বলতে গেলে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফল শাব্বির আহসান। বয়স পঞ্চাশের কোঠা ছুঁই ছুঁই করলেও তাতে প্রাণচাঞ্চল্যের কোনো কমতি নেই। মনেপ্রাণে যা চেয়েছেন, পেয়েছেন তার সবই বলে মনে করেন তিনি।
তবে অষ্টম শ্রেণীতে চূড়ান্ত পরীক্ষায় ৩ সাবজেক্টে অকৃতকার্য হওয়া শাব্বিরকে এ জন্য করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার অযোগ্য ঘোষিত হয়েও নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আর অধ্যবসয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
এইচএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডের সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম হয়ে প্রমাণ করেছেন নিজেকে।
এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমিতে (বিএমএ) সফল প্রশিক্ষণ শেষে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে।
সেখানে চাকরিরত অবস্থায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি শেষ করেন শাব্বির আহসান।
সেনাবাহিনীতে থেকে অবসর নেয়ার পর বর্তমানে বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রজেক্টে অপারেশন অ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
এক সাক্ষাতকারে শাব্বির জানিয়েছেন তার জীবন গল্পের কথা। যে গল্পের পরতে পরতে আছে অসংখ্য রাতের কান্না, ত্যাগ আর পরিশ্রম।
যে গল্পে আছে তরুণ প্রজন্মের জন্য অালোকিত পথের দিশা।
শাব্বির ছিলেন এম শরাফাত হোসেন এবং ফেরদৌস আরা দম্পতির বড় সন্তান। বাবা শরাফাত হোসেন ছিলেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম ব্যাচের ছাত্র।
আর মা ফেরদৌস আরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। সিরাজগঞ্জে নানার বাড়িতে জন্ম হলেও শাব্বিরের দুরন্ত শৈশব কেটেছে রাজধানী ঢাকাতেই।
অবাক হলেও শাব্বিরের শিক্ষাজীবনের শুরু শহীদ অনোয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ক্লাসে ৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে শাব্বিরসহ মাত্র ৩ জন ছিলেন ছেলে। বাকিরা মেয়ে।
শিশু শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়েছেন তিনি। এ জন্য স্কুলের নাম নিয়ে এখনো বিড়াম্বনায় পড়তে হয় তাকে। বন্ধুরা এখনো মজা মজা করে তাকে বলেন, ‘আরে তুইতো গার্লস স্কুলে পড়তি।’
বাবা-মা চাইতেন শাব্বির ক্যাডেট কলেজে পড়ুক। তাই বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে পরীক্ষা দেন ক্যাডেটে। পরীক্ষায় সফল হয়ে পড়ার সুযোগ পান ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে।
কিন্তু এরপরই বিপর্যয় নেমে আসে তার জীবনে। বাবা-মায়ের আদর ও প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা শাব্বির কোনভাবেই খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনে। ক্লাসের ৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে শাব্বির ছিলেন সবচেয়ে ছোট।
১২ বছর বয়সে মা-বাবাকে ছেড়ে ক্যাডেট কলেজের নিয়মতান্ত্রিক জীবন, শাস্তি, সিনিয়রদের চোখ রাঙানি প্রতিমুহুর্তেই হাপিয়ে উঠছিলো ছোট্ট কিশোরটি। এজন্য নি:শব্দে বহুদিন তাকে ফেলতে হয়েছে চোখের জল।
এক পর্যায়ে পড়াশুনায় মন বসাতে না পেরে অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে ওঠার সময় ফেল করে বসেন ইংরেজি, অংক ও বিজ্ঞানে। এ তিন বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে তার নম্বর ছিল অংকে ১২, বিজ্ঞানে ১৭ ও ইংরেজিতে ২৩।
এমন ফলাফলে কলেজের শিক্ষক, সহপাঠি আর সিনিয়রদের কাছ থেকে ভর্ৎসনার শিকার হন। সেই ঘটনার পর অনেকদিন তাকে নীরবে কাঁদতে হয়েছে তাকে। ওইদিনের কথা মনে হলে এখনো বিমর্ষ হয়ে পড়েন শাব্বির আহসান।
ওই ফলাফলের পর ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার অযোগ্য ঘোষণা করেন। তবে হাল ছাড়ে না দিয়ে কিশোর শাব্বির ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে গিয়ে প্রতিদিন কান্নাকাটি করতে থাকেন।
এক পর্যায়ে শাব্বিরের কান্নায় মন গলে কলেজ কর্তৃপক্ষের। এসএসসি-এইচএসসিতে অন্তত প্রথম বিভাগ পাবেন এ ধরণের একটি লিখিত মুচলেকা দিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ পান।
