প্রকৌশলী পুলক কান্তি বডুয়া:

১০মার্চ ২০০২ সালের ছোট্ট একটি ঘটনা। তৎকালীন বিআইটিসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়।

দেশের প্রত্যেক বিভাগে ইতোপূর্বে স্থাপিত বিভাগীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসমূহ ১৯৮০ সালের অর্ডিনেন্স পরিবর্তন করে বিভাগীয় নামে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী বিআইটি করা হয়।

পূনরায় ২০০২ সালে বিআইটিসমূহ পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সময় সকল বিভাগীয় নাম বহাল রেখে যথাক্রমে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশববিদ্যালয় করা হয়।

কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটিয়ে নাম করণ করা হয় গাজীপুর প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশববিদ্যালয়।

হটাৎ করে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের একমাত্র উচ্চ শিক্ষার সরকারি এই শিক্ষালয়ের নাম পরিবর্তন বিশেষত ঢাকা নামটি বাদ দিয়ে মূলত এই প্রতিষ্ঠানটিকে অন্যসব প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয়।

একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। একটি জেলা পর্যায়ের বিশববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি দান করা হয়।

যা  ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়। এর পেছনে কাজ করেন তৎকালীন গাজীপুরের একমাত্র সরকার দলীয় এমপি কালীগঞ্জের ফজলুল হক মিলন।

সস্তা স্থানীয় জনপ্রিয়তা লাভের আশায় তিনি এ কাজ করেন।

এজন্য তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুককে প্রভাবিত করে সংসদে গাজীপুর প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে অর্ডিনেন্স পাস করানো হয়েছিল।

ডুয়েট আন্দোলন

কালজয়ী ছাত্রনেতৃত্ব ও মাহকাব্যিক ডুয়েট আন্দোলন ম্যাগাজিন

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা নামটি না থাকায় এর অতীত ইতিহাস হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

বিশেষত ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিআইটি ঢাকা- এর সাথে সম্পূর্ণ বেমানান গাজীপুর প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি দাঁড়ায় এ প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদেশে ঢাকা নামটির যে আন্তর্জাতিক পরিচিতি রয়েছে- তা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

এছাড়াও সংক্ষেপে এই বিশববিদ্যালয়ের নাম হবে গুয়েট যা চুয়েট, রুয়েট, কুয়েট, বুয়েট নামের পাশে বেমানান হয়ে দাঁড়ায়।

এমন প্রেক্ষাপটে ২০০২ সালের শেষ দিকে বর্তমান ডুয়েট এর নামকরণ ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর করার জন্য আন্দোলন শুরু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সংশোধন জাতীয় সংসদে আনার দাবিতে এর ছাত্র শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলে মিলে একটি অস্তিত্বের আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলনের প্লাটফরমের নাম হয় ডুয়েট বাস্তবায়ন পরিষদ।

সব রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন দলমত নির্বিশেষে একটি আন্দোলন একটি দাবি নামকরণ পরিবর্তন। একটি চেইন অব কমান্ডের আওতায় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসম দাবি আদায়ের সংগ্রাম।

কেননা দাবিটির সমর্থনে জাতীয় সংসদের সংশোধনী প্রস্তাব আনতে হবে। সংখ্যা গরিষ্ঠের ভোটে জিততে হবে।

কিন্তু সরকার দলীয় এমপি ও শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে হওয়ায় বিষয়টি এক প্রকার দুঃসাধ্য কাজ ছিল। সব রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সম্বনয়কারী।

সাধারণ সম্পাদকদের অর্থ সচিব ও পুলক কান্তি বডুয়াকে প্রধান সমন্বিয়কারী করে ডুয়েট বাস্তবায়ন পরিষদের মুল স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়।

এই কমিটি আন্দোলনের প্রধান কৌশল হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে বেঁছে নেয়।

কেননা অসম ও অসম্ভব একটি দাবি আদায়ে রাজশক্তির মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল হাতিয়ার।

পর্যায় করমে গঠিত হলো মুক্তিযুদ্ধের আদলে সেক্টর কমান্ডারের মতো এ ফোর্স, এসফোর্স, ওয়াই ফোর্স, জেড ফোর্স, মুজিব বাহিনীর আদলে মৃত্যুঞ্জয়ী ফোর্স।

এরা মুজিবনগর সরকারের মতো কুটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী ব্যক্তি বর্গকে দাবির স্বপক্ষে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে ঐক্যমতে আনার চেষ্টা চালান।

সংসদীয় জনমত গড়ে তুলে, মৃত্যুঞ্জয়ী স্কোয়াড ৩ মাসব্যপী আন্দোলনে সব ছাত্র-ছাত্রীকে কম্পাসে ধরে রাখা ও শৃংখলা বজায় রাখা ছিল মূল কাজ।

আন্দোলনকে দিন কে দিন বেগবান ও নিত্যনতুন কৌশল এর অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মতো ছাত্রী বৃগেড, স্বাধীন বাংলা বেতারের মতো সাংস্কৃতিক স্কোয়াড, ডুয়েট ফুটবল টিম, ডুয়েট আর্কাইভ, ধূমপানও তামাক মুক্ত ক্যাম্পাস আন্দোলন, ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইকেল র‌্যালি প্রচারণা, ঢাকা মেডিক্যালের সন্ধানীকে ১০২০ জন আন্দোলনকারী প্রত্যেকেই এক ব্যাগ রক্ত দান, প্রধানমন্ত্রী বরাবর ১০২০ জন আন্দোলনকারী প্রত্যেকেই একটি করে পত্র লিখন ও একই দিনে তা প্রেরণ, বৃক্ষরোপন, ১০২০ ফুট দীর্ঘ ব্যানার বানিয়ে ১০২০ জন আন্দোলনকারী প্রত্যেকেই সেখানে নিজ দাবির কথা লিখেছেন।

