ফরাসিরা বরাবরই খ্যাপাটে, রোমান্টিক জাতি হিসেবে স্বীকৃত। অদ্ভুত কাজকর্মের জন্য তাদের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর, প্যারিসের কাছে অরলি বিমানবন্দরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের ৭২০বি ফ্লাইটটি মাত্রই রানওয়ে তে যাচ্ছিল, টেকঅফের জন্য।
বিমানটিতে ছিলেন ৬ জন বৈমানিক ক্রু এবং ২২ জন যাত্রী।
হঠাৎ বিমানবন্দরের রেডিও তারবার্তায় একটা বার্তা আসে। যা দেখে চক্ষু চড়কগাছ অপারেটরের।
বার্তার লেখাটি ছিল এরকম ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত মানুষ বিশেষ করে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের সাহায্যার্থে কিছু ঔষধ ওই বিমানটিতে তুলে পাঠাতে হবে। না হলে বিমান উড়িয়ে দেয়া হবে’। বার্তাটি যিনি পাঠিয়েছিলেন তার নাম জ্যঁ ক্যুয়ে।
এদিকে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ছিনতাই করা বিমান সংলগ্ন টার্মিনাল এলাকা বন্ধ করে সাংবাদিক ও জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। পরমুহুর্তে জ্যঁ ক্যুয়ে আরেকটি বার্তা পাঠান ‘ফ্লাইট ৭১২ ছিনতাই করা হয়েছে এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর জন্য, বাংলাদেশের যোদ্ধাদের জন্য নয়’।
দুপুর ১১.৫০ মিনিটে পিআইএ-র বোয়িংটির ককপিটে গিয়ে পাইলটের গায়ে ৯ এমএম পিস্তল ঠেকান তিনি।
একহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে তার আর টেপ পেঁচানো ব্যাগ। সে বললো এটি বোমা। সেই ব্যাগ আর আরেক হাতের পিস্তল দেখিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলে পাইলটকে।
পাইলট বুঝতে পারেন তার বিমান ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে।
প্রথমে পাইলটের সাথে আর এরপরে গ্রাউন্ড স্টেশনের সাথে কথা বলায় সবাই বুঝতে পারে, এই পাগলের সাথে কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা নেই। কোন বড় নেতার মুক্তি কিংবা অর্থকড়ি কিছুই চাচ্ছে না সে। তার দাবি খুবই অদ্ভুত।
এই পিআইএ ফ্লাইটে করেই ২০ টন চিকিৎসা সামগ্রী পাঠাতে হবে যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশে। আর নয়তো এই বিমান কোথাও যেতে দেবে না সে।
সাহায্য না-পাঠানো হলে বোমা ফাটিয়ে বিমানটি উড়িয়ে দেয়া হবে। ভয়ে কাঁপতে থাকলো যাত্রীরা যাদের অধিকাংশই পাকিস্তানী। ততক্ষণে টিভিতে “সরাসরি” দেখানো হচ্ছে সব কিছু।
তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পিডুর সাথে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে সেই দিন প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে এসেছিলেন পশ্চিম জার্মানির তদানীন্তন ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট ফ্রান্স সফরে এসেছেন।
স্বাভাবিকভাবে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রটোকল নিয়ে বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষী ও অন্যান্য কর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুপুর ১১টা ৫০ মিনিটে মাত্র ২৮ বছর বয়সী যুবক জ্যঁ ক্যুয়ে একটি ৯ মি.মি এর রিভলবার হাতে নিয়ে সেই বিমানবন্দরে অবস্থান করা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭২০ বিমানের ককপিটে প্রবেশ করে তৎক্ষনাৎ পাইলটসহ বিমানটির ক্রুদের জিম্মি করে ফেলেন।
এ সফরের উদ্দেশ্য নানা দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পেডুর সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করা।
পাকিস্তানি বিমানে জিম্মি সংকটের ঘটনার কারণে সেদিন তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পিডু এবং তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডিটের সকল আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।
বোকা এই তরুণের নাম জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে (Jean-Eugène-Paul Kay।)
১৯৭১ সাল, মার্চের পর থেকেই সারা পৃথিবী জানতে শুরু করে নিরীহ বাঙ্গালির উপর কি নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
ভারতের শরনার্থী শিবিরে চিকিৎসার অভাবে, ওষুধের অভাবে মারা যাওয়া মানুষের কাতরতা ততদিনে সারাবিশ্বের সবার মত তার প্রাণেও নাড়া দিয়েছিল। কিছু একটা করতেই হবে এই ভাবনা থেকেই প্লেন হাইজ্যাকের পরিকল্পনা করে সে।
প্লেনের কোন যাত্রীকে জিম্মি করলো না সে। একে একে সবাইকে নেমে যেতে দিয়েছে। বোমা সদৃশ ঐ ব্যাগের মধ্যে কেবল একটা বাইবেল আর দুইটা ডিকশনারি, একটি ইলেকট্রিক শেভার পাওয়া গিয়েছিল।
বাইরে থেকে তার পেঁচিয়ে রেখেছিল শুধু মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য। এই দেখিয়ে সাত ঘণ্টা আটকে রাখল প্লেনটাকে।
আলোচনায় বসা হলো জ্যঁ ক্যুয়ে’র সঙ্গে। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ব্যক্তিগত কোনো লাভালাভের ব্যাপার এখানে নেই।
তিনি কেবল চান মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশে যেন ফ্রান্স সরকার ঔষুধ সরবরাহ করে সহায়তা করে। আর পিআইএর এই বিমানে করেই যেন সেই মালামাল বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়।
