পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন যারা নিজের জন্য বাঁচে, আর কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের কল্যাণের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেন। যদিও অধিকাংশ মানুষই নিজের জীবনের প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত থাকেন, তারপরও এমন কিছু মানুষ আছেন যারা সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগে দ্বিধা বোধ করেন না।

এমনই এক ব্যক্তি হচ্ছেন অধ্যাপক ড. খন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানী। তিনি বিদেশের বিলাসবহুল এবং আরামদায়ক জীবনের মোহ ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন বিদেশের উচ্চশিক্ষা যদি দেশের ও জাতির কল্যাণে ব্যবহার না করা হয় তবে তা নিজ অর্থবহতা অর্জন করতে পারবে না।

তিনি একাধারে একজন বিজ্ঞানী, একজন উদ্ভাবক, একজন উদ্যোক্তা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ফিজিক্স এবং টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন।

অধ্যাপক ড. খন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানীর উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এবং ১৯৭০ এ তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করার পর, ১৯৭৮ সালে তিনি কমনওয়েলথ স্কলার হিসেবে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্সে তার পিএইচডি অর্জন করেন।

যুক্তরাজ্যে থাকার সময়, ব্রিটিশরা কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতো তা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সেখানেই বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল – আমাদের জীবনযাত্রায় প্রযুক্তির অনাব্যবহার। তিনি বলেন, “আমাদের দেশের পিছিয়ে থাকার কারণ মূলত প্রযুক্তি থেকে আমাদের দূরে থাকা।

বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের প্রতি আমাদের ঝোঁক বেশি, যা আমাদের একটি বড় ভুল। তাই, আমি স্থানীয়ভাবেই উন্নত প্রযুক্তি তৈরির কথা ভাবতে শুরু করেছি, যা সকল বাংলাদেশির জীবনমান উন্নত করবে।”

এই বিষয়ে তার চিন্তাভাবনা জানতে চাইলে, তিনি এই কথাই উল্লেখ করেছিলেন যে কীভাবে এই দৈনন্দিন উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পগুলো বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটিশদের উল্লেখ করে বলেন, তারা সবসময়ই প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো সমাধান করার একটি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।

এই চর্চা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে এবং তাদের জন্য জিনিসগুলো সহজ করেছে। এর মধ্যে কিছু উদ্ভাবন প্রায়ই বাণিজ্যিক প্রচেষ্টায় পরিণত হয় এবং সেখান থেকে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠে, যা পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে।

অধ্যাপক রাব্বানী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, দেশীয় উদ্ভাবনার মাধ্যমে খুব সহজেই স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। “আমাদের দেশের সমস্যা পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা আমাদের মতো করে বুঝতে পারবে না, তাই আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্স যার উপর আমি পিএইচডি করেছিলাম, তা বাংলাদেশে খুব একটা কাজে আসবে না।

এমনকি ইংল্যান্ডেও এই বিষয়ের প্রয়োগক্ষেত্র খুব সীমিত ছিল। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, আমি আমার পিএইচডি পড়াশোনাকে নিয়ে আর আগাবো না কারণ IC Chips বানানো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তখনো সম্ভব ছিল না, এবং পরবর্তী কয়েক দশকে হবার সম্ভাবনা-ও ছিলো না।”

সেই সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার সুবাদে ড. রাব্বানীর শিক্ষক এবং সহকর্মী প্রফেসর এম শামসুল ইসলামের থেকে তিনি কাজের প্রস্তাব পান। তখন প্রফেসর ইসলাম তার BCSIR এক সহকর্মীর সাথে মিলে পালস্ড ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রয়োগে মানবদেহের ভাঙ্গা হাঁড় জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছিলেন।

তার অনুরোধে, অধ্যাপক রাব্বানী একটি ত্রুটিপূর্ণ বিদেশি মেডিক্যাল মেশিন ব্যবহারের অপর্যাপ্ততায়, দেশীয় সরঞ্জাম দিয়ে নতুন একটি মেশিন তৈরি করেন। ৫৫,০০০ টাকা খরচ করে আমদানি করা এই যন্ত্র মেরামত করে নতুন করে তৈরি করতে তার খরচ হয় মাত্র ১০০০ টাকা।

