যুত হয়ে যায়। আর বাবা নিশ্চুপ, অনেকটা মৌনতা অবলম্বন করে কারণ আমার প্রবল ইচ্ছা প্রকৌশলী হবো আর বুয়েট থেকেই পড়াশোনা করব।

তাই মৌনতা অবলম্বন করে ছেলের ইচ্ছার সাথে সম্মতি প্রকাশ করার একটা শৈল্পিক প্রয়াস। এভাবেই যায় ক্লাস ৮। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হলে আম্মু বলতো চিকিৎসকের গুরুত্ব বুঝেছো তো? 🙂

ক্লাস ৯, ২০১৭ সাল। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুদের মাঝে যারা তখন থেকেই বুয়েট প্রত্যাশী, তাদের সাথে বিগত কোনো এক বছরের বুয়েটে আসা ফিজিক্স কিংবা ম্যাথের অতি সাধারণ কোনো প্রব্লেম সলভ করে নিজের মাঝে হুটহাট বুয়েটে পড়ার রোমাঞ্চকর অনুভূতি সৃষ্টি করা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বুয়েটের সাথে পরিচয় বহুদিন আগেই, তবে কিভাবে হয়েছিল তা মনে পড়ছেনা।

জীববিজ্ঞানের সব কিছু মুখস্থ করতে হয় এই রকম একটা ধারণা তখন কীভাবে যেন নিজের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। ক্লাস ৯ এ সর্বপ্রথম জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে রিজিওনাল থেকে ন্যাশনাল যাওয়ার সু্যোগ হয়, আর কোনো প্রিপারেশান ছাড়া যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যে পরিণতি কী হয় সেটা সেখানে ভালোভাবেই উপলব্ধি করি।

ক্লাস ১০ এও যাই ন্যাশনালে এবং ন্যাশনাল থেকে বাদ পড়ে যাই। আর মনে হতে থেকে পড়লেই পারব, সেখানে থেকেই বায়োলজির সাথে বনিবনা কম হতে থাকে, সাথে বাড়তে থাকে ফিজিক্সের প্রতি ভালোবাসা। ২০১৭ সাল আর ২০২০ সাল দুইবারই ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে রিজিওনাল সফলতার পর অসুস্থতার কারণে ন্যাশনালে অংশ নিতে পারি নি। তবে এই সামান্য সফলতা বীজ বুনেছিল নতুন দিনের।

এভাবে এস.এস.সি পরীক্ষায় ২০১৯ সালে ১২৩৩ মার্ক্স পেয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলেও নিজের পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়নের নাম্বার নিজের কাছে সন্তোষজনক ছিল না, ভাবতে থাকি পড়ার ইচ্ছা বুয়েটে কিন্তু যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে তো কখনোই আলোর মুখ দেখা সম্ভব নয়।

ভালো ছাত্রের ট্যাগলাইন আগে থেকেই ছিল, তবে সেটা ধরে রাখাই হলো সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। তো যেটা হয়, ফাস্ট ইয়ারে, রঙিন চশমা পড়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অনেকেই, আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। কী কী পড়াশোনা করা লাগে এটা বুঝতেই আসলে পার হয়ে যায় ফার্স্ট ইয়ার, আর টিচারদের কাছে দৌড়াদৌড়ি তো আছেই।

এখন ভাবি যে করোনা না আসলে এই বড় ছুটিটা কখনোই পেতাম না। এটা একমাত্র প্লাস পয়েন্ট করোনা আসার আমার কাছে।ধীরে ধীরে পদার্থবিজ্ঞানের অজানা বিষয়গুলো ইউটিউব থেকেই দেখতে শুরু করি আর এই সময়ে মনে হতে থাকে আমাদের দেশের বইগুলো পড়ে কখনোই পদার্থবিজ্ঞান কতোটা সুন্দর সেটা সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়।

অনেকগুলো রিলায়েবল সোর্স তৈরি করি, আলাদা আলাদা টপিকের খাতা তৈরি করি, অনুভব করতে শুরু করি যেখানে ম্যাগনেটিজম চ্যাপ্টার টা অনেকেরই মাথাব্যাথা, সেটা আমার পড়তে কখনো কঠিন লাগছে না।

পরবর্তীতে নিরাশ হয়ে গেছিলাম, কারণ আমাদের শর্ট সিলেবাসে ছিল না দ্বিতীয় পত্রের আমার পছন্দের সব অধ্যায়।

করোনাকালীন সময়ে আমার সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আ্যটেনশান ধরে রাখা। যাইহোক, মাঝে মাঝে নদীর ধারে চলে যেতাম, এটা স্বাভাবিক কার্যধারার বাহিরে একটা নিতান্ত সুন্দর রিফ্রেশমেন্ট ছিল।

রসায়ন বিষয়ে দেখেছি নিজেদের সময় থেকেই অধিকাংশ সবাই এইটাকে ভয় করে, অনেক মিথ তৈরি করে এই ব্যাপারে যে কোয়েশ্চেন নাকি সব বই খাতা পড়ে গেলেও  বুয়েটে পারা যায় না। আসলে প্রোপার গাইডলাইন আর রিসোর্স মেইনটেইন করলেই ভালো করা সম্ভব।

