যদি আপনাকে বলা হয় অক্সফোর্ড,ক্যামব্রিজ বা ক্যালটেকের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ টাকার চাকরি ছেঁড়ে এসে বাংলাদেশে শিক্ষকতা করতে , আপনি করবেন কি? ইংল্যান্ড, আমেরিকার লাখ টাকার চাকরি ছেঁড়ে ২৮০০ টাকার চাকরি করার সাহস আছে কি আপনার । তাও আবার যদি হয় আপনার প্রিয় বিষয় তত্ত্বীয় পদার্থ,গনিত,সৃষ্টিতত্ত্বের শিক্ষকতা ছেঁড়ে এমন এক জায়গায় শিক্ষকতা করা যেখানে মৌলিক গবেষণার নূন্যতম সুযোগ নেই !

আমার মনে হয় এমন বুকের পাঁঠা এ দেশে খুব কম লোকের আছে । সবাই তো আর শ্রদ্ধেয় স্যার জামাল নজরুল ইসলাম না ! জি, যারা এই তিন লাইন পরে বুঝে গেছেন তারা ঠিকই ধরেছেন আমি অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কথা বলছি । বাংলাদেশে রিলিফের টিন চোর,বিদ্যুতের খাম্বা চোর বা সুন্দরবন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া দুর্নীতিবাজ,ভণ্ড ও ধূর্ত রাজনীতিবিদদের জন্য পথে পথে প্যনা-ব্যনার স্থাপন করা হলেও যুগে যুগে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কথা কেউ মনে রাখে না ।

১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত “দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স” বইটি এখনও অক্সফোর্ড,ক্যামব্রিজ,স্ট্যানফোর্ড,এমআইটি,ক্যালটেকের মত বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্বীকৃত পাঠ্যবই হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে ব্যাবহার হয়ে আসছে ।

স্টিফেন হকিংয়ের “A Brief History of Time” বইটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হলেও মহাবিশ্বের অন্তিম পরিনতি নিয়ে সেই বইটি বিজ্ঞানী মহলে হইচই ফেলে দিয়েছিল ।

বইটি স্টিফেন হকিং, অ্যালেন গুথ, আব্দুস সালাম, লরেন্স ক্রাউসের মতো দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত এবং এখনো তারা বইটি পড়ার জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। সেই সময়ে বিজ্ঞানীমহলে বইটি এতটা হইচই ফেলে দিয়েছিল যে তা জাপানি, ফরাসি,জার্মান,পর্তুগিজ,সার্ব, ক্রোয়েট ও যুগোশ্লাভ ভাষায় অনূদিত হয় । এই বইটির লেখক ছিলেন বাংলাদেশের কৃতি সন্তান শ্রদ্ধেয় জামাল নজরুল স্যার ! যিনি ক্যামব্রিজের খোদ স্টিফেন হকিংয়ের রুমমেট ছিলেন !

পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে তার বন্ধু তালিকায় যুক্ত হয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন, আব্দুস সালাম এবং রিচার্ড ফাইনমেন এর মত বিজ্ঞানীরা। ফাইনমেন তাকে তার নিজের বাড়িতে দাওয়াত করেও খাইয়েছিলেন, বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে উপহার দিয়েছিলেন একটা মেক্সিকান নকশিকাঁথাও।অবশ্য কার সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল আর না ছিল সেটা তাকে পরিচিত করেছে ভাবলে ভুল হবে।

তিনি পরিচিত ছিলেন নিজের যোগ্যতাবলেই। কিন্তু হায়রে বাঙালি আর হায়রে বাংলাদেশ ! তার জগৎজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন সেই বইয়ের কোন বাংলা অনুবাদ আজ ৩৫ বছর পরেও বের হয় নি !

জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে পদার্থবিদ,গণিতবিদ,জ্যোতির্বিদ,সৃষ্টিতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ তার বাবা তৎকালীন ব্রিটিশ আমলের সেই শহরের মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজের সমতুল্য) ছিলেন।

বংশগত দিক থেকে ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান, তৎকালে ঢাকার নবাব বাড়ির পাশাপাশি যোগাযোগ ছিল জর্ডানের বাদশার পরিবারের সাথে। তবে বংশ হিসেবে অভিজাত হলেও ছিল না অভিজাত্যের অহংকার।

তার বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখনই তার বাবা কলকাতায় বদলি হন।জামাল নজরুল প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। এই স্কুল থেকে পরবর্তীতে শিশু বিদ্যাপীঠে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠেই পড়েন। এরপর দেশ ভাগ হলে তিনি পরিবারের বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চলে আসেন ও পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন।

তবে এখানে একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় তিনি চমৎকার কৃতিত্ব দেখান। ফলে “ডাবল প্রমোশন” পেয়ে সরাসরি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন।এখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে চলে যান পাকিস্তানের লরেন্স কলেজে। নবম শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়াশোনা করেন। এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার অন্যরকম ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। অনেক অতিরিক্ত জ্যামিতি সমাধান করতে থাকেন। নবম শ্রেণীতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে।

এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র ক্যামব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। সে সময় সিনিয়র ক্যামব্রিজ বলতে বর্তমানের ও লেভেল এবং হায়ার সিনিয়র ক্যামব্রিজ বলতে বর্তমানের এ লেভেল বোঝাতো। এ সময় নিজে নিজে অনেক অঙ্ক কষতেন। বিভিন্ন বই থেকে সমস্যা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন যা পরবর্তীতে তার অনেক কাজে আসে।

উল্লেখ্য, হায়ার সিনিয়র ক্যামব্রিজে তিনি একাই কেবল গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই গণিতের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান।

এখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন। এই কলেজের একজন শিক্ষককে তিনি নিজের প্রিয় শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই শিক্ষকের নাম “ফাদার গোরে”। গণিতের জটিল বিষয়গুলো খুব সহজে বুঝিয়ে দিতেন বলেই জে এন ইসলাম তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। গোরে তার কাছে গণিতের বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতেন, ইসলাম আগ্রহভরে তা শেয়ার করতেন। গোরের সাথে ইসলামের এই সম্পর্কের কারণ বলতে গিয়ে ইসলাম বলেন,”গণিতকে এমনিতেই অনেকে ভয় পেত।

কিন্তু এটির প্রতিই ছিল আমার অসীম আগ্রহ, ঝোঁক। এ কারণেই বোধহয় তিনি আমাকে পছন্দ করতেন।” এরপর ১৯৫৯ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে দ্বিতীয়বারের মত স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়-এর অ্যাপ্লায়েড ম্যাথম্যাটিক্স অ্যান্ড থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স বিভাগ থেকে । স্টিফেন হকিংয়ের পাশাপাশি তার বন্ধুত্ব ছিল ভারতীয় গণিতবিদ নারলিকার সাথে।আরেকজন সহপাঠী ছিলেন ব্রায়ান জোসেফসন, যিনি তার পিএইচ ডি থিসিসের জন্য মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, ১৯৭৩ সালে, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

তিন বছরের কোর্স, উনি সেটা দুই বছরেই শেষ করে ফেলেন। এর পরে একই বিভাগ থেকেই ১৯৬৪ সালে অর্জন করেন “ডক্টর অফ ফিলোসোফি” বা পিএইচডি । সাধারণতঃ একাডেমিক লাইনে থাকলে পিএচডি করাই যথেষ্ট, এর বেশি কিছু করার দরকার পড়ে না। পড়ে না যদি না তিনি জামাল নজরুল ইসলামের মতো কেউ না হন।

পিএইচডি শেষ করে তিনি দুবছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড-এ কাজ করেন। মাঝে কাজ করেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্বখ্যাত ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবেও। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন।

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন।১৯৭৮ সালে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালে অর্জন করেন ডিএসসি বা ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রী, যেই ডিগ্রী সারা পৃথিবীতেই খুব কম সংখ্যক বিজ্ঞানী অর্জন করতে পেরেছেন। অবশ্য কৃতবিদ্য এই অধ্যাপকের একাডেমিক অঙ্গনে সাফল্যের ব্যাপারটা ধরা পড়েছিল অনেক আগেই।

বিদশের মাটিতে লেখাপড়া ও গবেষণা করেছেন ঠিকই, উন্নত সুযোগ সুবিধাও পেয়েছেন, কিন্তু তার স্থায়ীভাবে বিদেশে থেকে যাবার ইচ্ছে ছিল না কখনোই। তাই ১৯৮৪ সালে তিনি একটা বড় সিদ্ধান্ত নিলেন। জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তগুলোর একটি। বিলেত আমেরিকার লক্ষ টাকা বেতনের লোভনীয় চাকরি, গবেষণার অফুরন্ত সুযোগ, আর নিশ্চিত নিপাট জীবন সব ছেড়ে ছুড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিধ্যালয়ে তিন হাজার টাকার প্রফেসর পদে এসে যোগ দিলেন।

কিন্তু তারপরেও পাশ্চাত্য চাকচিক্য আর ডলার-পাউণ্ডের মোহকে হেলায় সরিয়ে দিয়ে অধ্যাপক নজরুল বিলেতের বাড়ি ঘর জায়গা জমি বেঁচে চলে আসলেন বাংলাদেশে। দেশটাকে বড়ই ভালবাসতেন তিনি। তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিল না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এটার ভিন্নতা ঘটে নি কখনোই।

আরেকটা দিক হল, বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থান সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব না’। তার দেশপ্রেমের নিদর্শন ১৯৭১ সালেও তিনি দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নির্বিচারে হত্যা খুন ধর্ষণে মত্ত হয়েছিল, তখন পাক-বাহিনীর এই আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠিও লিখেছিলেন।

দেশে ফেরত এসে তার অবস্থা খুব একটা সুখকর ছিল না । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পরিচিত জনেরা অধ্যাপনার সুযোগ করে দিতে চাইলেও তিনি তার পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামে ফেরত যেতে চাইলেন ।

যেই কথা সেই কাজ। তার আরেক গুনি বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানালেন দেশের এই অমূল্য রত্নকে ধরে রাখতে হলে চবিতে বিশেষ ক্ষমতাবলে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একটি অদ্ধাপকের পদ সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক । তবে প্রথমে তা সম্ভব না হলেও গনিতের একটি অধ্যাপকের পদ জামাল নজরুল স্যারকে অফার করা হয়। তবে প্রথম দিকে এমনকি তিনহাজার টাকা বেতন দিতেও গড়িমসি করেছিল। তারা বেতন সাব্যস্ত করেছিল আটশ টাকা। তিনি সেই প্রস্তাব লুফে নেন ।

জামাল নজরুল ইসলাম যা করেছেন, তা সবাই করতে পারে না। আজাকাল ২৮০০ টাকা দিয়ে একটা পড়নের জিন্স আমরা কিনতে পারি না । সেখানে জামাল নজরুল তৎকালীন ২৮০০ টাকায়(বর্তমান হিসেবে বড়জোর ৩৫,০০০-৫০,০০০ টাকা) ক্যামব্রিজের মত জায়গায় প্রিয় বিষয়ের অধ্যাপনা ছেঁড়ে চলে এসেছেন ।

দেশে ফিরে বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার জন্য উন্নত মানের একটি গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার অধীনে অনেক ভাগ্যবান শিক্ষার্থী মাস্টার্স ও পিএইচ.ডি. করেছে ।

শুধু বিজ্ঞানেই তাঁর অবদান ছিল না, তিনি কাজ করেছেন দারিদ্র দূরীকরণে, শিল্প ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি মনে করতেন, আমাদের দেশটা যেহেতু কৃষিনির্ভর, তাই, আমাদের শিল্পনীতি হওয়া চাই ‘কৃষিভিত্তিক, শ্রমঘন, কুটিরশিল্প-প্রধান’ এবং ‘প্রধানত দেশজ কাঁচামাল-নির্ভর’।

তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ-এর ক্ষতিকারক প্রেসক্রিপশন বাদ দিয়ে নিজেদের প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটা সুষ্ঠু শিল্পনীতির প্রতি সবসময় গুরুত্ব দিতেন। পাশ্চাত্য সাহায্যের ব্যাপারে তার একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, “তোমরা শুধু আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও, আমাদের ভালোমন্দ আমাদেরকেই ভাবতে দাও। আমি মনে করি, এটাই সর্বপ্রথম প্রয়োজনীয়।”

‘স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ’ নামে একটি বিখ্যাত ম্যাগাজিনে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে তিনি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন। মূলত সম্পূর্ণ বইটির সারমর্ম নিহিত আছে এই প্রবন্ধে। এ সম্বন্ধে জামাল নজরুল ইসলাম তার বইয়ে যে মুখবন্ধ লিখেছেন, “১৯৭৭ সালে “মহাবিশ্বের সম্ভাব্য অন্তিম পরিণতি- Possible ultimate fate of the universe” শিরোনামে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেছিলাম। কোয়ার্টারলি জার্নাল অব রয়্যাল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল। আমার কিছু সহকর্মীর নিকট গবেষণাপত্রটি বেশ আগ্রহোদ্দীপক ও চমৎকার বলে মনে হয়েছে।

এর পরপরই বিজ্ঞানের জগতে আবির্ভাব ঘটেছে স্টিভেন ওয়াইনবার্গের সাড়া জাগানো বই দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস। একদিকে আমার গবেষণাপত্র নিয়ে সহকর্মীরা বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে মহাবিশ্বের শুরুর দিক নিয়ে ওয়াইনবার্গ বই লিখেছেন। এই দুই দিক মিলিয়ে ভাবলাম, মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি নিয়ে একটি বই লিখলে চমৎকার হয়। এর পরপরই স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ নামে একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী থেকে আমাকে একটি অনুরোধ করা হয়।

মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে আমার গবেষণাপত্রটি যেন সকলের উপযোগী করে সহজসাধ্য ভাষায় লিখে দেই তাদের জন্য। ঐ সাময়িকীতে লেখাটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি সংখ্যায়। লেখার শিরোনাম ছিল ‘The ultimate fate of the universe’।এটি প্রকাশের পর যে সাড়া পেয়েছি তা-ই আমাকে এই বিষয়ে একটি বই লিখতে প্ররোচিত করেছে। এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করে একটি বই লিখে ফেললে মন্দ হয় না। এসব ঘটনার মিলিত ফলাফলই হচ্ছে বর্তমান এই বই।”

The ultimate fate of the universe তাকে সমূহ সম্মান ও মর্যাদা এনে দেওয়ার পর তিনি আরও বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন ।যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে Rotating Fields in General Relativity এবং An Introduction to Mathematical Cosmology।বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার জন্য লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি এক অনন্য নাম। রয়্যাল সোসাইটির প্রসিডিংসয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা মানে আক্ষরিক অর্থেই রাজকীয় কাজ সম্পন্ন করা। জামাল নজরুল ইসলাম এই প্রসিডিংসয়ে ধারাবাহিকভাবে পরপর ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

এখানে গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে গেলে আবার রয়্যাল সোসাইটির কোনো ফেলো সদস্যের রিকমেন্ডেশন লাগে। জামাল নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে রিকমেন্ডেশন করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও ফ্রেড হয়েল। পরপর প্রকাশ করা ছয়টি গবেষণাপত্রের বিষয় ছিল ‘অন রোটেটিং চার্জড ডাস্ট ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’। সাধারণ আপেক্ষিকতা ও চার্জিত বস্তু নিয়ে করা গবেষণার উপর ভিত্তি করেই লিখেন ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ নামের বইটি।

১৯৮৫ সালে এটি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় !অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ইকনোমিক্স ও কনফাইনমেন্ট অ্যান্ড শ্রোডিংগার ইকুয়েশন ফর গাউস থিওরিস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বইগুলো প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছে।

বিজ্ঞানের বাইরেও ছিল তার সরব পদচারণা। গণিত, পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞান, সঙ্গীত ও অর্থনীতিতেও ছিল তার বিচরণ।অনেকে আছেন যারা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার কথা শুনলেই নাক সিটকান। ভাবেন, উচ্চতর গবেষণা হতে পারে কেবল ইংরেজিতেই। জামাল নজরুল ইসলাম সেধরণের মানসিকতা সমর্থন করতেন না। আমি যে উপর বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘কৃষ্ণ বিবর’ বইটার উল্লেখ করেছি, তার বাইরেও তিনি বাংলায় আরো দুটো বই লিখেছেন। একটি হল ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’ এবং ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’ ।

আরেক বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিখ্যাত উক্তি মনে আছে নিশ্চয়?” যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চ্চা সম্ভব নয় তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না.”

