ছাত্র হিসেবে আমি কখনোই খারাপ ছিলাম না। কিন্তু অলস ছিলাম। ব্যাপারটি আমি ধরতে পেরেছি কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে এসে। তখন আমি নটরডেম কলেজের ছাত্র। থাকতাম আরামবাগের কোনো একটা হোস্টেলে। এর আগে নিজ বাসায় থাকতাম।
আমার সব কিছু মা করে দিতো, আর আমি শুধু পড়াশুনা করতাম। কিন্তু কলেজে উঠে হোস্টেলে থাকাকালে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খাই। কেন জানি হোস্টেলের খাবার খেতে পারতাম না। হোস্টেলের পরিবেশ ভালো লাগতো না।
সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো ছারপোকা। রাতে ঘুমুতেই পারতাম না। যারা ছারপোকার উৎপাতে কখনো না কখনো আক্রান্ত হয়েছেন, তারা ব্যাপারটা ভালোভাবেই বুঝতে পারবেন। আমার আরেকটা সমস্যা ছিলো, আমার স্কুল এর শিডিউল!
আমি হাই স্কুল পড়েছিলাম ডে শিফটে। স্বাভাবিকভাবেই সকালে উঠার অভ্যাস আমার কখনোই ছিলো না। কিন্তু এখন আমার কলেজ শুরু হতো সকাল ৮.০০ বাজে। ঘুম থেকে উঠতে পারতাম না প্রায়-ই।
তো.. সব মিলিয়ে কথা দাঁড়ালো, হোস্টেলের খাবারের সমস্যা, ঘুমানোর সমস্যা, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়ার সমস্যা, ঘুম থেকে উঠার সমস্যা, তার উপর আমাকে তদারকী করার মতো হোস্টেলে কেউ নেই।
ফলাফল যা হবার তাই হলো। রেজাল্ট খারাপ করতে লাগলাম আমি। ব্যাপারটা এমন নয় যে এসব সমস্যা জীবনে আমিই ফেইস করেছি। এমন সমস্যার মধ্যে থেকেও অনেকে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু আমি কেন জানি মানিয়ে নিতে পারি নি।
এটা সম্পূর্ণভাবেই আমার ব্যর্থতা। নটরডেমে স্টুডেন্ট ছিলো ২০০০ জন। আমার পজিশান ছিলো ১৭০০ এর আশেপাশে। মাঝখানে অনেক চেষ্টা করেছি কামব্যাক করার। পারি নি। তার উপর এটেন্ডেন্স কম ছিলো আমার।
আমার বাজে রেজাল্ট আর কম এটেন্ডেন্স দেখে একদিন কলেজের গাইডেন্স এর ফাদার আমার বাবাকে ডেকেছিলেন। বাবাকে বলেছিলেন,
“আপনার ছেলের অবস্থা নিয়ে আমরা সন্দিহান। সে এইচএসসিতে কি করবে বুঝতে পারছি না। তার যত্ন নিবেন।”
বাবা কোনো উত্তর দেন নি। খুব করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তখন টেস্ট পরীক্ষা শেষ। সারাদিন বাসায় বসে পড়ার সময়। এদিকে কলেজে উঠে আমার রেজাল্টের দুর্দশার কথা কীভাবে জানি চারপাশে রটে গিয়েছিলো। যথারীতি মা বাবাকে সবাই প্রশ্ন করতো, “ওর হঠাৎ এমন কি হলো?”
