রাশিয়ান ভাষায় কেজিবির পূর্ণ রূপ Komitet Gosudarstvennoy Bezopasnost (KGB), ইংরেজিতে যাকে বলে কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি (Committee for State Security
– যার বাংলা অর্থ রাষ্ট্র সুরক্ষা কমিটি।

কেজিবির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে তখনকার সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুষচেভ এর তত্ত্বাবধানে।কেজিবি মূলত  এর  উত্তরসূরি এনকেজিবি এর মত করেই তৈরি করা হয়েছে।

সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুষচেভ ক্ষমতায় এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্টালিন শাসনকালের সবকিছু পরিবর্তন করেন।

এনকেজেবি থেকে কেজিবি প্রতিষ্ঠাও এই বড় পরিবর্তনের একটি অংশ ছিল। কেজিবি এর কার্যালয় ছিল মস্কোর লুবাঙ্কা স্কয়ার।

কেজিবি এর দু’টি ভাগ ছিল।এক ভাগ দেশের অন্তর্গত সকল সমস্যা নিয়ে কাজ করত।অন্যভাগ কাজ করত আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে।

এছাড়াও রাশিয়া ছাড়া সোভিয়েত ব্লকের অন্যান্য দেশগুলোর জন্য কেজিবি এর নিজস্ব বিভাগ ছিল।

কেজিবি:-গঠন

১৯১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘কম্যুটেট গসুডারস্টভেনয় বিজোপাসনিস্টি’ বা কেজিবি গঠিত হয়। রুশ ভাষার কেজিবি ইংরেজিতে দাঁড়ায় ‘কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি’, বাংলায় ‘রাজ্য নিরাপত্তার জন্য কমিটি’।

প্রতিষ্ঠাকালীন কেজিবির চেয়ারম্যান ছিলেন ফিলিক্স এডমাউন্ডভিচ জারসিংকি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তি ঘোষণার আগ পর্যন্ত ২০ জন চেয়ারম্যান কেজিবির দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কেজিবির কার্যক্রম গুটিয়ে আসে। একই বছর ৬ নভেম্বর অফিশিয়ালি কেজিবির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

১৯৯৫ সালের ২১ ডিসেম্বর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিসন রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য এফএসবি নামে অপর একটি গোয়েন্দা সংস্থা গঠন করেন।

কেজিবিকে কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সোর্ড অব শিলড’ বলা হতো।

কেজিবির খুটিনাটি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখে কেজিবি।

অনিয়ম আর অবহেলায় মাত্র ৭০ বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। অথচ বিশ্বের একসময়ের সবচেয়ে বড় দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্যই গঠন করা হয়েছিল কেজিবি নামের গোয়েন্দা সংস্থাটি।

অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে কেজিবি সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিশ্বের পরাশক্তিতে পরিণত করতে সফল হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সিআইএ, এফবিআই কিংবা মোসাদের সম্মিলিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কাছে।

রাশিয়ার বর্তমান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির পূর্বসূরি ছিল দুনিয়া কাঁপানো গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি।

এফএসবির সদর দফতর রাশিয়ার মস্কো শহরের ল্যুবিয়াঙ্কা স্কোয়ারে। এর জবাবদিহিতা প্রেসিডেন্ট রাশিয়ান ফেডারেশন। এফএসবির সাহায্যকারী সংস্থার নাম গ্রু।

এফএসবির মোট ১০টি বিভাগ রয়েছে। এফএসবির মূল দায়িত্ব বৈদেশিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স পরিচালনা, গুপ্তহত্যা, বর্ডার সার্ভেইল্যান্স, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, কাউন্টার টেররিজম, নিজস্ব লোক সংগ্রহ ও নেটওয়ার্ক তৈরি, বিদেশি কূটনীতিকদের ওপর নজরদারি।

জরুরি প্রয়োজনে রাশিয়ার সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করে এফএসবি দিকনির্দেশনা অনুযায়ী। এ ছাড়াও বিদেশি স্পাইদের রাশিয়ায় গোপন কার্যক্রম প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান, অস্ত্রের চোরাচালান রোধ করতে কাজ করে।

গোয়েন্দা কৌশল

প্রতিষ্ঠা লাভের কিছুদিনের মধ্যে বৃহৎ ক্ষমতাসম্পন্ন ও কার্যকর গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কেজিবির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

যে কোনো দেশকে টার্গেট করে বৈধ ও অবৈধ সব ধরনের কার্যক্রম চালাত। উদ্দেশ্য একটিই ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশের নিরাপত্তা সুসংহত রাখা।

গোয়েন্দাগিরির জন্য বিদেশে অবস্থিত নিজেদের দূতাবাসকে ব্যবহার করত। সোভিয়েতের দূতাবাসগুলো দায়িত্ব হিসেবে টার্গেট দেশে বিশ্বস্ত গোয়েন্দা বাছাই করত।

সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের নীতিমালা মানে এমন প্রশিক্ষিত লোককে বসানোর চেষ্টা থাকত কেজিবির।

এসব মানুষকে বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা ছাড়াও প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও করত এই কেজিবি।

