ইঞ্জিনিয়ার হ‌ওয়ার স্বপ্নটা যে একদম ছোটবেলা থেকে ছিল তা না, আমিও আর পাঁচজনের মত মাই এইম ইন লাইফ রচনায় চিরকাল ডাক্তার হবার কথা লিখে এসেছি।

তবে হ্যাঁ, রচনায় ডাক্তার হবার কথা লিখলেও ডাক্তারী পেশার প্রতি আমার ভালবাসা ছিল না কোনদিন‌ই। ক্লাস নাইনে যখন সাইন্স নিলাম মূলত তখন‌ও ঠিক করে বুঝতাম না ডাক্তার হলে কি হবে আর ইঞ্জিনিয়ার হলেই বা কি হবে।

আর এই এস‌এসসির আগের সময়টায় আমি আসলেই অঙ্ক জিনিসটাকে প্রচন্ড ভয় পেতাম। বলে রাখি আমার বাসা ঢাকায় এবং আমি পড়াশোনা করেছি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে।

স্বাভাবিকভাবেই শহরের আর পাঁচটা নামকরা স্কুলের মত আমাদের স্কুলের‌ও প্রশ্নের মান একদম অন্যরকম হতো, এখানে স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় ভাল ফলাফল করা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। স্কুলের পরীক্ষায় সব বিষয়ে মোটামুটি ভাল নম্বর পেলেও গণিতে কোনরকমে পাশ করে যেতাম।

শিক্ষকদের কাছ থেকেও যথেষ্ট তিরস্কার পেয়েছি অঙ্কে এতটা খারাপ হ‌ওয়ার জন্য। কিন্তু তবুও প্রচুর পরিমাণে ব‌ইয়ের অঙ্কগুলো বারবার প্র্যাক্টিস করা শেষ পর্যন্ত কাজে দিয়েছিল।

এস‌এসসিতে জিপিএ পাঁচ নিয়ে ভর্তি হলাম আমাদের কলেজেই (আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ)। আমি বরাবরই এমন স্বভাবের ছিলাম যে সারাবছর খুব একটা সিরিয়াসলি পড়াশোনা করতাম না, তবে পরীক্ষার সময় আসলে খাওয়া-ঘুম সবকিছু ভুলে গিয়ে দিনরাত এক করে দিয়ে পড়তাম।

কলেজে উঠার পর থেকেই হঠাৎ করে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছাটা তৈরি হয়। অঙ্কের প্রতি ভয়ের বদলে ভাল লাগা কাজ করতে শুরু করলো তখন থেকেই।

আর তখন ভাল লাগতো না বায়োলজি, পরীক্ষার আগে বায়োলজি পড়তাম শুধুমাত্র কলেজে পাশ করার জন্য। এভাবেই ইন্টারের সম্পূর্ণ দুবছর কাটিয়েছি শুধুমাত্র গণিত, পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়নে সময় দিয়ে।

মোটামুটি কলেজের প্রথম বর্ষ থেকেই আমি ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় বিগত বছরে আসা প্রশ্নগুলো সল্ভ করতাম। এছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং টার্গেট থাকার কারণে রিটেন পার্টের ওপর জোর দিতাম বেশি, এজন্য নৈর্ব্যক্তিক অংশে কিছুটা দুর্বল ছিলাম।

এইচএসসির চারমাস আগে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের প্র্যাক্টিস বাদ দিয়ে টেস্ট পেপার সল্ভ শুরু করি। শিক্ষকদের সাজেশন অনুযায়ী টেস্ট পেপার সল্ভ করে নিয়মিত মডেল টেস্ট দিতাম, আর এভাবে নৈর্ব্যক্তিক অংশ‌ও অনেকটা কভার করতে পেরেছিলাম।

সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে এইচএসসি পরীক্ষাতেও আমি জিপিএ পাঁচ পেয়েছিলাম। এইচএসসির পর উদ্ভাসে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং শুরু করি। উদ্ভাসের ক্লাসগুলো আমি মনোযোগ সহকারে করার চেষ্টা করতাম এবং কোন ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতাম না।

উদ্ভাসের সব সাপ্তাহিক পরীক্ষাগুলোও দিতাম, তবে খুব একটা ভাল নম্বর পেতাম না। আমার কেবল টার্গেট ছিল নিজের মত করে পড়াটা কমপ্লিট করে পরীক্ষা দেওয়া, নম্বর কম পেলেও কখনো সেটাকে গুরুত্ব দিতাম না।

সাপ্তাহিক পরীক্ষায় পজিশন তিন থেকে চার হাজারের মধ্যে থাকতো। বাসায় নম্বরের মেসেজ এলে বকাবকি খেয়ে সিচুয়েশন খারাপ হবে বলে আম্মুর ফোন থেকে উদ্ভাসের নম্বর ব্লক করে রেখেছিলাম।

ওয়েবসাইট থেকে নিজে নম্বর দেখে নিতাম অথবা একেবারে খাতা পাওয়ার পর দেখতাম। তবে সত্যি কথা বলতে এইচএসসির পর থেকে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার আগে পর্যন্ত মেইন ব‌ই আর প্রশ্নব্যাঙ্ক কতবার শেষ করেছি তার হিসেব নেই।

বুয়েট ভর্তি বিজ্ঞপ্তি ছাড়ার পর দেখা গেল পাঁচ বিষয়ের গ্রেড পয়েন্টের বদলে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন এই তিন বিষয়ের নম্বর চাওয়া হয়েছে।

