ইন্টারে পড়ার সময় বড়দের মুখে একটা কথা অনেকবার শুনেছি, “তীরে এসে তরী ডুবিও না”। কিন্তু আসলেই তখন বুঝিনি এই কথার মর্ম, আজ বুঝি। ছিলাম মাদ্রাসার ছাত্র, ছাত্র হিসেবে তখন পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলাম।
শুধু মাদ্রাসার পরীক্ষাতেই না, বোর্ড পরীক্ষাতেও বরাবরই ভাল রেজাল্ট ছিল আমার। জেএসসিতে মাদ্রাসা বোর্ড থেকে প্রথম হয়েছিলাম, এসএসসিতেও অবস্থান ছিল দশের মধ্যে।
সঙ্গে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি তো ছিলই। কলেজ হিসেবে ঢাকা কলেজ ফার্স্ট চয়েস ছিল। এসএসসিতে মার্কস খুব ভাল থাকায় তখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলাম।
কলেজে ওঠার পর থেকেই আমি নিজের হাতে আমার পড়াশোনাটা ধ্বংস করে ফেলি। বিভিন্ন রকম মারামারি, গ্যাঞ্জামে জড়িয়ে পড়ি, পড়াশোনা হতো না বিন্দুমাত্র।
বড় ভাইদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ওঠা বসা, মাত্রাতিরিক্ত খেলাধুলা আর আড্ডাবাজি চলতো সারাদিন ধরে। ঢাকা কলেজের মত এরকম নামকরা কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েও নিজের অবহেলার কারণে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হতে থাকে।
কলেজ ফাঁকি দেওয়া, এমনকি কলেজে লুকিয়ে ফোন নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করার মত খারাপ কাজও করেছি। যখন কলেজ থেকে আইডি কার্ড আটকে রেখে গার্জিয়ান কল করে তখন আমার বাসায় ব্যাপারটা জানতে পারে।
যেই আমি চিরকাল এত ভাল রেজাল্ট করে এসেছি, ছোটরা আমাকে দেখে পড়াশোনা করার উৎসাহ পেত, আমাকে নিয়ে কথা বলার সময় আমার বাবা-মা গর্ববোধ করতো, সেই আমার কারণেই বাবা-মাকে এতটা অপমানিত হতে হয়।
যেই ভাইয়ার কাছে কোচিংয়ে গণিত-পদার্থ পড়তাম তিনি নিজে ছিলেন বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র। পড়াশোনার চরম অবনতি যখন উনার চোখে পড়ে উনি পড়াশোনার ব্যাপারে প্রচন্ড চাপ দিতে থাকেন, আম্মুকে ডেকে আমার ব্যাপারে জানিয়েছিলেন।
ভাইয়ার কোচিংয়ের পরীক্ষাগুলোতেও কিছু পারতাম না, কার থেকে দেখে লিখা যায় সেই সুযোগ খুঁজতাম। কেননা খারাপ নম্বর পেলেও আবার ভাইয়ার কাছ থেকে বকা খেতে হবে কিংবা বাসায় ফোন করে জানিয়ে দেবে।
আমার এই চালাকি এক সময়ে ভাইয়া ধরতে পেরেছিলেন, পরীক্ষার সময় আমাকে সামনের বেঞ্চে বসিয়ে নিজে আমার সামনে বসে থাকতেন, এমন কড়াকড়ির মধ্যে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সেই পরীক্ষাগুলোয় শূন্য পেতাম।
আমাকে অতিরিক্ত বাড়ির কাজ দিতেন, ক্লাসের মাঝখানে পড়া ধরতেন, না পারলে সবার সামনে প্রচন্ড অপমান করতেন, ক্লাস থেকে বের পর্যন্ত করে দিতেন কখনো কখনো, কিন্তু কোনকিছুতেই তখন আমি শুধরাইনি। অন্যদিকে কলেজেও ছিল একই অবস্থা, একটা রচনা পর্যন্ত নিজে লেখার ক্ষমতা ছিল না, কার থেকে দেখে লেখা যায় সেটাই খুঁজতাম।
কিন্তু সেখানেও স্যারদের কড়া নজরদারি এড়িয়ে দেখাদেখি করে পরীক্ষা দেয়া সহজ ছিল না। ফেইল করতে লাগলাম, কলেজ থেকে ফোন করে গার্জিয়ান ডাকা হতো, বারবার রিটেক এক্সাম দিয়ে তারপর কোনরকমে পাশ করে যেতাম।
বলতে গেলে এভাবে গড়িয়ে গড়িয়েই কোনরকমে এইচএসসিতে বসার সুযোগটা পেয়েছিলাম। কিন্তু শূন্য মাথা নিয়ে অন্যেরটা দেখে পরীক্ষা দিলে এর চেয়ে আর কতই বা ভাল রেজাল্ট করা যায়! আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ার, সেজন্য ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করবো ভেবেছিলাম।
এইচএসসির আগে পড়ালেখার হাল দেখে ভাইয়া নিষেধ করলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিংয়ে ভর্তি হতে। একদিন আম্মুকে ডেকে কোচিংয়ের বাকি সবার সামনে যা নয় তা বলে অপমান করলেন, বললেন আমাকে ডি ইউনিটের কোচিং করতে, আমি নাকি সেটারই যোগ্য।