টার্গেট দেশের বৈধ অধিবাসীদের দিয়ে চারটি ভিন্ন বিভাগে অপারেশন চালাতে থাকে কেজিবি। এগুলো হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক কৌশল ও তথ্যের বাইরে থেকে যায় এমন সব কাজের বিভাগ।

কেজিবির এসব বিভাগের বিভিন্ন কাজকে কেজিবি পিআর লাইন, কেআর লাইন, এক্স লাইন, এন লাইন, ইএম লাইন নামে আখ্যায়িত করা হয়।

কেজিবি নিজেদের কাজের ব্যাপারে এতটাই কৌশলী ছিল যে টার্গেট দেশে অবৈধ অধিবাসীদের কখনো এক কেন্দ্রের অধীনে রাখেনি।

টার্গেট দেশ:-কেজিবি

এটি টার্গেট করা দেশে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে নিজেদের অভিযান চালাতে সক্ষম ছিল।

তারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ল্যাটিন আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও স্ক্যান্ডেনিভিয়া, পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, আয়ারল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ও কম্বোডিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আরব বিশ্ব, তুর্কি, গ্রিস, ইরান, আফগানিস্তান ও আলবেনিয়া, ফরাসি ভাষা প্রধান আফ্রিকান দেশ, ইংরেজি ভাষা প্রধান আফ্রিকান দেশ এবং ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাতে তাদের কাজ পরিচালনা হতো।

এতে সহজেই অনুমেয় তাদের লোকবল সম্পর্কে। তবে বিশ্বের কোনো গোয়েন্দা সংস্থা নিজেদের প্রকৃত জনবল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রকাশ করে না।

কেজিবি:-অপারেশন

।।কেজিবির দুর্ধর্ষ কিছু গুপ্তচরের উত্থান-পতনের বাস্তব উপাখ্যান।।

ড. ওলেগ কালুগিন

তৎকালীন কেজিবি প্রধান ভ্লাদিমির ক্রিয়েচকভ (Vladimir Kryuchkov), যিনি পরবর্তীতে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মিখাইল গরবাচেভের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ওলেগ কালুগিনের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা নিয়োগ করার অভিযোগ করেন।

এই অভিযোগের দায় মাথায় নিয়ে ওলেগকে রাশিয়ায় ফিরে আসতে হয়।

উপরন্তু, সন্দেহের চাপে রাশিয়ায় বিরক্তিকর সময় পার করতে থাকেন জেনারেল ওলেগ কালুগিন। শেষ পর্যন্ত ওলেগ কেজিবির সকল রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন।

পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ওলেগকে এজেন্সি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন কেজিবি প্রধান ভ্লাদিমির ক্রিয়েচকভ (Vladimir Kryuchkov) পরিচালিত বিদ্রোহের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে তিনি পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকায় শিক্ষকতা শুরু করেন।

নিজের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিতে তিনি ১৯৯৬ সালে তিনি Spy Craft: The Great Game নামে একটি ভিডিও গেম ডেভেলপ করেন।

গেমটির মুখ্য চরিত্র এক সিআইএ এজেন্ট যে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড চুরির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্টের হত্যাকান্ডে বাধা দেয়।

কোনো এক সাক্ষাতকারে ওলেগ উল্লেখ করেছিলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন কেজিবিতে তার পাঁচ স্তর নিচের ফিল্ড অপারেটিভ ছিলেন, যিনি এমনকি ওলেগের সামনে রিপোর্ট করার এখতিয়ারও রাখতেন না।

ওলেগের এই মন্তব্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন এতটাই রেগে যান যে, তিনি ওলেগকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা দেন।

২০০২ সালে রুশ আদালত ওলেগের ১৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের ঘোষণা দেয়, যা তাকে কখনোই ছুঁতে পারেনি।

অলড্রিচ আমেস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের চোখে আমেস সম্ভবত সবচেয়ে অখ্যাত কেজিবি গুপ্তচর। অল্ড্রিচ আমেস সিআইএতে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে সোভিয়েত তথ্য পাচারকারী হিসেবে কাজ করেছেন।

পরবর্তীতে তিনি ধরা পড়ে বিচারের মুখোমুখি হন এবং গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন।

আমেসের বাবা কার্লটন সেসিল আমেস ছিলেন সিআইএ’র গুপ্ত কর্মকর্তা, যিনি ১৯৫০-এর দশকে বার্মায় গোপন মিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

কেজিবিকে তথ্য প্রদানের জন্য তিনি একটি বাদামী খামে ৫০,০০০ ডলার পেয়েছিলেন। এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরই আমেস পুনরায় সোভিয়েত ইউনিয়নে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির কাজে নিয়োজিত গুপ্তচরদের একটি তালিকা কেজিবিকে পাঠান।

যায়, আমেস ২৫ জন সিআইএ কর্মীকে শনাক্ত করার কাজে কেজিবিকে সহায়তা করেন, যাদের মধ্যে ১০ জনকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিলো।

আমেসকে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চমূল্যে প্রাপ্ত গুপ্তচর বলা হয়। সহকর্মীদের পরিচয় ফাঁস করার বিনিময়ে প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেন।

১৯৮৫ সালে আমেস কেজিবির সাথে যোগাযোগ করে সিআইএর তিনজন ডাবল এজেন্টের পরিচয় ফাঁস করার প্রস্তাব দেন।

আমেস ভেবেছিলেন, তিনি যা করছেন তা অনৈতিক নয়। কারণ টেকনিক্যালি যে তিনজনকে তিনি ধরিয়ে দিচ্ছেন তারা প্রথমে কেজিবির এজেন্ট ছিলেন।

অবশেষে ১৯৯৪ সালে এফবিআই পরপর দুবার ব্যর্থতার পর অল্ড্রিচ আমেসকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়।

গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর তথ্য পাচারের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হন। বর্তমানে তিনি পেনসিলভানিয়ার ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি কারাগারে সাজা খাটছেন।

অ্যালেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো

ভূতপূর্ব কেজিবি এজেন্ট অ্যালেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো সাহসীকতার সাথে গুপ্তসংস্থাটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অনৈতিকতার এমন কিছু তথ্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন যা তার অকাল ও কষ্টকর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৯৮ সালে লিটভিনেঙ্কোর দেওয়া এক সরকারি বিবৃতিতে চারদিকে যেন মহা গোলযোগের সৃষ্টি হয়।

লিটভিনেঙ্কো উচ্চপদস্থ এক এফএসবি অফিসারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ও অভিজাত পরিবারের সদস্য বোরিস বেরেজভস্কিকে হত্যার আদেশ দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেন।

উচ্চপদস্থ অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনায় ক্ষমতা ও দায়িত্বের অপব্যবহারের অভিযোগে লিটভিনেঙ্কোর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়।

অভিযুক্ত লিটভিনেঙ্কো নিজেকে এফএসবির কারাগারে বন্দিত্ব বরণের দ্বারপ্রান্তে খুঁজে পান। মিথ্যে মামলা ও হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পেতে লিটভিনেঙ্কো লন্ডনে পালিয়ে যান।

তার অনুপস্থিতেই তার বিরুদ্ধে মামলার রায় বের হয়।

২০০৬ সালের নভেম্বরে ৪৩ বছর বয়সে লিটভিনেঙ্কো রহস্যময় এক রোগে মারা যান। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ হিসেবে তেজস্ক্রিয়তা প্রয়োগের উল্লেখ পাওয়া যায়।

কিন্তু কীভাবে লিটভিনেঙ্কো বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে এলেন তা অজানাই রয়ে যায়। মৃত্যুর বছর দুয়েক পূর্বে ২০০৪ সালে লিটভিনেঙ্কো নিউ ইয়র্ক টাইমস এর প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ভিক্টর ইউশচেঙ্কোর বিষ প্রয়োগে হত্যার পেছনে এফএসবির হাত ছিল।

তেজস্ক্রিয় উপাদান প্রয়োগে লিটভিনেঙ্কোর রহস্যজনক মৃত্যুই বিশ্ববাসীর সামনে এফএসবিকে হবার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়।

বোরিস কারপিকোভ

বোরিস কারপিকোভ, ক্রেমলিনের সাথে মতভেদ ঘটা কেজিবির প্রাক্তন গুপ্তচর। উচ্চপদস্থদের সাথে মতবিরোধের ফলে বোরিস ডাবল এজেন্ট হয়ে যান। এবং পরে লন্ডনে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, যখন স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে লাটভিয়ার জন্ম হয়, একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে বোরিস তখন লাটভিয়ার নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে যোগদান করেন।

ক্রেমলিন ও লাটভিয়া তখন প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে। নিজ দেশের গুপ্ত সংস্থায় যোগ দিলেও বোরিস তখনো রাশিয়ার গুপ্তসংস্থার অধীন। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই তিনি ডাবল এজেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

ডাবল এজেন্ট হিসাবে, কারপিকোভ সিআইএ-কে ভুল তথ্য দিতে থাকেন। একই সময় তিনি ব্রিটিশদের অবস্থা জানতে এক অনুষ্ঠানে অংশ নেবার ছলে রিগায় ব্রিটিশ দূতাবাসে অনুপ্রবেশ করে লিসেনিং ডিভাইস স্থাপন করেন। ঠিক এমনই দুঃসাহসের অধিকারী ছিলেন তিনি।

কিন্তু ১৯৯৫ সালের দিকে, কারপিকোভের সাথে দুর্নীতিবাজ এফএসবির মতবিরোধ ঘটে। তিনি দাবি করেন, তার প্রাপ্য পাওনা তাকে পরিশোধ করা হচ্ছে না।

এদিকে লাটভীয় গুপ্তসংস্থা বোরিস কারপিকোভের সাথে রাশিয়ান এফএসবির সম্পর্কের কথা জেনে যায়। দ্রুতই লাটভিয়া ত্যাগ করে কারপিকোভ অল্প সময়ের জন্য রাশিয়ায় ফিরে আসেন।

পরবর্তীতে তিনি জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে ব্রিটেনে প্রবেশ করেন এবং তারপর কখনও পিছু ফিরে তাকাননি।