এদিকে আমিও প্রায়ই তেঁতো সব প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতাম। কিন্তু বলার মতো মুখ ছিল না সেদিন। এদিকে জোরেসোরে পড়াশুনা শুরু করে দিই। আমি কখনোই গাধার মতো পরিশ্রম করে পড়ি নি। কিন্তু সময়টাকে খুব চৌকসভাবে কাজে লাগিয়েছিলাম।
আমি বই নিয়ে পড়ার টেবিলে বসতাম না বলতে গেলে। আমি সবকিছু নিয়ে বিছানায় চলে যেতাম। যতোক্ষণ চোখ খোলা থাকতো,পড়তাম। চোখ ক্লান্ত হয়ে এলে ঘুমিয়ে যেতাম।
ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন। ভালো রেজাল্ট, ভালো ভার্সিটি,সব বাদ! আমি নিজেকে ওয়াদা করেছিলাম না বুঝে আন্দাজে কিছু পড়বো না। যা-ই পড়ি যেন বুঝে বুঝে পড়ি।
মনের আনন্দ থেকে জানার জন্য যেন পড়ি, কোনো কিছুর চাপে নয়।
বিশ্বাস করুন? এই একটা মনোভাবই সব হিসাব পাল্টে দিয়েছিলো। আমি সারাদিন বই পড়তাম। আর যে লাইন বা কনসেপ্ট বুঝতাম না, দাগিয়ে রাখতাম। বুয়েটের এক ভাইকে ঠিক করেছিলাম আমাকে হোস্টেলে এসে পড়িয়ে যাবার জন্য।
তিনি বিকেলে আসতেন, আমাকে আনক্লীয়ার কনসেপ্ট গুলো বুঝিয়ে দিয়ে যেতেন।
এভাবে ২ মাস চললো। ডিসেম্বর-জানুয়ারি এই দুইটা মাস সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করা মাস! কিন্তু এই দুইমাস পরে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস চলে এসছিলো অনেকটা।
আমার মনে পড়ে,ডিসেম্বরের শুরুতে টেস্ট পেপার কেনার পর পাতা উল্টিয়ে দেখেছিলাম প্রায় ৭০% প্রশ্ন কোথা থেকে এসেছিলো তা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে পুরো টেস্ট পেপার প্রায়-ই আয়ত্ত্বে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম।
আর মার্চ মাস পুরোটা কাটিয়ে দিয়েছিলাম ম্যাথ আর ফিজিক্সের প্রবলেম সলভ করতে করতে! ফিজিক্স আমার স্ট্রং পয়েন্ট ছিলো। ফিজিক্সের যেকোনো সমস্যাই নিজে নিজে পেরে যেতাম।
এরপর এপ্রিলে এইচএসসি গেলো। যা আশা করছিলাম তার চেয়ে অনেক ভালো দিয়েছিলাম। ততোদিনে উদ্ভাসে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু উদ্ভাসে খুব স্ট্রাগল করছিলাম।
কারণ যদিও আমার বেসিক ততোদিনে যথেষ্ট ভালো ছিলো,কিন্তু হাজার হোক.. যারা দুইবছর টানা পরিশ্রম করেছে, তাদের সমান তো আর হতে পারি নি তখনো। কোচিং এর ভাইয়া একটা কথা বলেছিলো। যতো যা-ই হোক, প্রশ্নব্যাংক যেন না ছাড়ি।
প্রশ্নব্যাংক নিয়ে যেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লেগে থাকি। এটাই আমি আমার মেইন স্ট্র্যাটিজি হিসেবে কাজে লাগিয়েছি। এর ফলাফল আসলে কি হবে বা আদৌ ঠিক পথে এগুচ্ছি কিনা.. আমি জানতাম না!
একসময় এইচএসসি এর রেজাল্ট আসে। তার আগে এর মধ্যে যে কতো বার বাসার লোকজন থেকে, আত্মীয় স্বজন থেকে আর বন্ধু বান্ধব থেকে প্রচ্ছন্ন খোঁটা শুনেছি হিসেব নেই। যাই হোক, এইচএসসি এর রেজাল্ট আসলো ৫.০০। গোল্ডেন পাই নি।
২ মার্কের জন্য একটাতে মিস। কিন্তু তাও যথেষ্ট স্বস্তির ছিলো আমার জন্য। অন্তত যা নাম্বার পেয়েছিলাম, তা দিয়ে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় পরীক্ষা দিতে পারতাম আমি। এটাই বড় পাওয়া!
এদিকে আমি প্রশ্নব্যাংক নিয়ে পড়ে থাকার স্ট্র্যাটেজি থেকে নড়ি নি। মাঝের দিকে উদ্ভাসের তুখোড় ব্যাচে ঢুকে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত ছিলাম ওখানে। একটা সময় পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে। প্রথম পরীক্ষা ছিলো ঢাবি “ক” ইউনিটের।
আমার মনে পড়ে ঢাবির পরীক্ষার আগে ঢাবির প্রশ্নব্যাংক (গত ২০ বছরের) প্রায় মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। মোটামোটি মাথায় ছিলো ঢাবি এর এক্সামে কি প্রশ্ন আসতে পারে আর কীভাবে আন্সার করা লাগবে তার টেকনিকগুলোও মাথায় গেঁথে নিয়েছিলাম।