এই যন্ত্রটি সেসময় পঙ্গু হাসপাতাল (NITOR) এ প্রায় ২ বছর ১৬ জন রোগীর উপর ব্যবহার করা হয়েছিল এবং এই যন্ত্রটি দিয়ে তাদের প্রায় সব ভাঙ্গা হাঁড় জোড়া লাগানো সম্ভব হয়েছিলো।

তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলো হল: গ্রামীণ এলাকায় নিরাপদ পানির জন্য কম খরচে সোলার ওয়াটার পেস্টুরাইজার, অতিরিক্ত ঘামের চিকিৎসার জন্য ইলেকট্রিকাল থেরাপি ডিভাইস, কম্পিউটারাইজড ইএমজি ডিভাইস, ডায়নামিক পেডোগ্রাফ, ডিজিটাল মাইক্রোস্কোপ, ইলেক্ট্রো-হেলথ ডিভাইস, ইন্ট্রা-অপারেটিভ নিউরোমনিটর, এবং টেলিমেডিসিন প্রযুক্তিযুক্ত ডায়াগনস্টিক ডিভাইস।

জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় উদ্ভাবন উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের প্রত্যেকটি কাজ ছিলো মানুষের জন্য এবং তাই এই প্রত্যেকটি উদ্ভাবনই আমাদের জন্য মূল্যবান এবং স্মরণীয়”। তিনি তার অবদানের জন্যে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি প্রদত্ত স্বর্ণপদক অর্জন করেন।

‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি টেলিমেডিসিন প্রোগ্রাম’ ব্যানারের আওতায় অধ্যাপক রাব্বানীর নেতৃত্বাধীন গ্রুপের তৈরি দেশীয় টেলিমেডিসিন প্রযুক্তির প্রসারের মাধ্যমে তারা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে ৩০,০০০ হাজারের অধিক রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে পেরেছেন।

তিনি বাংলাদেশে টেলিমেডিসিনে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্যা ইনফরমেশন সোসাইটি (WSIS) এবং ২০১৮ সালে তৃতীয় কমনওয়েলথ ডিজিটাল অ্যাওয়ার্ড-সহ দেশ -বিদেশে আরো অনেক স্বীকৃতি এবং পুরস্কার লাভ করেন।

অধ্যাপক রাব্বানী আরো বলেন, আমাদের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদেরকে উৎসাহ দিতে হবে যেনো আমাদের দেশীয় উদ্ভাবন জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা সম্ভব হয়, এবং প্রয়োজনে আমাদের বর্তমান শিল্পক্ষেত্রকেও এজন্য এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের বর্তমান শিল্পক্ষেত্রের জন্য অতি জরুরি হচ্ছে দেশীয় মেধা ও দক্ষতা প্রয়োগের সুযোগ কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি করে দেয়া, যে মানসিকতা অনেকক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পারছি না। এই উপলব্ধি অধ্যাপক রাব্বানীকে বিজ্ঞানী থেকে একজন উদ্যোক্তায় রূপান্তর করেন এবং তিনি BI-BEAT নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

এটি একটি নন-শেয়ারহোল্ডিং কোম্পানি যেখানে সমস্ত মুনাফা ব্যবসা সম্প্রসারণ, গবেষণা, দাতব্য বা অনুদানে যায়। “আমরা একটি অনন্য ধারা অনুযায়ী কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেছি, যা বাংলাদেশের প্রচলিত শিল্পক্ষেত্রের জন্য একটি অভিনব অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কোম্পানির কোন নির্দিষ্ট মালিক নেই, কেও লাভের ভাগ নিতে পারে না।

“ এই মডেলটি বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাধীন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং BI-BEAT এর মত প্রতিষ্ঠানদের মাঝে সংযোগ স্থাপন করবে।

এই মডেলে BI-BEAT প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করবে অন্য দুই প্রতিষ্ঠানের জন্যে। আমাদের বিশ্বাস যে আমরা সফল হলে এই মডেলটি আমরা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও প্রয়োগ করতে পারবো, কারণ তারাও আমাদের মত একই ধরণের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।“

অধ্যাপক রাব্বানী বিশ্বাস করেন, দেশের ক্ষুদ্রশিল্পের কারিগর এবং মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সংযুক্ত না করলে প্রযুক্তিগত বিপ্লব অর্জন করা সম্ভব হবে না। এই জনগোষ্ঠীকে তিনি দেশের শিকড় হিসেবে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আহ্বান করেন তাদের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করার।