ভাসিলি মিত্রোখিন

মিত্রোখিন পছন্দের ক্যারিয়ার হিসেবেই গুপ্তচরবৃত্তি বেছে নিয়ে কেজিবিতে যোগদান করেছিলেন। মিত্রোখিন নিজেই এক সিক্রেট মিশন শুরু করেছিলেন, তা-ও কেজিবির অভ্যন্তরে।

তিনি কেজিবির আর্কাইভ হতে স্পর্শকাতর তথ্য ও দলিল পাচার করা শুরু করেন।

১২ বছর ধরে মিত্রোখিন আর্কাইভ থেকে হাজার হাজার নথিপত্র চুরি করেছিলেন। তিনি রাতের বেলা দপ্তর ত্যাগের পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ নথি নিজের জুতার চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে বের হতেন।

বাসায় ফিরে তিনি নিজ হাতে প্রতিটি নথির কপি করতেন। পরবর্তীতে কপিকৃত নথি তিনি দুধের পাত্রে লুকিয়ে বাগানে গর্ত খুঁড়ে বা বাড়ির মেঝেতে পুঁতে রাখতেন।

এমনকি নিজের স্ত্রীকেও বুঝতে দিতেন না কত বড় ধরনের ঝুঁকি তিনি প্রতিনিয়ত নিচ্ছেন।

পরবর্তীতে সেভিয়েতের পতনের ৮ বছর পর এমআই-৬ এ যোগ দেন।

এমআই-৬ এজেন্টরা মিত্রোখিনকে তার স্ত্রীসহ যুক্তরাজ্যে নিয়ে যান এবং পরবর্তীতে মিত্রোখিনের বাড়ি থেকে কেজিবির লুকোনো নথি খনন করে উদ্ধার করা হয়।

ব্রিটিশরা মিত্রোখিন ও তার স্ত্রীকে পুলিশ সুরক্ষা ও জাল পরিচয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় দেয়।

পরবর্তীতে এফবিআই মিত্রোখিনের অবদানকে ‘তৃতীয় উৎস থেকে প্রাপ্ত সর্বাধিক সম্পূর্ণ ও বিস্তৃত বুদ্ধিমত্তার অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে।

২০০০ সালে ৮১ বছর বয়সে মিত্রোখিন নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।

ওলেগ লায়লিন

ওলেগ লায়লিন গুপ্তচরদের ইতিহাসে দলবদলের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। একজন কেজিবি অফিসার হয়েও তিনি ব্রিটেনের সিকিউরিটি সার্ভিস এমআই ফাইভের পক্ষে কাজ করেছিলেন।

তার দলবদলের কারণে যুক্তরাজ্যে কর্মরত ১০৫ জন সোভিয়েত কর্মকর্তার পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে যুক্তরাজ্য থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এমআই ফাইভ এজেন্টরা ১৯৭১ সালে লায়লিনকে নিয়োগ দেয় যখন তারা জানতে পারে যে, লায়লিন তার একান্ত সচিব, ইরিনা টেপলাকোভার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক লিপ্ত, যা প্রকাশ পেলে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ কখনোই দুজনকে ক্ষমা করবে না।

এই তথ্য জানার কয়েক মাস পরে, লায়লিনকে মাতাল হয়ে গাড়ি চালনার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার হবার পর লায়লিন দ্রুত তার এবং ইরিনার প্রাণ রক্ষার্থে কেজিবি সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন। এভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী লায়লিন ছিলেন

কেজিবির কালো অধ্যায়

চেকার ছ্যাঁকা

স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিখ্যাত হওয়া কেজিবি’র মূল খুঁজতে হলে চলে যেতে হবে সেই বলশেভিক বিপ্লবের সময়।

১৯১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর গঠন করা হয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী, চেকা। পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অভিজাত ফেলিক্স জেরঝিনস্কি ছিলেন এ বাহিনীর প্রধান, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘আয়রন ফেলিক্স’ হিসেবে।

দিন যতই গড়াতে থাকলো সোভিয়েত শাসকরা বুঝতে পারলেন দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য একটি সদা-জাগ্রত গোয়েন্দা দল প্রয়োজন। তবে এর যতটা না প্রয়োজন দেশের বাইরের শত্রুর জন্য, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিপক্ষে।

সোভিয়েত বিরোধী কাউকে পেলেই নির্বিচারে গ্রেফতার করা হতো, কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই তাকে যেতে হতো বীভৎস সব নির্যাতনের মধ্য দিয়ে।

ফেলিক্সই পরবর্তীতে কেজিবি’র ঢাল এবং তলোয়ারের প্রতীক ডিজাইন করেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের আগ পর্যন্ত কেজিবি’র প্রধান দপ্তরের সামনে একজন চেকা অফিসারের লোহার মূর্তি ছিল।

চেকার মতো কেজিবির লক্ষ্যও জনগণকে রক্ষা নয়, বরং ছিল রাষ্ট্রকে রক্ষা করার কাজে ব্যস্ত। দেশের ভিতরে বা বাইরে, সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শের বিরোধী যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই ছিল কেজিবির মূল কাজ।

এর আগেও সাতবার নাম পরিবর্তন করার পর অবশেষে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসকে নামকরণ করা হয় ‘কেজিবি’, যার অর্থ ‘কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি’।

