ঢাকা থেকে ৪টা ছেলে আর ৪টা মেয়ে এসেছিলো হামহাম ঘুরতে। এদের মধ্যে পুরান ঢাকার একটা মেয়ে ছিলো।
যারা হামহাম জলপ্রপাতে গেছেন বা এ সম্পর্কে জানেন —তারা নিশ্চয়ই এটাও জানেন যে, হামহাম যেতে অনেকগুলো পাহাড়-জংগলসহ দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়।
যাই হোক, যাত্রা শুরুর আগেই পুরান ঢাকার মেয়েটা গাইডকে চুপিসারে বলে: “আমার সাথের ওরা আমার বন্ধু ঠিকই, কিন্তু আমাকে ওরা ভুলভাল বুঝ দিয়ে নিয়ে এসেছে।
ওদের নিয়্যত ভালো না। আমি আগে বুঝিনি! কিন্তু এখানে আসার পরে ওদের আচরণ পাল্টে গেছে। ওরা ছেলেমেয়ে সবগুলোরই মতলব খারাপ! আপনি প্লিজ আমাকে হেল্প কইরেন।”
গাইড দেখলো মেয়েটা খুবই ভয় পাচ্ছে।
তাই সে মেয়েটাকে অভয় দিয়ে বললো, “কিছু হবে না। আমি আছি। দেখি, আপনার উপর কে হাত দেয়!”
গাইডের ভাষ্যমতে, “আমি জীবনে কখনো কাউকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সাথে করে দা নিই না। কারণ, লোকজন দা দেখলে ভয় পেয়ে যায়।
ভাবে, বনের ভিতর নিয়ে গিয়ে ওদেরকেই আক্রমণ করবো আমি। কিন্তু সেদিন আমি দা নিলাম বাধ্য হয়েই। ওদেরকে বললাম, রাস্তায় ঝোপ-জংগল আর বাঁশ কাটার জন্য দা লাগবে।”
অনেকক্ষণ হাঁটার পরে ছেলেমেয়েগুলো একটু অদ্ভুত আচরণ করা শুরু করলো। একটু পরপর এরা মুল রাস্তা ছেড়ে আশেপাশের জংগলে চলে যেতে চায়।
বলে, “একটু এদিকে গিয়ে দেখি না কি আছে! বেশিদুর যাবো না!”, “আরে! ওদিকে তো রাস্তা আছে একটা। গিয়েই দেখি কি আছে ওদিকে!”
গাইড প্রতিবারই তাদেরকে নিরস্ত করে এই বলে যে, “আপনারা হামহাম যাওয়ার জন্য এসেছেন, ওদিকে যাবেন কেন? আমার সাথে চলেন। ট্র্যাক ছেড়ে যাবেন না।”
এক পর্যায়ে ঐ উশৃঙ্খল ছেলেমেয়েরা গাইডের কথাকে তোয়াক্কা না করে বলে, “আপনি এখানে দাঁড়ান। আমরা ওদিক থেকে ঘুরে আসছি একটু।”
ওরা ৭জন (৪ছেলে, ৩ মেয়ে) একসাথেই রাস্তা ছেড়ে যাওয়া শুরু করে আর অন্য মেয়েটাকেও তাদের সাথে যাওয়ার জন্য ডাকে।
মেয়েটা যেতে না চাওয়ায় ওরা তাকে টেনে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। মেয়েটা তখন গাইডের পিছনে আশ্রয় নেয়।
গাইডের ভাষায় গাইড “আমি তখন মেয়েটিকে আমার পিছনে আগলে রেখে রেগে গিয়ে হাতের দা দেখিয়ে ওদেরকে হুংকার বলি, আপনারা উনাকে নেয়ার জন্য এক পা এগোলে আমি আপনাদের সবাইকে এক নাগাড়ে কোপাবো।
আপনারা কোথায় যাবেন, যান। উনাকে টানবেন না।”
সিলেটি কাঁচা ভাষায় আমাদেরকে বললো “হখল্টিরে এখলগে ফালাইয়া ছেদাইলিলাম নে…..”
এরপর ছেলেমেয়েগুলো ভয় পেয়ে আর এগোয়নি।
গাইড বললো, “আমি মেয়েটাকে নিয়ে মাঝ রাস্তা থেকেই ফিরে আসলাম। মেয়েটা ভয়ে কাঁপছিলো।
আমি মেয়েটাকে কোনো একটা হোটেলে উঠে রেস্ট নিতে বললাম। কিন্তু সে এতোটাই ভয় পেয়েছিলো যে, রাজি হচ্ছিলো না। পরে তাকে আমার বাসায় নিয়ে আসি।
আমার স্ত্রী তাকে খেতে দেয়। আমার বাসায় কিছুক্ষণ রেস্ট নেবার পর মেয়েটিকে নিয়ে বের হই।”
এভাবেই মেয়েটিকে বিদায় দেবার ব্যাপারে গাইড বললো: “তাকে সিএনজিতে তুলে দেয়ার পরেও সে একা যেতে ভয় পাচ্ছিলো। তাই আমি সিএনজিতেও তার পাশে ছিলাম।
মেয়েটা কান্না করছিলো অনেক। তাকে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাসে তুলে দেই আমি। তারপর তার মোবাইল নাম্বার নিয়ে বলি, ঢাকায় গিয়ে আমাকে যাতে ফোন দেয়। মেয়েটা খুবই খুশি হয়েছিলো।
ঢাকায় গিয়ে আমাকে ফোন দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছে অনেকবার।”
হামহাম ঘুরতে গিয়ে গাইডের মুখে ঘটনাটা শুনে খুব ভালো লেগেছে।
যারা মনে করেন, “পুরুষ মানেই রেপিস্ট/পটেনশিয়াল রেপিস্ট” ; যারা ভাবেন, “পৃথিবীতে পুরুষ না থাকলেই ভালো হতো, তাদের জন্যই পোস্টটা করা”।
সব পুরুষ ধর্ষক হয় না, অনেক পুরুষ রক্ষকও হয়।
শুধু ভার্সিটিতে পড়ে পাতার পর পাতা মুখস্থ করলেই নৈতিকতা শিখা যায় না। অনেক সময় অজপাড়াগাঁয়ে বাস করা লেখাপড়া না জানা ব্যক্তিটাও নৈতিকতায় তথাকথিত শিক্ষিতদের ছাড়িয়ে যেতে পারে।
(ছবিতে আমাদের সাথে গাইডকে দেখা যাচ্ছে। লোকটার নাম আছদ্দর। আল্লাহ উনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমীন।)
লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম