কৃষিবিজ্ঞানী ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা: যার নামে দেশের জনপ্রিয় ফল কাজী পেয়ারা
বাংলাদেশে এখন একটি ফল খুবই জনপ্রিয় আর সেটি হল কাজী পেয়ারা।

যার নামে কৃষি বিজ্ঞানীরা এই পেয়ারার নামকরণ করেছিলেন তিনি হচ্ছেন ন্যাশনাল এমিরিটাস সায়েন্টিস্ট কৃষিবিদ ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা।

তাঁর জন্ম ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি মাতুলালয় বগুড়ায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস গাইবান্ধা জেলার গোবি্ন্দগঞ্জে। গোবিন্দগঞ্জ হাই স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৪২সালে ইংরেজিতে লেটার নম্বর পেয়ে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন।

১৯৪৪ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই,এসসি পাস করে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন ঢাকার তেজগাঁয়ে অবস্থিত বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউটে। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক ১৯৩৮ সালে এটি প্র্তিষ্ঠা করেছিলেন।

এই প্র্তিষ্ঠানে ইংল্যান্ডের রিডিং ইউনিভার্সিটির সিলেবাস অনুসরণ করা হত। স্বাধীনতার পরে ১৯৪৭ সালে্ হয় পূর্ব বাংলা কৃষি ইনস্টিটিউট (১৯৫৬সাল থেকে পূর্ব্ পাকিস্তান কৃষি ইনস্টিটিউট) আর ১৯৭১ সালে হয় বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট।

২০০১ সালের ১৫ই জুলাই প্রতিষ্ঠাতার নাম ধারণ করে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্র্তিষ্ঠিত হয়।

কাজী এম বদরুদ্দোজা ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলা কৃষি ইনস্টিটিউট( East Bengal Agricultural Institute) থেকে বি,এজি ডিগ্রি লাভ করেন।

পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অনুমোদনে এগ্রিকালচার রিসার্চ্ ল্যাবরেটরিতে একজন রিসার্চ্ এসিস্ট্যান্ট পদে নিয়োগ লাভ করেন।

তিনি ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম, এসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে আমেরিকার লুইজিয়ানা থেকে পিএইচ,ডি ডিগ্রি লাভ করেন।

পাট ও গম আবাদ বিষয়ে জ্ঞান লাভসহ জেনেটিক্স-এর ওপর ডিপ্লোমা লাভ করে সুইডেন থেকে ফিরে এসে পশ্চিম পাকিস্তান রিসার্চ্ কাউন্সিলে যোগদান করেন। পরে হন প্র্তিষ্ঠানটির পরিচালক।

তিনি সে প্র্তিষ্ঠানের মহাপরিচালক হয়েছিলেন। ড. এম বদরুদ্দোজার অনুপ্রেরণায় তাঁর সিনিয়র বিজ্ঞানী (পরে হয়েছিলেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্র্তিষ্ঠানের পরিচালক) ড. শাহ মোহাম্ম্দ হাসানুজ্জামানের গবেষণা ও প্র্চেষ্টায় বাংলাদেশে গম ফসলের আবাদ ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল কৃতী বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত হয় কাজী পেয়ারা যা ড. এম বদরুদ্দোজার নামেই নামকরণ করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), সাভারে বাংলাদেশ প্রাণিসম্প্দ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), বাংলাদেশ মৎস্য্ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বাকৃবি ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহ), ইনস্টিটিউট অব পোস্ট্ গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার-ইপসা।

ইপসা(গাজীপুরে)১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।

ড. এম বদরুদ্দোজা বিএআরসি(বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল), বিনা (বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাকৃবি ক্যাম্পাস,ময়মনসিংহ) পুনরায় গঠন করেন।

তিনি বিদেশেও কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় সে সব দেশকে সহযোগিতা করেন। ভিয়েতনামের ইনস্টিটিউট অব জেনেটিক্স,পাকিস্তানের এরিড জোন রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্র্ভৃতি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্র্তিষ্ঠানের পরিচালক,বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব্ পালন করেন। সামরিক শাসনামলে কৃষি শিক্ষাকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সরানোর প্র্চেষ্টাকে দৃঢ়তার সাথে প্র্তিহত করেছিলেন।

ফার্মগেইটের যে স্থানে বিএআরসি ভবন দাঁড়িয়ে আছে সে স্থানে একটি জার্ম প্লাজম সেন্টার ছিল যেখানে বিদেশ থেকে নতুন নতুন গাছপালা এনে এখানে রোপণ করে দেশে বিস্তারের চেষ্টা করা হত(বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জার্মপ্লাজম সেন্টার রয়েছে বাংলাদেশে।

আমেরিকার ফ্লোরিডার মিয়ামি জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরেই বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারের স্থান।

সুইস এজেন্সির সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ ক্যাম্পাসে এক একর জমি নিয়ে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে অধ্যাপক ড. এম এ রহিম ১৯৯১ সালে বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারের কাজ শুরু করেছিলেন।

এখন ৩২ একর জমিতে ৮৫০০ মাতৃগাছ রয়েছে। এখানে গবেষণা করে বহু ছাত্র এমএস ও পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করছে)।

স্বাধীনতার পরে সেখানে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের কাছে একটি মহল এগিয়ে যায়। ড. এম বদরুদ্দোজা সরাসরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গিয়ে জায়গাটি কৃষি গবেষণার জন্য্ যে প্রয়োজন তা বুঝাতে সমর্থ হন এবং তা রক্ষা পায়।

বাংলাদেশে কৃষির যে অবকাঠামো দেখা যায় তার বেশির ভাগই ড. এম বদরুদ্দোজার মস্তিক প্র্সূত ও প্র্চেষ্টার ফসল।

ড. এম বদরুদ্দোজা তাঁর দীর্ঘ্ কর্ম জীবনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।পাকিস্তান আমলে তিনি খেতাব লাভ করেন তঘমা-ই-পাকিস্তান এবং তঘমা-ই-ইমতিয়াজ।

১৯৮২ সালে তিনি লাভ করেছিলেন বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ কল্যাণ ট্রাস্ট সম্মাননা। ১৯৮৫ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্টিস্ট পদে বরিত হন।

১৯৯৯ সালে বিশ্ব কৃষি গবেষণা সংস্থা আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। ২০১২ সালে তিনি লাভ করেন স্বাধীনতা পুরস্কার।

ড. এম বদরুদ্দোজার দুই ছেলে ড. কাজী মোর্ত্জা কবির (লেমন) ও ড. কাজী সাজিউজ্জামান এবং এক মেয়ে ড. তাসনীম।

বাংলাদেশের কৃষির বাতিঘর হিসাবে বিবেচিত ড. এম বদরুদ্দোজা আজ ৯৩ বছর বয়সে এসেও কৃষি ও কৃষকের জন্য ভাবেন।

-জয়নাল হোসেন
লেখক ও গবেষক।
২৯.০৪.২০২০