স্তালিন তার গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ১৯৩৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব উদযাপনের এক অনুষ্ঠানে স্তালিন ঘোষণা করেছিলেন, “আমরা কোনোরকম দয়া দেখানো ছাড়াই তাকে ধ্বংস করে দেবো যার কোনো কাজ, এমনকি চিন্তাও এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।”

লেনিনের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, “বিশ্বাস ভালো, নিয়ন্ত্রণ করা আরো ভালো।” আর সোভিয়েত গোয়েন্দারা ঠিক তা-ই করেছিলো, পুরো রাষ্ট্রজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে শত্রুদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতো তারা।

ক্রুশ্চেভের আগমন

১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন নিকিতা ক্রুশ্চেভ।

রাজনীতির মারপ্যাঁচ কাজে লাগিয়ে ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত গোয়েন্দাদের ক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে দেন, সাথে বলশেভিক আর স্তালিন যুগের আগ্রাসী মনোভাবও কিছুটা কমিয়ে আনেন।

১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কেজিবি, সাথে চলে আসে ক্রুশ্চেভের মুক্তি অভিযান। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য নতুন উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়। এমনকি ১৯৫৬ সালের পার্টি কংগ্রেস মিটিংয়ে স্তালিনের সমালোচনাও করেন তিনি।

তা ক্রুশ্চেভের নব্য সোভিয়েত গঠনে ভালোই প্রভাব ফেলছিলো।

বিশ্বজুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভালো ইমেজ তৈরি করার জন্য ক্রুশ্চেভ গুলাগ থেকে কয়েক লক্ষ বন্দীকে ছেড়ে দিলেন, পরিবর্তন করলেন নিরাপত্তা ব্যবস্থাও।

তবে কেজিবির কাজ কমে যায়নি। স্থল আর জল সীমান্ত রক্ষার কাজে কেজিবির আলাদা শাখা খোলা হলো ‘বর্ডার গার্ডস ডিরেক্টোরেট’ নামে, রাষ্ট্রীয় প্রধানদের জন্য গঠন করা হলো দেহরক্ষী বাহিনী ‘নাইন্থ ডিরেক্টোরেট’, টেলিফোন আর রেডিও অপারেটরদের জন্য খোলা হলো বিশেষ ‘সিক্সটিন্থ ডিরেক্টরেট’ শাখা।

সেরভকে সরিয়ে আলেকজান্ডার শেলেপিনকে প্রধান বানানোর পর নৃশংসতা ছেড়ে আরো উন্নত গোয়েন্দা সংস্থায় রূপান্তরিত হলো কেজিবি।

শেলেপিনের ৩ বছরের দায়িত্বরত অবস্থায় বৃদ্ধ রক্ষীদের সরিয়ে দিয়ে প্রচুর পরিমাণে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদেরকে নিয়োগ দেওয়া হলো কেজিবি অফিসার হিসেবে।

মানসিক বিকৃতি

স্তালিন-পরবর্তী ক্রুশ্চেভের মানবিক যুগে কেজিবি অফিসাররা আর খোলামেলাভাবে বন্দীদের উপর নির্যাতন চালাতে পারতো না, এমনকি জেরা করার সময়ও যতটা সম্ভব কম যন্ত্রণা দিয়ে কহা আদায় করা যায়, তার নির্দেশ দেওয়া হলো।

এদিকে এর ফলে অন্যান্য ব্যবস্থাগুলোও খুব একটা কার্যকর হচ্ছিলো না।
এই সমস্যার খুব সাধারণ একটা সমাধান বের করা হলো।

সোভিয়েতের বিরোধিতাকারী যে কাউকে নিয়ে যাওয়া হতো পাগলা গারদে, কারণ এক সাইক্রিয়াটিস্টের মতে, যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করে তার নিশ্চয় মানসিক সমস্যা রয়েছে আর সে ‘সামান্য স্কিৎজোফ্রেনিয়া’তে ভুগছে!

ফ্রান্সিস হুইন এ ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে মন্তব্য করেছিলেন, “একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করে তারই বিরোধিতা করা নিশ্চয়ই পাগলের লক্ষণ!”

এই তথাকথিত স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীদের সবকিছু বাজেয়াপ্ত করে পাঠিয়ে দেওয়া হতো মানসিক রোগীদের হাসপাতালে, যা পরিচিত ছিল পিসিকুশকা নামে।

তৎকালীন কেজিবি চেয়ারম্যান ইউরি আন্দ্রোপোভের হাত ধরে ১৯৬৯ সালে এই নিয়ম চালু শুরু হয়। এভাবে কয়েক হাজার বন্দীকে মানসিক হাসপাতালে বন্দী করে রাখা হতো কয়েক মাস, এমনকি বছরও।

নোবেল বিজয়ী আলেকজান্ডার সোলঝেনিটসিন একে অভিহিত করেছিলেন ‘আত্মিক মৃত্যু’ হিসেবে। এর বিরোধিতা করলে অভিযুক্তের নামের পাশে ‘পাগলামির মাত্রা আরো বেশি’ লিখে দেওয়া হতো, অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য আর ইলেকট্রিক শক ব্যবহার করা হতো ‘ট্রিটমেন্ট’ হিসেবে।