আমি ছোটবেলা থেকেই চাপ জিনিসটা উপভোগ করি। অন্তত চাপের মুখে ভেঙ্গে পড়েছি এমন দিন খুব কম এসেছে জীবনে। ঢাবি পরীক্ষায় আমি কোনো চাপ অনুভব করি নি। ঢাবি আমার পছন্দের জায়গা।
আমি কলেজে পড়াকালীন প্রায়-ই ঢাবিতে ঘুরতে যেতাম। সব জায়গা আমার পরিচিত। আমি খুব ঠান্ডা মাথায় হলে গিয়ে বসেছিলাম। প্রশ্নটা পাওয়ার পর অনেকটা মনে হচ্ছিলো যেন বাসায় বসে প্রশ্নব্যাংকই সলভ করছিলাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমি কোনো প্রশ্নে আটকাচ্ছিলাম না।
কিন্তু হালকা গোল বাঁধে রিটেনে। আমি বায়োলজি না দাগিয়ে বাংলা দাগিয়েছিলাম। আমি বায়োলজি পারতাম না। জোড়াতালি মারা প্রিপারেশান যেহেতু, বায়োলজি পারার মতো অধ্যাবসায় বা পরিশ্রম বা ধৈর্য্য কোনোটিই ছিলো না। যাই হোক, রিটেনে বাংলা লিখতে গিয়েছিলাম সবার আগে।
তখন আমি নৈব্যক্তিক পরীক্ষা ভালো হবার আনন্দে টগবগ করছি। ফলাফলঃ রিটেনে প্রচুর সময় নষ্ট হয়েছে আমার। বাংলা ফুল আন্সার করে রসায়ন+ম্যাথ+ফিজিক্স ফুল আন্সার আর হয় নি আমার। এই শিশুতোষ ভুলের কারণে ভালো এক্সাম দিতে দিতেও সিট হারাবো কিনা এই ভয়ে ছিলাম আমি।
তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে ঢাবি “ঘ” এর পরীক্ষা। আমার কোনো প্রিপারেশান নেই। পরের দিন IUT এর এক্সাম। আমি তাও গিয়েছিলাম ঘ এর এক্সাম দিতে। তার কারন ছোটবেলা থেকেই কুইজিং এর সাথে জড়িত ছিলাম। সাধারণ জ্ঞান আর বেসিক বাংলা/ইংরেজি খুব ভালো ছিলো আমার।
তাই পরীক্ষাটি দিতে গিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ আগের স্মৃতি তখনো টাটকা আমার। নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম, “এবার প্রশ্ন পেলে মাথা গরম করা চলবে না। ফুলটস বল তেঁড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে বাউন্ডারিতে ক্যাচ হবার কোনো মানে হয় না। ঠান্ডা মাথায় গ্যাপে ড্রাইভ করে দিলেই কেল্লা ফতেহ!”
যাই হোক.. ঢাবি “ঘ” ইউনিটের পরীক্ষা আমার জীবনে দেয়া সেরা পরীক্ষা ছিলো। ৪০০ তম হয়েছিলাম ঘ ইউনিটে। কিন্তু আর ভর্তি হই নি ওখানে৷ বাবা চাচ্ছিলেন আমি যেন বিভাগ পরিবর্তন না করি।
এডমিশান সিজন তখন সবে মাত্র শুরু।
কিন্তু আমার জন্য এডমিশান সিজন প্রথম এক সপ্তাহেই শেষ। আমার স্বপ্ন ছিলো ঢাবি। আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম আমার ঢাবিতে হবেই। তারপরও আরো কিছু জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছি। মোটামোটি সাব্জেক্ট পাবার মতো পজিশান ছিলো IUT,CUET,RUET এ।
শেষ পর্যন্ত আমি ভর্তি হয়েছিলাম ঢাবি “ক” ইউনিটেই! রেজাল্ট দেয়ার পর আমার পজিশান ছিলো ১৮০০। ওই যে.. রিটেনের ব্যাপারটি আমাকে ভুগিয়েছিলো। সাবজেক্ট পেয়েছিলাম Applied Chemistry and Chemical Engineering.
আমার বাবার খুব পছন্দের এক সাবজেক্ট। তিনিও ঢাবির শিক্ষার্থী ছিলেন। এখন জীবনটা অন্যরকম। ঢাবিতে ক্লাস করতে যাই। মাঝখানে উদ্ভাসে ফিজিক্স টিচার হিসাবে নিয়োগ পেয়ে গেছি। উদ্ভাসে ক্লাস নিতে যাই। খুব প্রশান্তি লাগে।
মাঝে মাঝে কলেজ লাইফের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। সবার কাছ থেকে শোনা টিটকারিগুলোও কানে বাজে। এইচএসসি এর টেস্ট পরীক্ষার পর থেকে পুরো এডমিশানের আগ পর্যন্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা পেয়েছি।
মানুষ আপনাকে নিয়ে দিনশেষে কি বললো বা ভাবলো তা ব্যাপার না। দিনশেষে আপনি আপনার পরিশ্রম দিয়ে কোথায় পৌঁছালেন সেটাই ব্যাপার। আল্লাহ কার জন্য কোথায় কি রেখে দিয়েছেন তা কেউ জানে না। পরিশ্রম করে যান!
কানে থাই গ্লাস লাগিয়ে নিন। কোনো চাপ না নিয়ে কনসেপ্টগুলো ক্লীয়ার করে যান। আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন! দেখা হবে বিজয়ে!
জাওয়াদ তাহসীন স্নেহ
ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার অনুভূতি লিখে জানান আমাদের গ্রুপে