হয়ত বিদেশে থেকে গেলে জামাল নজরুল স্যার নোবেলেরও দেখা পেতেন । কিন্তু দেশে নিরালায় পিছন থেকে করে গিয়েছেন তার গবেষণা । বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান।

১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাঁকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়।তিনি ২০০০ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ এন্ড জেবুন্নেছা পদক পান। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন।

সব গ্রহ তাদের কক্ষপথে একই সরলরেখায় অবস্থান করবে বলে ২০০১ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে একটি গুজব রটেছিল। বাংলাদেশেও এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে দেখান যে, সে রকম সম্ভাবনা নেই। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ এক সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না।

বই পড়তে ভালবাসেন। তবে তিনি শখ হিসেবে গান শোনা ও ছবি আঁকার কথা বলেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত সবচেয়ে প্রিয়। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট এর প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ব্যবহারে তার অনীহা ছিল। গাণিতিক হিসাব মাথা খাটিয়ে করতে পছন্দ করতেন। তাই কম্পিউটারের ব্যবহারও তার কাছে ভালো লাগত না। এই অপছন্দের মূল কারণ অবশ্য অপ্রয়োজনীয়তা। তিনি বলতেন, কম্পিউটার তার কাজে লাগে না।

তার চিন্তার অনেকখানি জুড়ে ছিল দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। ২০০৭ সাল সহ চট্টগ্রামের যেকোনো পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় ছুটে যেতেন। বেশিরভাগ সময় নিজ হাতে ধ্বংসস্তুপ থেকে নিজ হাতে মাটি সরিয়েছেন ।

এছাড়া তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন সব শিক্ষার্থীকেই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত লেখক ও শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার আগে জামাল নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। মৌলবাদিদের হুমকি সত্তেও জামাল নজরুল ইসলাম তৎক্ষণাৎ তাকে দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ দেন।

১৬ মার্চ ২০১৩ সালে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ফুসফুসের সংক্রমণ ও হৃদরোগের কারণে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান !

বলিউডের চাকচিক্যময় হিন্দি আইটেম গানে আসক্ত বা পশ্চিমা নিগা ইংরেজি ভাষায় কথা বলা তরুন সমাজের কয়জনই বা জামাল নজরুলের নাম জানেন । জগদীশ চন্দ্র বসু ,মেঘনাথ সাহা , অধ্যাপক মকসদুল করিম সহ অনেক প্রথিতজশা বিজ্ঞানী আমাদের দেশে জন্মেছেন । অনেকে নিজের স্বীয় চিন্তায় পৃথিবীবাসিকে নিজেকে চিনেয়েছেন । আর এই তালিকার অন্যতম এক ব্যাক্তি হলেন অধ্যাপক জামাল নজরুল ।

তিনি টাকার গদিতে শুয়ে থাকতে চান নি , চান নি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করে স্পটলাইট পেতে । যেখানে হুমায়ন আজাদের মত শিক্ষক মৌলবাদীদের হাতে খুন হন , সেখানে জামাল নজরুল নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়েও কোন স্বার্থে না মন দিয়ে বিজ্ঞান চর্চা করেছেন । এই নোটটিরও বেশির ভাগ লেখা প্রয়াত বিশ্বতত্ত্ব লেখক অভিজিৎ রায়ের লেখনি থেকে কপি করা , যিনিও মৌলবাদীদের চাপাতিতে চলে গিয়েছেন ।

পাকিস্তান তাদের আব্দুস সালাম বা ভারত তাদের আব্দুল কালামকে যে মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করেছে আমরা তার শতকরা ১ ভাগও কোন শিক্ষককে দিতে পারি নি । উল্টো আমরা তো আমাদের শিক্ষককে চড়-থাপ্পড় দিতেও ছাড়ি না !

সদা হাস্যজ্বল এই শিক্ষক তার মিষ্টি ভাষাতে সবাইকে মোহিত করে রাখতেন । আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষক যেখানে শুধু বই দেখে সমীকরণ প্রতিপাদনে ব্যাস্ত, সেখানে স্যার দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে দেশে থেকেও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করা যায় । শিক্ষককে কেমন হওয়া উচিত তা জামাল নজরুল দেখিয়ে দিয়ে গেছেন । কয়েকদিন আগেও নাসা গোডার্ডের ইনভেন্টর অফ দ্যা ইয়ারে ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশি এক মেয়ে ।

প্রিন্সটনের বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ এম জাহিদ হাসান বা ম্যাসাচুসেটসের মোহাম্মদ আতাউল করিমের মত শিক্ষক আছেন আমাদের দেশেও । কিন্তু বাংলাদেশি,বাঙালি বা বালাদেশ বংশোদ্ভূত ট্যাগ নিয়ে আর কতদিন ? তাই আমাদের তরুন সমাজের উচিৎ জ্ঞান অর্জন করে অধ্যাপক জামাল নজরুল দেখানো পথ অনুসরন করা।