ইউরি আন্দ্রোপোভ এবং ‘দ্য হাঙ্গেরিয়ান কমপ্লেক্স’
১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির অভ্যুত্থানের সময় সোভিয়েত কূটনীতিক হিসেবে সেখানে দায়িত্বরত ছিলেন ভবিষ্যৎ কেজিবি প্রধান ইউরি আন্দ্রোপোভ।

সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কীভাবে মুহূর্তের মধ্যেই এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন ঘটলো তা সারাজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে থাকলো তাকে।

এবং ১৫ বছর ধরে কেজিবির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আন্দ্রোপোভ যখন ১৯৮২ সালে লিওনিড ব্রেঝনেভের উত্তরসূরি হিসেবে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পেলেন, তখন তিনি খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন রাশিয়ার বাইরের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রেও কেজিবির কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন।

নাহলে হাঙ্গেরির দেখাদেখি অন্যান্য দেশগুলোও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। আন্দ্রোপোভ যুগে কেজিবি ব্যাপক পরিমাণে বিদেশের মাটিতে অভিযান চালাতে থাকে, হোক সেটা সোভিয়েত শাসনাধীন কিংবা অন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা, গুজব ছড়ানো কিংবা বিভিন্ন সন্ত্রাসী দলকে অর্থায়ন ছিল তাদের ‘সক্রিয় পদক্ষেপ’।

তিক্ত পরিণতি

পিছন থেকে ছুরি মারা কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক ময়দানেও খুব একটা অপরিচিত ছিল না।

রাশিয়ান সিকিউরিটি সার্ভিস আর পোলিটবুরোর সদস্যরা সবসময়ই একে অপরের পিছনে লেগে থাকতো, আর রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলেই হতে হতো ষড়যন্ত্রের শিকার।

১৯৫৩ সালে জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুর পর, নিরাপত্তা প্রধান লাভরেন্তি বেরিয়াই ছিল মূল উত্তরসূরি, কিন্তু তাকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল করে নিলো ক্রুশ্চেভ।

১৯৯১ সালে মিখাইল গর্বাচেভের সরকারের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং কেজিবি প্রধান ভ্লাদিমির ক্রুশকোভ। মস্কোর বাথহাউজকে ঘিরে তার পরিকল্পনার পুরোটাই মাঠে মারা গেল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের এই টানাপোড়েনের সময় কেজিবির অনেকেই সদস্যই ভেবেছিল শাসকদের পক্ষে মাঠে নামবে। কিন্তু শেষমেশ ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত থাকায় ১৯৯১ সালের ৬ ডিসেম্বর কেজিবিকে ভেঙে দেওয়া হলো।

তার বদলে এলো নতুন দুটো সংগঠন ‘এফএসবি (সিক্রেট পুলিশ এজেন্সি)’ এবং ‘এসভিআর (এস্পায়োনেজ এজেন্সি)’।

মুসলিম দেশে ব্যর্থতা

কেজিবির মুসলিম দেশগুলোতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শক্তিশালী রাষ্ট্র।নিজেরা খুব সুসংগঠিত হলেও ইরাকে কেজিবি প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি।

অপর একটি মুসলিম দেশ আফগানিস্তান ছিল কেজিবির মাথাব্যথা। কেজিবি আফগানিস্তানে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মুসলমানদের দমনের চেষ্টা করে।শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিদায় নিতে হয়।

গুপ্ত এজেন্ট ইন্ধিরাগান্ধী? :-কেজিবি

রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেছিল ইন্দিরা গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য। ভারতের রাজনীতির এবং প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিল কেজিবি। সেই সঙ্গে ইন্দিরার গদি ধরে রাখতেও বিলি করা হয়েছিল কাড়ি কাড়ি অর্থ।

এই যাবতীয় তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল ভাসিলি মিত্রোখিনের লেখা বইতে। আলোড়ন সৃষ্টিকারী ওই বইয়ের নাম ‘মিত্রোখিন’স আর্কাইভ।’

এই ভাসিলি মিত্রোখিন ছিলেন কেজিবি-র প্রাক্তন প্রধান৷ কেজিবির প্রথম চিফ ডিরেক্টরের পদেও তিনিই আসীন হয়েছিলেন।

সেই বিপুল নথির উপরে ভিত্তি করেই লেখা হয় মিত্রোখিন’স আর্কাইভ। দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল সেই আর্কাইভের তথ্য সম্বলিত বই।

প্রথম খণ্ডে উল্লেখ ছিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থার যোগসাজশের কথা। সেই বইতে জানা যায় যে ইন্দিরা গান্ধীকে সাংকেতিক কোড নাম দিয়েছিল কেজিবি। সেই নাম ছিল ‘ভানো’।

সেই সাংকেতিক নামের ব্যক্তির জন্য সুটকেস ভরতি টাকা পাঠিয়েছিল কেজিবি। সেই সময়ে কেজিবি প্রধান লেওনিদ শেবারশীন ভারতে নিয়ে আসেন ২০ লক্ষ টাকা। যা ব্যবহার করা হয়েছিল ভারতের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর প্রচারের জন্য।

