ছোটো বেলায় খুব মেধাবী ছাত্রদের লিস্ট এ কখনো ছিলাম না তবে ক্লাস থ্রি তে যখন পড়ি তখন গ্রামে চলে যেতে হয়েছিল ২ বছরের জন্য! তখনই পড়ালেখার বিষয়ে প্রতিযোগিতা জিনিসটা উপলব্ধি করি। স্কুল এর নাম ৪১ নং গোশাইরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে আমরা হাতে গোনা কয়েকজন ই ভালো ছাত্র ছিলাম,কিন্তু আমাদের মধ্যে সব সময় প্রতিযোগিতা থাকতো কে কার আগে যেতে পারে!!

কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি অনেক চেষ্টা করেও কখনও ফার্স্ট হতে পারি নাই😂 কিন্তু আমি যখন পিইসি পরীক্ষা দিব তার তিন মাসে আগে আবার ঢাকায় চলে এলাম,এবং শুধু যেয়ে এক্সাম দিয়ে এসেছিলাম! এবং তখন কিভাবে যেন আল্লাহর রহমতে স্কুলএ প্রথম আর উপজেলায় চতুর্থ হলাম। সবাই খুব খুশি,আমিও! কারন শেষ ভালো যার সব ভালো তার😄

এখন ঢাকায় শুরু নতুন বিপদ!! এতদিন গ্রামে থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলাম,যেটা পরবর্তী তিনটা বছর লেগেছে শুধু গেপ পূরণ করতেই! আমি ক্লাস ৬ থেকে ১০ পড়েছি এ.কে হাই স্কুল এ।

এখানে ভর্তি পরীক্ষা খুবই কঠিন ছিল,দুই মাস ভর্তি কোচিং করে আল্লাহর রহমতে ভর্তি হলাম! ভর্তি হয়ে দেখি এখানকার ছাত্ররা ছিল আমার থেকে অনেক এগিয়ে, তাদের সাথে তালমেলানোটা যেন ছিল পুরো একটা যুদ্ধ!
এভাবে চলতে থাকলো,জে.এস.সি তেও এ+ পেলাম, নবম শ্রেণিতে উঠে সাইন্স নিলাম! আর আবার বড় ধাক্কা খেলাম,কিভাবে পড়বো,কি করবো এসব নিয়ে! কারন আমাকে গাইড করার মতো আসলে কখনই কেউ ছিল না,সাথে ছিল শুধু বাবা মা।

তারা সব সময়ই পাশে ছিল। যখন সবাই ত্রিকোণোমিতির ম্যাথ গুলো সবার আগে উত্তর করতো তখন আমি ভাবতাম কি এসব সাইন কস,ট্যান! ফিজিক্স কিছুটা বুঝলেও কেমিস্ট্রি কিছুই পারতাম না! হা করে তাকায়া থাকতাম,কোচিং ছিলো শুধু যাওয়া আসার জন্য! কান্না পেতো খুব কীভাবে কি করবো এসব ভেবে!

আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট টা ছিলো ক্লাস টেন এ!! আমাদের এলাকায় সুমন ভাই ফিসিক্স কেমিস্ট্রি পড়াতো কিন্তু নতুন নতুন শুরু তখন,এক বন্ধুর কথায়ই গেলাম ক্লাস করলাম! ভাই এত্তো ভালো বুঝাতেন যে খুব অল্প কয়দিনে বুঝলাম যে আমাকে দিয়ে সম্ভব!! ভালো করে পড়লাম এস.এস.সি দিলাম শুধু সমাজে এ+ মিস গেলো!

এখন শুরু কলেজ এর চিন্তা, নটরডেম এর প্রিপারেশন নিলাম না,চান্স ও পাই নাই,কিন্তু পরে খুব আফসোস হলো যখন দেখলাম অনেক বন্ধু ই চান্স পেলো! অনলাইন আবেদন করলাম, ওয়েটিং লিস্টে মোটামোটি টপ টেন কলেজ এর সবই আসলো,ঠিক করলাম ঢাকা কলেজ এ ভর্তি হবো,ওয়েটিং পজিশন ছিল ১২৫০!

শেষে এক বন্ধুর কথায় ভর্তি হলাম আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ এ! কিন্তু এখন সমস্যা বাসা থেকে অনেক দূর ছিলো, ২ টা বছর যাওয়া আসা তে ভালোই বেগ পেতে হয়েছে😅 কলেজ,ব্যাচ মিলাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে!

এভাবে দেখতে দেখতে এইচএসসি চলে আসল,২০১৮ এর ব্যাচ,যারা দিয়েছে এই বছর এক্সাম তারা জানে কি ছিলো! বায়োলজি ১ম পত্রের MCQ আর ফিসিক্স ২য় পত্রের CQ!! ফেল করার অবস্থা! শেষে আল্লাহর রহমতে এ+ আসলো তবে ওই দুইটাতেই এ+ মিস😅 ততদিনে উদ্ভাস এ ভর্তি কোচিং শুরু করে দিয়েছি। রেসাল্টের অবস্থা ও খুব ভালো না, তখন ভয় আসলো বুয়েটে এক্সাম দিতে পারন কিনা,কারন ফিসিক্স কেমিস্ট্রি আর ম্যাথ ই তো আসল!