“এশিয়ার মধ্যে আমার পরে দ্বিতীয় কোন বিজ্ঞানী যদি নোবেল পুরুস্কার পান,তবে তিনি হবেন প্রফেসর জামাল নজরূল ইসলাম”
কথা গুলি বলছিলেন নোবেলজয়ী পাকিস্তানি পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম 1986 সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমীতে।

অজানা কিছু কথা

সোয়া লাখ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে আটাশ,শ টাকা বেতনের চাকরি নিয়েছিলেন পরে তিন হাজার টাকা করেছিল।

উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাবকে না,উপাচার্য হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বারবার প্রস্তাব দেওয়া সত্বেও তিনি সাড়া দেননি এবং বলেছিলেন, This is not my cup of tea.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান না করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন।এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম.এ হারুন লিখেছেন: “জামালের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৪ সালে,যখন তিনি কেমব্রিজ থেকে চট্টগ্রামে চলে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।একদিন তিনি টেলিফোনে লন্ডন থেকে আমাকে জানালেন যে,তিনি বাংলাদেশে চলে আসতে চান। এটা নিশ্চয় খুবই ভাল সিদ্ধান্ত, তবে তিনি যদি তাঁর দরখাস্তটি আমাকে পাঠিয়ে দেন তবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠাতে পারব।তারপর তিনি যা বলেছিলেন তা শুনতে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি ঢাকায় যাবেন না, তিনি চট্টগ্রামে যাবেন(সংক্ষেপিত,কালি­ ও কলম,বৈশাখ১৪২০,পৃ-৪৩)­

তাঁর বাবা কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামের সাথে মিলিয়ে তাঁর নাম জামাল নজরুল ইসলাম রেখেছিলেন।কলকাতায় তাদের পরিবারের সাথে কাজী নজরুলরে পরিবারের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল।

তিনিই আমাদের দেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞান বিষয়ক সর্বাধিক সংখ্যক এম.ফিল ও পি এইচ ডি ডিগ্রী প্রদানসহ অর্ধশতাধিকের ও বেশি আর্ন্তজাতিক মানের কনফারেন্সের আয়োজন করেন এবং উচুমানের চারটি গ্রন্থ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হন।এগুলো কেমব্রিজ,প্রিন্সটন,হার্ভার্ডের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।তাঁর গ্রন্থ গুলো নিম্নে দেওয়া হল:

  • The ultimate fate of the universe, Cambridge university press1983, translated­ in French Japanese, Italian, Portuguese and serbo-crout.
  • Classical general relativity, Cambridge university press 1984.
  • Rotating fields in general relativity, Cambridge­ university press1985.
  • An introduction to Mathematical cosmology, Cambridge university press.

জামাল নজরুল ইসলাম ও তাঁর কিছু বন্ধু:

  • জোসেফসন-নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ।
  • স্টিফেং হকিং ।
  • জে .ডি নারলিকার, বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ববি­দ, ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতি পদার্থবিজ্ঞানী (দুজনে­ই কেমব্রিজ থেকে ডি এসসি লাভ করেন একই সাথে)
  • অধ্যাপক আব্দুস সালাম, নোবেলজয়ী পাকিস্তানি পদার্থবিজ্ঞানী ).
  • অমর্ত্য সেন

অমর্ত্য সেন ও জামাল নজরুল ইসলাম:

অমর্ত্য সেনের আগ্রহ ছিল গাণিতিক অথনীতির উপর আর জামাল নজরুলের আগ্রহ ছিল গাণিতিক পর্দাথবিজ্ঞানের উপর।১৯৯০ সালে যখন অমর্ত্য সেন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন জামাল নজরুলের বাসায় ছিলেন। অমর্ত্য সেন যেদিন নোবেল পুরুস্কার পাবেন ঠিক আগের দিন রাত্রে কেমব্রিজে তাদের দুজনের কথা হচ্ছিল রাতে দুজনে একসাথে বসে ডিনার ও করেছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জামাল নজরুল ইসলাম

১৯৮১ সালে তিনি এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগ দেন।১৯৮১ সালে তাঁর আমন্ত্রণে নোবেল জয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এটি ছিলো কোন নোবেল জয়ী ব্যক্তির প্রথম আগমন ।এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেবা করে গিয়েছিলেন।১৯৮৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্রালয়ে তাঁরই প্রতিষ্টিত গবেষণাগারে ৫০ টির ও বেশি আন্ততর্জাতিক মানের সেমিনার হয়।