ওই টাকার বাইরেও আরও নানা উপায়ে ইন্দিরা গান্ধীকে সাহায্য করেছিল রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা।

মিত্রোখিনের আর্কাইভে দেওয়া তথ্য অনুসারে, ভারতের একাধিক সংবাদপত্রকেও টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিল কেজিবি।

যার মধ্যে একটি সংবাদপত্রকেই সেই সময়ে দেওয়া হয়েছিল ১০ লক্ষ টাকা। একই সঙ্গে আরও ১০টি সংবাদপত্রে ইন্দিরার সমর্থনে ৫৫১০টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল।

১৯৭৫ সালে ইন্দিরার সমর্থনের জন্য এবং বিরোধীদের দুর্বল করার জন্য ১০.৬ মিলিয়ন রুবেল (রাশিয়ার মুদ্রা) ব্যয় করা হয়েছিল।

ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীতেও নিযুক্ত করা হয়েছিল কেজিবি-র প্রতিনিধি।

মিত্রোখিনের আর্কাইভ অনুসারে, ১৯৭৮ সালে ভারতে ৩০ জনেরও বেশি কেজিবি এজেন্ট সক্রিয় ছিল। যাদের মধ্যে ১০ জন ভারতের গোয়েন্দা দফতরের শীর্ষ পদে বহাল ছিলেন।

** প্রাক্তন কেজিবি প্রধান ভাসিলি মিত্রোখিনের লেখা তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হয়নি।।

শেখ মুজিব হত্যাকান্ডে কেজিবি , র’ ,সিআইএ এর ভূমিকা।।

সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সে সময় (১৯৭৫) এ নাকি তাদের ২০ জন এজেন্ট সক্রিয়; দুজন রীতিমতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় ছিলো।

সেই কেজিবি ১৯৭৫ সালে বলেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএ সরাসরি জড়িত নয়।

র-এর সাবেক কর্মকর্তা তার বইতে লিখেছেন, ‘তারা সরাসরি জড়িত না থাকলেও অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া কারও কারও ওপর ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ কর্তাদের আশীর্বাদ ছিল।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায় কেবল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএরই।

মার্কিনিরা অবশ্য শেখ মুজিবকে সতর্ক করেছিল,১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর বিষয়ে। সেদিক থেকে কাও ব্যতিক্রম।

সানডের ২৩-২৯ এপ্রিল ১৯৮৯ সংখ্যায় তিনি এ সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। কাও লিখেছেন, ডিসেম্বর ১৯৭৪-এ তিনি নিজে ঢাকায় এসে মুজিবকে এ ষড়যন্ত্রের খবর দেন।

কিন্তু মুজিব সেটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন,

‘ওরা আমার সন্তান। আমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না।’

কাও আরও লিখেছেন, ‘প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে মার্চ ১৯৭৫-এ আমি ঢাকায় পাঠাই।

শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তিনি জানান যে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ অংশের দুটি ইউনিটে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এসব সতর্কবার্তায় তিনি কান দেননি।’

অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের খবর কাও কীভাবে পেয়েছিলেন? মুজিবের খুব ঘনিষ্ঠ এক সূত্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল।

তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, ‘এসব তথ্য পাওয়া গেছে নাজুকভাবে রোপণ করা এক সূত্র থেকে। যেকোনো মূল্যে তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।’

কেমব্রিজের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রু ও কেজিবির মিত্রোখিন যৌথভাবে একটি বই লিখেছেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পনেরোই আগস্ট সম্পর্কে তাতে পাওয়া যাচ্ছে সামান্য তথ্য:

‘মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরই কেজিবি সিআইএর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমে পড়ে। এতে শুধু বাংলাদেশের নয়, বিদেশের গণমাধ্যকেও তারা ব্যবহার করে।’

আলবেয়ার কামুকে কি কেজিবি হত্যা করেছে?

নোবেলজয়ী ফরাসী সাহিত্যিক আলবেয়ার কামু মারা গিয়েছিলেন এক গাড়ি দুর্ঘটনায়। তখন তার বয়স ছিল ৪৬। দাবি করা হয়েছে সোভিয়েত বিরোধী মনোভাব পোষণের কারণে কামুকে হত্যা করেছে গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি।

১৯৬০ সালের ৪ জানুয়ারি আলবেয়ার কামু তার প্রকাশকের সাথে গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে তার প্রকাশক মাইকেল গ্যালিমার্ড গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

পরে একটি গাছের সাথে গাড়ি ধাক্কা খেলে ঘটনাস্থলেই কামু মারা যান। তার প্রকাশক গ্যালিমার্ড কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর মারা যান।

১৯৭৮ সালে প্রকাশিত কামুর আত্মজীবনীতে হারবার্ট লোটম্যান বলেছিলেন, ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিল গাড়ির ব্রেকের এক্সেল ভেঙে যাওয়ার কারণে।

কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটেছিল একটি সোজা রাস্তায়, যা প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ত এবং সে সময় বলার মতো কোনো ভিড়ও ছিল না।