তিনি বলেন, এর মাধ্যমে আমাদের জ্ঞান এবং প্রযুক্তির সংমিশ্রণ হবে, যা এসকল ক্ষুদ্র শিল্পগুলোকে বৃহৎ শিল্পে রুপান্তর করবে, এবং পরবর্তীতে শিল্প ও শিক্ষার এক অনন্য মেলবন্ধন সৃষ্টি করবে।

একইসাথে তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমাদের দেশে বিদ্যমান মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পকে লক্ষ্য করে আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়, কারণ এসকল শিল্পক্ষেত্র বিদেশের প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং এখানে স্থানীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিভার অবদান রাখার প্রায় কোন অবকাশ নেই।

এই ব্যাপারে তিনি আমাদের কৃষিখাতের কথা উল্লেখ করে বলেন যে,

“বাংলাদেশে কৃষির বিকাশ একটি বিস্ময়কর সাফল্যের গল্প, যা সম্ভব হয়েছে কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থানীয় কৃষকদের সাথে তাদের আবিষ্কার এবং প্রযুক্তি সংযুক্ত করতে পেরেছে। এই শিল্প-প্রযুক্তির বন্ধনের ফলেই কৃষিখাত ৫০ বছর আগে যেখানে ছিল সেখান থেকে আজকে এ জায়গায় আসতে পেরেছে।”

অধ্যাপক রাব্বানী একজন নিঃস্বার্থ উদ্ভাবক যিনি তার কাজের পেটেন্ট করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, বিজ্ঞানকে বাণিজ্যিকীকৃত করা উচিত নয়, বিজ্ঞান সর্বসাধারণের জন্যে।

তিনি বলেন,

“বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের অন্যতম কারণ হল প্রযুক্তির সেবা-বন্টনের বিশাল বৈষম্য, যার জন্য আমি পেটেন্ট এর ধারণাকে অনেকখানি দায়ী করি”। অধ্যাপক রাব্বানী ১৯৯৪ সালে ‘ভোল্ট গার্ড’ আবিষ্কারের পেটেন্ট করার পর থেকে তার অন্য কোনো আবিষ্কারের পেটেন্ট করেননি।

২০১২ সালে একটি সুইস কোম্পানি অধ্যাপক রাব্বানীর উদ্ভাবন, এফআইএম (FIM) -এ বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল এই শর্তে যে, তিনি এই উদ্ভাবনের জন্য আগে থেকেই একটি পেটেন্ট নেবেন। অধ্যাপক রাব্বানী বিনয়ের সাথে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ তিনি তার পেটেন্ট না করার সিদ্ধান্তে ছিলেন প্রতিশ্রƒতিবদ্ধ।

স্বার্থত্যাগের উপর গুরুত্বারোপ করে, এই উদ্ভাবক তরুণদেরকে নিঃস্বার্থভাবে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে অবদান রাখার আহ্বান জানান। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি বলেন,

“যদি আমরা পিছনে ফিরে তাকাই, তাহলে আমরা দেখবো যে, যেই মুহূর্তগুলোয় আমরা স্বার্থপরতার আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই মুহূর্তগুলো আমাদেরকে যন্ত্রণা দেয়। যেসব ক্ষেত্রে আমরা নিঃস্বার্থ ছিলাম তা আমাদের সুখের অনুভূতি দেয়। জীবনের বড় বড় সুখের অনুভুতিগুলো আমাদের ত্যাগের মুহূর্তের সাথেই জড়িত।”

তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা গবেষণার অর্থায়নের জন্যে চিন্তা না করে, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের চারপাশের সমস্যাগুলি সমাধান করার জন্যে গবেষণা শুরু করে। বড় সমস্যার সমাধানের জন্যে অর্থায়নের দিকে তাকিয়ে না থেকে, চারপাশের ছোটখাটো দৈনন্দিন সমস্যাগুলো সমাধান দিয়েই তাদের শুরু করা উচিত।

Writer: মোঃ আজহার সিদ্দিইক মেহরাজ

[আমাদের ই ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা পড়তে ভিজিট করুন এই লিংকে ]