মনে মনে খুব কষ্ট হতো এসব কথা শুনে, কিন্তু ততদিনে এইচএসসি সন্নিকটে চলে এসেছে। সবাই বলতে লাগলো এমন ধাঁচের পড়া নিয়ে বুয়েটে পড়া তো দূরের কথা, কোন ইঞ্জিনিয়ারিং এ এপ্লাই করার মত যোগ্যতাও নাকি আমার থাকবে না।
এরপর ভাইয়ার আর বাবা-মায়ের কথার কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করার আশাটা ছেড়ে দিলাম। ভর্তি হলাম মেডিকেলের কোচিংয়ে। তখনও পড়াশোনায় মন ছিল না একটুও।
যতবারই ভেবেছি একটু সিরিয়াসলি পড়ালেখাটা দরকার, বই খুলে বসার পরই সেই চিন্তাটা মাথা থেকে উবে যেত। কারণ পড়াশোনার এতই দুরবস্থা ছিল যে বইখাতা খুললে সবকিছু ভীষণ অপরিচিত মনে হতো, মনে হতো ইন্টারের দুবছর আমি কিছুই করিনি তাই সমস্ত পড়াশোনা যেন পাহাড়সম মনে হচ্ছে।
এর মধ্যে দিল এইচএসসির রেজাল্ট, তখন সকলের কথার সত্যতা বুঝতে পারলাম, কোন ইঞ্জিনিয়ারিং এ আবেদন করতে পারলাম না। আবেদন করলাম কেবল মেডিকেল, ঢাবি আর জাবিতে।
ঢাবি আর জাবিতে পরীক্ষা দিয়ে তবুও মনে একটা সুক্ষ আশা ছিল, কিন্তু ফলাফল দিতেই সে আশাও মন থেকে দূর হয়ে গেল। রেজাল্ট ফেইল আসে। এক তো প্রিপারেশন খারাপ, তার মধ্যে জিপিএ কম হওয়ায় প্রচুর মার্কস কাটা গেল, ততদিনে আমার বোঝা হয়ে গেছিল কোন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়তে পারবো না।
ইন্টারের দুবছর পড়াশোনা থেকে এত দূরে সরে ছিলাম যে চান্স পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজে আবেদন করেছিলাম।
কোন সরকারীতে না আসার পর রাগে, দুঃখে আর অপমানে বাবা-মা বলেছিল প্রাইভেটে আমাকে পড়াবে না। প্রথমে না করলেও পরে ওরা নিজেরাই রাজি হয়েছিল প্রাইভেটে পড়ানোর জন্য।
কিন্তু আমি আর তাতে রাজি হইনি, স্বেচ্ছায় সাত কলেজে পরীক্ষা দিয়ে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভর্তি হই। আজ বুঝতে পারি জীবনে সফলতা অর্জনের অন্যতম উপযুক্ত সময় বোধ হয় এই ইন্টারমিডিয়েটের দুবছর।
সেই কঠিন পরিশ্রমের সময়টা আমি কাটিয়েছি চরম অবহেলায়, আজ তার ফলও বুঝতে পারছি। এসএসসি পর্যন্ত যতটা ভাল ফলাফল করে এসেছি সেগুলো জীবনে কোন কাজে আসলো না, এমনকি এতদিন ভাল ছাত্র হওয়ার জন্য যে সুনাম ছিল নিমেষেই তা ধুয়ে মুছে গেল।
সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর নিজের জীবনের পরিণতি দেখে প্রচন্ড হতাশায় পড়ে যাই আমি, কি চেয়েছিলাম জীবনে আর কি হয়ে গেল! যতই এটা থেকে মুভ অন করার চেষ্টা করি না কেন এখন যে আর সেই সময়টাই নেই।
কোন আত্মীয় বা পরিচিতের কাছে আমি কোথায় চান্স পেয়েছি বা কোথায় পড়ি সেটা বলতে গিয়ে আমার বাবা মায়ের বুকটা ফেটে যায়। আমার সাথের সব বন্ধু বান্ধবেরা আজ কোন না কোন নামকরা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ওদের কাছে উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছি।
সবার থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি, যোগাযোগ রাখিনি কারো সাথে শুধু এই প্রশ্নের ভয়ে যে আমি কোথায় চান্স পেয়েছি। সময়ের কাজ সময়ে না করার পরিণতি বোধ হয় এমনই হয়। মাঝে মাঝে ভাবি এই ব্যর্থ জীবন রেখে কি-ই বা লাভ!
তবুও এখন এটা ভেবেই নিজেকে শান্তনা দিই যে চেষ্টা আর পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না, এখন যেই অবস্থানে আছি সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু আমি করবো ইনশাআল্লাহ।
[নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। আপনার গল্পটি লিখে দিতে পারেন আমাদের গ্রুপে]