আমি আমার অপিনিয়ন থেকে বলছি সফল যারা হয়, তারা অন্যদের থেকে এগিয়ে যায় শুধুমাত্র কনফিডেন্সে। সাথে ছিল বাবা-মার অফুরান আশাবাদ।

বুয়েট নিয়ে অনেক বেশি অবসেস্ড ক্লাস ৮/৯ থেকে হলেও, প্রথম বুয়েট দেখার সৌভাগ্য হয় ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১।

উত্তরা থেকে মামার সাথে যাওয়া আর ইসিই বিল্ডিং, পশ্চিম পলাশী এলাকার সামনে আসার আগেই একটা গুজবাম্পস অনুভব করাটা এখনো মনে পড়ে। সেই বুয়েট, আজন্মলালিত স্বপ্নের বুয়েট🤎

মায়ের ইচ্ছায় ৭ দিনের প্রস্তুতিতে মেডিকেল পরীক্ষা দিই, জানতাম আসবে না,তবুও শেষের দিকে যেয়ে অনেক বেশি প্রত্যাশী হয়ে উঠেছিলাম, কারণ আমার মনে হয় মানুষ যা কিছুর জন্য ভালো নিয়তে পরিশ্রম করে সেটার জন্য তার কিছুটা হলেউ আশা জন্মে।

৫ এপ্রিল আমার আ্যডমিশন লাইফের প্রথম ব্যার্থতার দিন, আমার একটা ডায়েরিতে সেটা লিখেও রাখি। তবে কারণ ছিল MIST এক্সামের রেজাল্টে ভালো কিছু পাওয়ার পর মেডিকেলের পড়াশোনায় কিছুটা ঢিলেমি।

যাক আমাদের জন্য টাফ একটা পিরিয়ড ছিল মেডিকেলের ব্যার্থতার পরেও সেখানে থেকে ঘুরে দাঁড়ানো। ভাইয়াদের কথাগুলো ফলো করে এগিয়ে আসলাম তার ফলাফল ও আসল IUT তে ৩৪০ তম হওয়ার মাধ্যমে।

আত্মবিশ্বাস এবার তুঙ্গে,কারণ কলেজ লাইফ শেষ হওয়ার পর যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছিলাম সেটার ইতি ঘটল।

আমার পড়ার টেবিলের পাশে একটা পেপারে লিস্ট করেছিলাম যে লাইফের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ৪ টা এক্সাম আই.ইউ.টি, বুয়েট প্রিলি, বুয়েট রিটেন আর ডি.ইউ এই ৪ টা তে ভালো করলে একটা করে টিক মার্ক দিব, অনেকটা হাস্যকর হলেও টেবিলে বসে বারবার চোখ পড়ত আর অজানা অনুপ্রেরণা পাওয়া যেত।

ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল & কলেজে প্রিলি আর ওল্ড একাডেমিক ভবনে রিটেনের কেণ্দ্র ছিল আমার, আল্লাহর অশেষ কৃপায় দুই পরীক্ষাতেই কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পরীক্ষা দিয়েছি। কোনো প্যানিক্ড মোমেন্ট ছিল না এক্সাম হলে।

যদি রিটেন এক্সাম হলের কথা বলি আমার খাতা থেকে আমার চোখ সরেছে আর কলম উঠেছিল মাত্র একবার সেটা শেষ ১৫ মিনিট আগে যখন ঘড়ি দেখেছিলাম। জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা যে এত সহজভাবে দিয়ে ফেলব এটা বাসায় এসেউ বুঝতে পারি নি

এখন মনে হয়ে কয়েক ন্যানো সেকেন্ডেই ঘটে গেল সবকিছু🤎😌

আমার জন্য দোয়া করবেন। যেন ভবিষ্যতে ভালো প্রকৌশলী হতে পারি, সর্বোপরি ভালো মানুষ হতে পারি।আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন🙏

আরো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চাই যারা প্রতি মুহুর্তে আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন, তাদের প্রত্যাশা আমি পূর্ণ করতে পেরেছি এই ভেবেই আমি অনেক আনন্দিত।

পদার্থবিজ্ঞানে ইউটিউব ছাড়াও ফাস্ট ইয়ারে আমার ফিজিক্সের প্রথম হোম টিউটর জাফর স্যারের কাছেই আমার হাতেখড়ি, রসায়নে সঞ্জয় ভাইয়া ছিলেন একমাত্র ভরসা সব সময়ের জন্য।

বি.দ্র.আমার সম্পূর্ণ আ্যডমিশন প্রিপারেশান ছিল অনলাইন ভিত্তিক, যারা মনে করো অনলাইনে ভালো পড়াশোনা হয় না, এটা তাদের জন্য একটা অনুপ্রেরণা।

নিজের সুস্থতা কামনা করে শেষ করছি।এত বছরের সাধনা শ্রমের প্রাপ্তির মধুরতা প্রকাশ করতে যে অনেক বেশি শব্দ খরচ করে ফেলেছি সেটা সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন🙏আল্লাহ হাফেজ।

Galib Hasnaine Dhrubo
BUET: 660th (Mechanical Engineering)
IUT : 340th
DU : 867th
MIST: 1159th

Ex- RCian
Ex- Laboratorian