তারপর থেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়, উৎসব, সমাজ সবকিছু ভুলে ডুব দেন পড়াশোনায়। এমনকি ঈদের দিনও নামাজ পড়ার সময় ছাড়া বাইরে বের হননি তিনি।
এমন আচরণে বাবা-মা ভেবেছিলেন তাদের আদরের ছেলেটি হয়তো পাগল হতে বসেছে। কিন্তু শাব্বিরের মনে তখন শুধু প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা। সবার ঠাট্টা-টিটকারির প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে।
প্রতিশোধটা নিয়েছিলেনও একরোখা মেধাবী শাব্বির। এসএসসিতে যশোর বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় হন অষ্টম। আর এইচএসসিতে দেড় লাখ পরিক্ষার্থীর মধ্যে সম্মিলিত মেধাতালিকায় অর্জন করেন প্রথম স্থান।
তখন টেলিভিশন, খবরের কাগজ সবকিছুতেই তারই জয়জয়কার। এমন ফলাফলে দীর্ঘদিন ধরে ঠাট্টা করে যাওয়া মানুষগুলোর মুখে যেনো তালা লেগে যায়।
১৯৮৬ এইচএসি পাশের পর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। সেখানেও রাখেন সফলতার স্বাক্ষর। সেনাবাহিনীতে চাকরির সময়েই বুয়েটের ’৯১ ব্যাচের সঙ্গে করেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি।
পরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর কোর্স করতে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয় মেধাবী এ সেনা কর্মকর্তাকে। সেখানেও ১২টি দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে শান্তি মিশনে বিভিন্ন দেশে গিয়েও শাব্বির রেখেছেন দেশের জন্য নানামুখী অবদান।
মিশনে প্রতিদিনই ছোট ছোট করে লিখে রাখতেন তার অভিজ্ঞতার গল্পগুলো। পরবর্তীতে সেই লেখা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয় ‘দ্যা পিসকিপার এ নভেল’ নামে।
গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও সম্মানসূচক চিঠি পেযেছেন শাব্বির। ১৯৮৬ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পায় বাগেরহাটের এক নারীর একসাথে ৭ সন্তান প্রসবের সংবাদ।
যেখানে বাংলাদেশ নামের পাশে ব্রাকেটে (ইস্ট পাকিস্তান) লেখা ছিল। বিষয়টি দেখে সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি লেখেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষের নিকট।
পরবর্তীতে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লেখা হয় শাব্বিরের কাছে।
বর্ণিল জীবনের অধিকারী এ কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০১১ সালে।
সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন থাকার সময় ১৯৯৪ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফাহীমা রুশদীর সঙ্গে। এই দম্পতির এ লেভেল পড়ুয়া একমাত্র কন্যার নাম ফাইজা তানাজ আহসান।
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে শাব্বির বলেন: আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের ভেতর লুকিয়ে আছে অপার সম্ভাবনা। তাদের ভেতরে যে শক্তিটা লুকিয়ে আছে সে সম্পর্কে তারা অবগত নন।
যেহেতু নিজেদের সম্পর্কে তারা খুব একটা বেশি জানেন না। তাই তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়না। আর সে কারণেই তারা ডুবে থাকে হতাশায়।
বর্তমানে ছেলে-মেয়েরা শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য, চাকরির জন্য পড়াশুনা করে উল্লেখ করে তিনি বলেন: এই অবস্থান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
পরিবর্তন করতে হবে ভাবনার। নিজেদেরকে কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। নিজের চাওয়ার বিষয়ে অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে।
তবেই বাংলাদেশ থেকে তৈরি হবে গুগল, মাইক্রোসফটের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নির্মাতা।
শাব্বির বিশ্বাস করেন মেধা নয় পরিশ্রমই বদলে দিতে পারে সবকিছু।
– আফরিন আপ্পি ১ নভেম্বর, ২০১৭
আরো লেখা পড়ুনঃ
- যশোর বোর্ডে প্রথম হওয়ার গল্প – শাব্বির আহসান
- লাইফ লেসন ফ্রম অ্যা ফিফটি ইয়ারস ওল্ড
- হতে চাইলে Harvard’ian
- Ultimate Excel Treasure- Shabbir Ahsan
- How to improve English Writting
- How to write a RESUME
- Failure in Admission test? Then CA, CFA, CMA, MCIPS, FCS, IBA waiting for you