ছোটোবেলা থেকেই প্রচন্ড ইচ্ছা ইন্জিনিয়ারিং পড়বো, কলেজ পড়ার সময়তো বুয়েটকে ক্রাশই বানায়া ফেলছি 😅 কোনো একটা ম্যাথ না পারলে পাশে লিখে রাখতাম BUET,যাতে ওইটা আরো বেশি গুরুত্ব দেই! শুয়ে বসে শুধু বুয়েট নিয়েই চিন্তা করতাম।

শুরু হয়ে গেলো ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধ! আমিও শুধু সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ফর্ম ই তুলেছিলাম,ভেবেছি এতো কষ্ট করে পড়ালেখা করে ভালো ভার্সিটিতে চান্স না পেলে পড়ালেখাই ছেড়ে দিব,আর এমনিও প্রাইভেট এ পড়ানোর মতো সামর্থও আমার বাবার নেই! শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক ইউনিটের পরীক্ষা দিয়ে, পরীক্ষার পরে বের হয়ে খুব খুশি,জোস এক্সাম দিলাম,চান্স নিশ্চিত,পরে এন্সার মিলায়া দেখি পাস ও আসে না😅 গেলো আমার ওভার কনফিডেন্সের দিন!

এরপর দিলাম জগন্নাথ আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ পরীক্ষা, এবার আর কোনো ওভার কনফিডেন্সের কথা ভাবিনি! হাজার হাজার মানুষ,কীভাবে টিকবো,মনে শুধু এই ভয়ই ঘুরেছে! পরে দেখলাম আল্লাহ র রহমতে জাবিতে ১৫৮১ আর জবিতে ৫০৩ হলো,কনফিডেন্সও ফিরে পেলাম!

এখন আসলো আসল যুদ্ধ,বুয়েট এ এক্সাম! এক্সেস নারভাসনেস এর কারনে কয়েকটা ম্যাথ মিলাতে পারলাম না,গেল আমার বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন! ১৮ তারিখ রেসাল্ট দিয়েছে আমি তখন বোনের বিয়ে তে গ্রামে ছিলাম,রেসাল্ট দেখে খুব কষ্ট পেলাম,আব্বু আম্মুর অনেক খারাপ লাগলো! লাগার ই কথা! আমিও কিছুটা ভেঙে পড়লাম!!

২১ তারিখে ছিল রুয়েটের এক্সাম, পরীক্ষা দেয়ার ইচ্ছা ছিলো না কিন্তু তখন ভাবলাম দেই,কিন্তু কোথাও টিকেট নাই কীভাবে কি করবো, তারপর অনেক খুঁজে তিনজন কলেজ বন্ধুর সাথে তাদের প্রাইভেট কার এ গেলাম রাজশাহী, ২০ তারিখ রাত ১ টায়,পরদিন সকালে কিছুটা দেখলাম বিগত বছরের প্রশ্ন! ৯ টায় এক্সাম দিলাম,যতটা যা মনে ছিলো দিলাম, কিন্তু আশা করলাম না,কারন বুয়েটের এক্সাম এর পর আর বই ই ধরি নাই!

এরপর কুয়েট এ দিলাম,চবি আর চুয়েট ও দিলাম,এবং চিটাগং এ বসেই দেখলাম রুয়েট এ আমার পজিশন ৯১১ হয়েছে, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন ঐদিন ছিল,এত্তো বেশি খুশি লেগেছে যা বলার মতো না,নিজের আত্মবিশ্বাস অননেক বেড়ে গিয়েছিল,এতোদিন আমি কিছুই ছিলাম না আজ আমি দেশের অন্যতম সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র! আব্বু আম্মু ঐদিন অনেক খুশি হয়েছিলো,তাদের মুখটা দেখে আমার সব দুঃখ ব্যর্থতা ভুলে গিয়েছিলাম!

এরপর অবশ্য চুয়েট আর কুয়েটেও ভালো পজিশন এসেছিল কিন্তু কেনো যেনো রুয়েট এর প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা কাজ করেছিলো, রুয়েট আমাকে একটা পরিচয় দিয়েছে যার অনুভূতি অসম্ভব রকমের ভালো!

অনেক বার অনেকের কাছে ছোটো হয়েছি,একবার এক কোচিং এর শিক্ষক সবাইকে বলছিলেন কে বড় হয়ে কোথায় পড়বে,আমার দিকে চোখ পড়তেই বললেন তোকে নিয়ে কি বলবো,তোকে দিয়ে কিছুই হবে না! ঐদিন ই আমি কোচিং ছেড়ে দিয়েছি, কথাটা খুবই গায়ে লেগেছিলো!ভেবেছিলাম কিছু একটা করেই দেখাবো,করে দেখিয়েছি আল্লাহর রহমতে 😄

আব্বু আমাকে একবার ভর্তি কোচিং এর রেসাল্ট দেখে বলেছিলো কয়েকটা নিচের সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম নিতে, আমাকে দিয়ে নাকি ভালো কিছু হবে না,ঐদিন আব্বুকে ডিরেক্ট বলেছি আমি বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো একটাতে পড়বো,আর আজ আব্বু যাকে পায় আমার কথা গর্ব করে বলে তার ছেলে ইন্জিনিয়ারিংএ পড়ে,শুনতে ভালো লাগে😄 আম্মু প্রথম থেকে শেষ পুরোটা সময় আমার পাশে ছিলো আমাকে উৎসাহ দিয়েছে, নাহলে হয়তো কখনওই সম্ভব হতো না!

পুরো জীবনে যেই একটা কথা আমাকে কখনও থামতে দেইনি সেটা হলো- থামলে চলবে না, চলতে হবে,শেষ দেখেই ছাড়ব! হতাশা আসবেই, কিন্তু আশা ছাড়লে চলবে না! কারন সব কিছুর শেষটা খুব সুন্দর।😄 ধন্যবাদ!

সাব্বির আহমেদ রিফাত
ডিপার্টমেন্ট অব মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং,
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

আপনার অনুপ্রেরণা মূলক লেখা আমাদের দিতে পারেন এই গ্রুপে