একজন জ্ঞানী ও যোগাযোগে দক্ষ ব্যক্তি জাব্রানাকে বলেছেন কামুর মৃত্যুর ব্যাপারে কেজিবি জড়িত আছে।

কেজিবি কামুকে বহনকারী ওই গাড়ির চাকা থেকে টায়ার আলাদা করার জন্য এমন এক ব্যবস্থা করে রেখেছিল যেন গাড়ির গতি বাড়ালেই তা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ছুটে যায়।

জাব্রানা তার ডায়েরিতে স্পষ্ট করে লিখেছেন সবাই মনে করেন গাড়ি দুর্ঘটনায় কামু মারা গেছেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো কেজিবি তাকে খুন করেছে। কিন্তু এই কথা কেউ সামনে আনতে চান না।

কামু তার জবানের লাগাম না টানার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকার খেসারত হিসেবে তাকে জীবন দিতে হয়েছে।

কেজিবির গুপ্তচর পুতিন।।

পুতিন প্রায় ১৬ বছর এই গোয়েন্দা সংস্থাক হয়ে কাজ করেন।

জার্মানির সংবাদমাধ্যম বিল্ড ডেইলিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে, পূর্ব জার্মানিতে চরবৃত্তির কাজ করেছেন পুতিন।

সে সময় পুতিনের একটি পরিচয়পত্র ছবি হয়েছে। ওই কার্ড ইস্যু করা হয় ১৯৮৬ সালে।

পুতিনের ওই পরিচয়পত্রে নম্বর রয়েছে ‘বি২১৭৫৯০’।

সাদা-কালো পাসপোর্ট ছবি, নিজের সই-সহ ওই পরিচয়পত্র দেখে অনুমান করা হচ্ছে, ১৯৮৯ সালের শেষ নাগাদ পূর্ব জার্মানিতে অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কাজ করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।

সে সময় পূর্ব জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা স্ট্যাসির সঙ্গে দারুণ বোঝাপড়া ছিল কেজিবি-র। তাই ড্রেসডেনে কেজিবির অফিসও তৈরি হয়। সেখানেই স্থানান্তরিত হন ভ্লাদিমির পুতিন।

একজন কেজিবি গুপ্তচরের গল্প।।

একজন গুপ্তচরকে অবশ্যই একজন ভালো অভিনেত্রীও হতে হয়। আর এর জলজ্যান্ত প্রমাণ এলোনা ভাবাইলোবা।

যিনি প্রায় দুই দশক ধরে নিজের পরিচয় গোপন রেখে ‘ট্রেসি ফোলি’ নামের এক কানাডিয়ান নারীর চরিত্রে ‘অভিনয়’ করেছেন। তার পরিচয় আশপাশের লোকজন জানত না, এমনকি তার বাচ্চারাও না।

ভাবাইলোবা ও তার স্বামী ছিলেন মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির এজেন্ট তারা মূলত কেজিবির কাছে সরবরাহ করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতেন।

‘ট্রেসি ফোলি’ নামধারী এলেনা কানাডিয়ান নারীর ছদ্মবেশে কাটান বিশ বছর। অন্যদিকে তার স্বামীর নাম ছিল ‘ডোনাল্ড হিথফিল্ড’। যার আসল নাম ছিলো ‘আন্দ্রে বেজরুভকভ’। তারা দুজন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কেজিবির আন্ডারকাভার এজেন্ট ছিলেন।

সরকার পতন:-কেজিবি

ধারণা করা হয় কিউবায় সরকার পতন এবং সমাজতান্ত্রিক দেশে পরিনত করতেও কেজিবি এর হাত ছিল।

মার্কিনদের পরাজয়ের মোশাল:-কেজিবি

ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল কেজিবি’র ভিয়েতনাম যোদ্ধাদের অস্ত্র সাপ্লাই ও ট্রেনিং দেয়া।

১৯৭১,বাংলাদেশ:- কেজিবি

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে সাহায্যতেও কেজিবি এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

উচ্চপদস্থ নেতা হত্যা:-কেজিবি

অনেক ইন্টারনেশনাল নেতার হত্যার পিছনেও কেজিবি’র হাত রয়েছে।এমনকি মার্কিন প্রসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যায়ও কেজিবি এর হাত আছে বলে ধারণা করা হয়।

পরিশেষে বলবো, সোভিয়েত পলিটবুর‍্যোর সদস্যরা কেজিবিকে একইসাথে প্রতিরক্ষার ঢাল ও তলোয়ার বলে দাবী করতেন।

১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অখন্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো কেজিবি। কেজিবি ছিলো এমন এক গুপ্ত সংস্থা, যা দেশের অভ্যন্তরে সিক্রেট পুলিশ হিসেবে কাজ করতো, আর বহির্বিশ্বে চালাতো গুপ্তচরবৃত্তি।

বর্তমান রাশিয়ার গুপ্ত সংস্থা এফএসবিকে কেজিবির উওরসূরি বলা হয়।।

লেখক : মো: ইসমাইল হোসেন

শিক্ষার্থী

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সাহায্য নেওয়া হয়েছে:-

•Roar media
•Foreign policy
•Bd-protidin newspapers-tania tusti
•kolkata times
•wikipedia