জ্যঁ ক্যুয়ের দাবিও ফরাসী সরকার সহজে মেনে নেয়নি। কমান্ডো বাহিনী দিয়ে দিয়ে অর্লি বিমানবন্দর ছেয়ে ফেলে ফরাসী সেনাবাহিনী। তবে এক পর্যায়ে বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটের দিকে সরকার মেনে নেয় তার দাবি।
ফরাসি সরকার তখন রাজি হয় এই জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী বিমানে লোড করবার জন্য।
১৩ ডিসেম্বর বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটের সময় ফরাসী রেডক্রস ও অন্য একটি সাহায্য সংস্থার সহায়তায় দ্রুত সংগ্রহ করে অর্লি বিমান বন্দরে আনা হয় ১ টন ঔষধ। শেষাবধি পিআইএ-র ঐ বিমানেই তোলা হয় ১ টন ঔষুধ এবং বাকী ঔষধ অনতিবিলম্বে প্রেরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়।
এই পর্যায়ে এসে ফরাসি সরকার জিম্মি সংকট নিরসনে একটি পরিকল্পনা করে। ঔষধ সামগ্রী বোঝাই দ্বিতীয় ট্রাক এসে বিমানটির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ততক্ষণে।
সেই ট্রাকের চালকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ফরাসি পুলিশের ছদ্মবেশী সদস্য। সেই ছদ্মবেশী পুলিশ সদস্যরা কৌশলে বিমানটির ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে।
তারা জিম্মিকারীকে পেনিসিলিনসহ কয়েকটি ওষধ ওঠানোর কথা বলে, যেগুলো বিমানটির কার্গোতে পরিবহন করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ছদ্মবেশী ফরাসি পুলিশ সদস্যরা বিমানটির ককপিটে পেনিসিলিন রাখার জন্য জ্যঁ ক্যুয়ের কাছে অনুরোধ জানায়।
পেনিসিলিন কার্গোতে নিলে নষ্ট হয়ে যাবে এই কথা বলে ককপিটে রাখার ব্যাপারে রাজি করায় জ্যাঁঁ ক্যা-কে।
কিন্তু ঐ ওষুধ পরিবহন কর্মীরা আদতে ছিল ফরাসি পুলিশের দল। তারাই ওষুধ রাখার ছলে ককপিটে যেয়ে জাপটে ধরেন জ্যাঁঁ ক্যা কে এবং কিল-ঘুষিতে কাবু করে গ্রেপ্তার ফেলে।
এবার পুলিশ সদস্যরা বিমানটির আরোহীদের দ্রুত নামিয়ে নিয়ে আসেন। এরপর পুলিশ জ্যঁ ক্যুয়েকে বিমান থেকে নামিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করেন।
তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে শুধুমাত্র মানবিক কারণে ভারতে অবস্থান করা বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য এই ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে জানান।
তার কাছ থেকে উদ্ধার করা বাক্সটি থেকে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া যায়নি, সেখানে কিছু বৈদ্যুতিক তার এবং এক কপি বাইবেল ছিল। তদন্তকারী কর্মকর্তারা উদ্ধার হওয়া বিমানটির আরোহীদের সাথে কথা বলেন।
সেই যাত্রীরাও তাদের সাথে ক্যুয়ের আচরণ ভালো ছিল বলে জানান। বিমানটিতে নিরাপত্তা তল্লাশি চালানোর পর সেটি করাচির উদ্দেশ্যে প্যারিস ছেড়েছিল।
বিমান ছিনতাই এর মামলায় শাস্তি হিসেবে পাঁচ বছরের জেল হয় তার। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের দাবির মুখে তাকে ১৯৭৩ সালে মুক্তি প্রদান করা হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জন্য তার মানবিক কার্যক্রম অব্যহত রাখেন।
কিন্তু ফরাসি সরকার নৈতিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশকে সাহায্য করবার। অঁদ্রে দ্য মল্টা নামের একটি সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে সেই ঔষুধ বাংলাদেশে পৌঁছানো হয়েছিল। ভারতের আশ্রয় শিবিরে এসেছিল সেই ২০ টন ওষুধ আর চিকিৎসা সামগ্রী।
পুরো ঘটনা আলোড়ন তোলে ইউরোপিয়ান ও আন্তজার্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। এমনকি পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও বন্ধুরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না করে ভোটদানে বিরত থাকে ফ্রান্স।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানকারী, মানব সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়া এই খ্যাপাটে ফরাসির প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাকে।
জ্যঁ ক্যুয়ে পুরো নাম জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে। ১৯৪৩ সালের ৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আলজেরিয়ার মিলিয়ানা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা।
জ্যঁ কুয়ে এবং তার একজন ভাইও ফরাসি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তিনি ইয়েমেন এবং নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন।
ফলে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং নিরীহ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা ছিল। সামরিক বাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে এরপর তিনি দরিদ্র মানুষের সেবায় নিয়োজিত থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই মানুষটি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই ভাবে জ্যঁ ক্যুয়ের মত অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিকামী মানুষের পাশে। নেপথ্যে থেকেও স্বাধীনতা যুদ্ধে হয়ে উঠেছিলেন একজন অনন্য মুক্তিযোদ্ধা।
জন্ম : ৫ জানুয়ারি ১৯৪৩, মিলিয়ানা, আলজেরিয়া
মৃত্যু: ২৩ ডিসেম্বর ২০১২ (বয়স ৬৯)
পেশা: লেখক
Reference:
1. Salute to Jean Kay, the friend of the distressed