শিক্ষাজীবন

কলকাতার একটি মডেল স্কুল হয়ে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে(নবম শ্রেণী পর্যন্ত) হয়ে পাকিস্তানের ব্রিটিশ আওতাধীন লরেন্স স্কুলে ভতি হয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন যা বতমানে ও লেভেল এবং এ লেভেল পরীক্ষার সমতূল্য।

ভিন্নতা

সেই কলেজে হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে অ্যাডভান্স গনিত নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন একমাত্র তিনিই।
পরে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়াশুনার পাঠচুকিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি সম্মান অর্জন করেন।পরে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। ১৯৫৯ সালে রোজ বেল রচনা প্রতিযোগিতায় Unified field theories (একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্)এর উপর প্রবন্ধ লিখে তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের রোজ বেল ম্যাথমেথিক্যাল পুরুস্কান লাভ করেন।

১৯৬০ সালে তিনি ট্রাইপাস পার্ট থ্রি স্কলারশিপ সহ ট্রিনিটি কলেজের সিনিয়র স্কলার মনোনীত হন একই বছরে তিনি আবার রির্সাচ স্কলার নিবাচিত হন।১৯৬৪ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রয়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানে পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে ডি এস সি(ডক্টর অব সায়েন্স) খেতাবে ভূষিত হন।

গবেষণাক্ষেত্র:

  • আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব।
  • বিশ্বসৃষ্টি তত্ত্ব(cosmology)

গবেষণা ও কর্মজীবন

১৯৬৩ হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে গবেষণা করেন।

১৯৬৫-৬৬ এক বছরের জন্য লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো নিযুক্ত হন।

১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত মোট চার বছর তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউট এর স্টাফ মেম্বার ছিলেন। সেখানেই পরিচয় হয় স্টিফেং হকিং এর মত বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীর সাথে।

১৯৭১-৭২ তিনি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজির পর্দাথ বিজ্ঞান বিভাগের ভিজিটিং অ্যাসোসিয়েট ছিলেন।

১৯৭৩-৭৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন।

১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সায়েন্স রিচার্স ফেলো ছিলেন।

১৯৭৮-৮৪ লন্ডনের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পরে রিডার(বতমানে সেহযোগী অধ্যাপকের সমমানের)

পুরুস্কার ও সম্মাননা:

  • ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী কর্তৃক স্বর্ণ পদক লাভ করেন।
  • ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পদকে ভূষিত করেন(প্রথম এই পদক দেয়া হয়)

বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবন

১৯৬০ সালে তিনি কলকাতার মেয়ে সুরাইয়া ইসলামের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর।অধ্যাপক ইসলামের দুই মেয়েরই জন্ম আমেরিকায়। জন্মের সময় তিনি আমেরিকার প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডিতে কমরত ছিলেন।বড় মেয়ে সাদাফের জন্ম ১৯৬৮ সালে আর ছোট মেয়ে নার্গিসের জন্ম ১৯৭৩ সালে। বড় মেয়ে বাবার কমস্থল কেমব্রিজে পড়াশুনা করেছেন আর ছোট মেয়ে লন্ডনের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে লেখাপড়া করছেন।

মূলকথা, আমার ধারণা উনি যদি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কেমব্রিজে সেবা দিয়ে যেতেন নোবেল পুরুস্কার পেয়েও যেতেন। স্থায়ী ভাবে দেশে ফিরে আসাটা এ দেশের জন্য বিরাট আত্নত্যাগ। তাঁর এ কাহিনী বাঙালি জাতি চিরদিন স্বরণ করবে। দেশে শুধু তিনি একাই ফিরে আসেননি তাঁর পরিচিত সকলকে দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকায় থাকাকালে মুহাম্মদ জাফর ইকবালকেও দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়েছিলেন।তিনি শুধু বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেননি ধম,অর্থনীতি,দর্শন,সু­ফিবাদ ইত্যাদির উপর গবেষণা ও গ্রন্থ রচনা করে গেছেন।

এইরকম বলা যায় – তিনি হলেন এ গরিব দেশের উচু মানের বিজ্ঞানী.