এসবের পাশাপাশি বিতর্ক, ভাষা শিক্ষা কর্মশালা, নাটক, গান, আবৃত্তি চলেছে আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে। ফলে পুরো আন্দোলনটি হয়ে উঠে সৃষ্টি শীলতার এক অনুপম কাব্য।

গঠনমূলক ছাত্র আন্দোলন। সরকার ও পেটোয়া বাহিনী কোনো ছুতাই খুঁজে পাননি আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবার। স্বাধীনতার পর এই বিচিত্র উপায়ে দাবি আদায়ের সংগ্রাম আর কেউ দেখেনি।

ফলে খুব দ্রুত আমরা মিডিয়া কভারেজ পাই, তৎকালীন জনপ্রিয় মাসিক যায়যায় দিন, সাপ্তাহিক-২০০০ পত্রিকায় এই সমস্ত কার্য কলাপের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দেশে-বিদেশে সারা পরে যায়। সরকারের টনক নড়ে।

শিক্ষামন্ত্রী আলোচনার টেবিলে ডুয়েট বাস্তবায়ন পরিষদকে ডাকেন। শেষ কৌশল হিসেবে সরকার বলে যে, ঠিকাছে সংশোধনী প্রস্তাব সংসদে তোলার সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু যদি এতে হেরে যাও মেনে নিতে হবে।

কারণ এটা আর সরকারের একক এখতিয়ারে নাই। আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ আমাদের কূটনৈতিক গ্রুপগুলো ততদিনে সবদলের সিংহভাগ এমপিদের বুঝাতে সক্ষম হন ঢাকা নামের গুরুত্ব।

এবং আমাদের ন্যায্য অধিকার। যথারীতি-২০০৩ সালের ১৪ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় সংশোধনী প্রস্তাব উঠলে এর বিপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন গাজীপুর-৫ আসনের এমপি ফজলুল হক মিলন।

তিনি এই সংশোধনী পাস না করার জন্যে সংসদ সদস্যদের প্রতি আহবান জানান। শেষমেশ স্পিকার বিষয়টি ভোটাভুটিতে দিলে ১৮০-২ ভোটে ডুয়েট নামকরণ সংশোধনীটি জয়লাভ করে।

বাংলাদেশের ও বহিঃবিশ্বের ইতিহাসে একটি ক্যাম্পাসের সাধারণ মানের ছাত্ররা টানা ৩ মাসের নান্দনিক ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে সংসদ সদস্য না হয়েও জাতীয় সংসদে বিজয়ের নজির দ্বিতীয়টি আর নেই।

এই দীর্ঘ সময় সব ছাত্র-ছাত্রীকে আন্দোলনে ধরে রাখা, রাজনৈতিক দল ছাড়া একক নেতৃত্বের শৃঙ্খলায় আটকে রাখা, প্রতি নেতৃত্ব রুখে দেয়া, মনোবল ধরে রাখা, গাজীপুরের লোকাল জনগণকে কৌশলে চুপ রাখা, নানা হুমকি, ভয়, ভীতি মোকাবিলা করা ছিল এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের সবচেয়ে বড় চ্যলেঞ্জ।

সেই চ্যলেঞ্জে সেইদিন আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। ফলে আজকের এই ডুয়েট ডে।

আমরা সেদিন ইতিহাসের মহেন্দ্রক্ষণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান বাঁচাতে পেরেছিলাম। আমরা আমাদের দায়িত্ব সেদিন পালন করেছিলাম। প্রিয় বন্ধুরা, এবার তোমাদের পালা।

প্রতি নিয়ত তোমাদের দায় প্রমাণ করতে হবে শুধু নামে নয়, এর প্রত্যেকটি প্রোডাক্ট সত্যিকারের গর্বিত ডুয়েটিয়ান। দেশ জাতি মহাজগতের মানুষের সভ্যতার, ক্ষুদা মুক্তির পথ সৃস্টির সবাই মহানায়ক। পূর্ব পূরুষ স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।

সার্বভৌম ভূখণ্ড দিয়েছে। এবার তার প্রতিদান দেবো প্রকৌশল সেবাকে দেশব্যপী ছড়িয়ে দিয়ে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এর প্রত্যেকটি কাজের নাম হোক জয়বাংলা।

আমরা প্রত্যেকেই হয়ে উঠি বঙ্গবন্ধু। আর নয় স্লোগান, আর নয় ইতিহাস। এসো বর্তমান রচনাকরি আগামী ভবিষতের ইতিহাস হই!

আমি আজ আমার সেদিনের সকল সহযোদ্ধা, কর্মকর্তা কর্মচারী শিক্ষকবৃন্দের ত্যাগ-সংগ্রাম অকুন্ঠ চিত্ত্বে স্মরণ করি।

ডুয়েট ডে-২০১৫ ১লা সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। লেখক: প্রধান সম্বনয়কারী, ডুয়েট বাস্তবায়ন পরিষদ-২০০৩