এখানে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম কারণ আমি এ প্লাস পেলেও নৈর্ব্যক্তিক অংশে খারাপ করায় অন্যদের তুলনায় কম নম্বর পেয়েছিলাম। বুয়েটের বাছাই পর্বে বাদ চলে যাব এই চিন্তায় বাছাইয়ের তালিকা প্রকাশের আগ পর্যন্ত ঠিকমত পড়াশোনাও করতে পারিনি।

এতদিন ধরে যেই প্রতিষ্ঠানে পড়বো বলে মনে মনে এত স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম, জিপিএ পাঁচ নিয়েও সেখানে পরীক্ষা দিতে পারব না এটা ভাবতেই পারতাম না।

মাঝখানে কিছুদিন কেটেছিল প্রচন্ড টেনশনে কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুয়েট, রুয়েট, কুয়েট, চুয়েটসহ যেখানেই এপ্লাই করেছিলাম সব জায়গায় পরীক্ষা দেবার জন্য সিলেক্টেড হয়েছিলাম।

বুয়েটের সিলেকশনের লিস্ট দেওয়ার পর থেকে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত খুব পড়াশোনা করেছিলাম, আমার সর্বোচ্চ ইফোর্ট আমি দিয়েছিলাম এই সময়।

আর এর মধ্যেই ঢাবি ক আর আইইউটিতে পরীক্ষা দিই। আইইউটিতে মোটামুটি একটা পজিশন ছিল, কিন্তু মা-বাবার ইচ্ছা ছিল যেন আমি সরকারিতে পড়ি।

বুয়েটের দুদিন আগে ছিল চুয়েটে পরীক্ষা, বুয়েটের পরীক্ষার আগে জার্নি করে এতদূরে চুয়েটে পরীক্ষা দিতে যেতে আব্বু-আম্মু নিষেধ করেছিল, তাই আবেদন করেও চুয়েটে পরীক্ষা দিতে যাওয়া হয়নি।

এছাড়া মেডিকেলে আবেদন করা ছিল, শূন্য প্রিপারেশন নিয়ে মেডিকেলে পরীক্ষা দিই। বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাও থামিনি, যতদূর সম্ভব পড়া চালিয়ে গেছি।

ভর্তি পরীক্ষার আগের রাত সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছি, সকালে পরীক্ষা দিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে, সেই সাথে অসম্ভব মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল।

এমনকি পরীক্ষা শুরুর পাঁচ মিনিট আগে যখন রোল লেখার জন্য খাতা দেওয়া হয়, রোলটা লিখতে গিয়ে বুঝতে পারি আমি সেটাও লেখার মত অবস্থায় নাই, থরথর করে হাত কাঁপছে।

এরপর সম্পূর্ণ তিনঘন্টা এই অবস্থা নিয়ে আমি কিভাবে পরীক্ষা দিয়েছি বলতে পারবো না, তবে পরীক্ষা দিয়ে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম আমার প্রিপারেশনের তুলনায় পরীক্ষা ভাল দিতে পারিনি। একরাশ হতাশায় ডুবে গিয়ে তখন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম, একটুও না পড়ে বাকি পরীক্ষাগুলো দিয়েছিলাম।

কখনো ভাবিনি যেই বুয়েট নিয়ে আমি দিবারাত্রি স্বপ্ন দেখেছি সেখানে পরীক্ষাটা এমন হবে, অথচ নিজেকে একটু শান্ত রাখতে পারলে হয়তো আজ বুয়েট‌ই হতো আমার ঠিকানা।

রেজাল্ট যেদিন‌ দেয় সেদিন‌ও এক‌ই অবস্থা হয়েছিল, ফোনটা হাতে নিয়ে থরথর করে হাত কাঁপছিল, এভাবেই লিস্টে নিজের নাম খুঁজছিলাম।

আগে থেকেই যা ভেবেছিলাম তাই হলো, বুয়েটের কোন লিস্টে আমার নাম ছিল না, ভাবতেই পারছিলাম না যে আমি বুয়েটকে হারিয়ে ফেলেছি সারাজীবনের জন্য।

বুয়েটের জন্য যেই প্রিপারেশন ছিল সেটা নিয়েই কুয়েট আর রুয়েটে পরীক্ষা দিই, দুটোতেই ভাল পজিশন আসে। তখন অনেকটা স্বাভাবিক হ‌ই, আব্বু-আম্মুও খুশি হন।

রুয়েটে পজিশন কুয়েটের চেয়ে বেশি ভাল থাকায় এবং ঢাকা-রাজশাহী যোগাযোগের রাস্তা মোটামুটি ভাল হ‌ওয়ায় রুয়েটে ভর্তি হ‌ই। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আজ আমি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্রকৌশল সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয় রুয়েটে পড়ছি।

অবশেষে দেবদারু ঘেরা রুয়েট ক্যাম্পাসে নিজের জন্য এক টুকরো জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছি এবং নিজের ইঞ্জিনিয়ার হ‌ওয়ার স্বপ্নটা পূরণ করার পথে এগিয়ে যাচ্ছি, আলহামদুলিল্লাহ। <3

সাজিয়া আফরিন মুনিয়া
পুরকৌশল বিভাগ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

জুনিয়রদের জন্য আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন আমাদের গ্রুপে