দিনটি ছিল ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট। রোম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের জন্য অপেক্ষমান অন্য যাত্রীদের সঙ্গে বসে আছে এক আরব তরুণী।
গৌরবর্ণের গোলগাল চেহারা দেখলে মনে হবে বেশ শান্তশিষ্ট। কিন্তু তরুনীটির ভেতরে তখন তুমুল উত্তেজনা কাজ করছে। উত্তেজনা যাতে চেহারায় প্রকাশ না পায়, এজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।
খানিকপর ভয়ানক এক অপারেশন করবে সে। অপারেশন শুরুর আগ পর্যন্ত বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে এর সামান্যতম আভাসটুকুও বুঝতে দেওয়া যাবে না।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে তরুণীটি অনেক কায়দা করে তার শরীরে স্বয়ংক্রিয় বোমা ও অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। দুরু দুরু কাঁপছে তার বুক, এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম! কিন্তু চেহারায় ভয়ের ছিটেফোঁটাও প্রকাশ হতে দিচ্ছে না। একদম শান্ত স্বাভাবিক ভদ্র যাত্রীর মতো বসে আছে লাউঞ্জে।
অদূরেই আরেকটি বেঞ্চে বসে আছে এক আরব যুবক। দেখলে মনে হবে তরুণীটির সঙ্গে তার কোনো চিন-পেহচান নেই। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। যুবকটি তরুণীর অপারেশনের সহযোগী। সন্দেহের চোখ এড়াতেই একজন আরেকজন থেকে আপাতত দূরত্ব বজায় রেখেছে।
বোর্ডিং পাসসহ বিমানবন্দরের নিয়মিত কার্যাদি চুকানো হয়ে গেছে তাদের। এখন কেবল বিমানের অপেক্ষা।
একটু পরই নিউইয়র্ক থেকে আসা টিডব্লিউএ ৮৪০:৭০৭ বোয়িং বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে বিমানটি আবারো উড়াল দেবে আকাশে। এথেন্সে একটি যাত্রা বিরতি করে চলে যাবে ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিবে।
আরব এই তরুণ ও তরুণী এই বিমানেরই টিকিট কেটেছে।
ভিসা-পাসপোর্ট-টিকিটে তরুণীটির নাম ‘ক্যাপ্টেন শাদিয়া আবু গাজালা’ এবং তার সহযোগী তরুণের নাম সেলিম ইসায়ি। দুজনই ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) এর একনিষ্ঠ কর্মী।
পিএফএলপি এর পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আজ ইসরাইলগামী ৭০৭ বিমানটি ছিনতাই করবে। নিউইয়র্ক থেকে এ বিমানে করে ইসরাইলের আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আইজ্যাক রবিনের ফেরার কথা।
আইজ্যাক রবিন ছিলেন ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তিনি। ক্যাপ্টেন শাদিয়ার মূল টার্গেট ছিল আইজ্যাক রবিন। বিমান ছিনতাইয়ের মাধ্যমে তাঁকে জিম্মি করতে পারলে ইসরাইল প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খাবে। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করা হবে অনেক দাবি-দাওয়া। সঙ্গে ইসরায়েলি কয়েদখানায় বন্দী কিছু ফিলিস্তিনিকেও মুক্ত করা সম্ভব হবে।
নির্ধারিত সময়ে ৭০৭ বোয়িং বিমানটি রোম বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করল। যাত্রীদের উঠানামা শেষ হলে খানিক পর আবার উড়াল দিল আকাশে।
বিমানটিতে তখন ১৪০ জন যাত্রী। তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন শাদিয়া ও তার সহযোগী সেলিম ইসায়িও আছে। কিন্তু তাদের মূল স্বীকার আইজ্যাক রবিন কেন যেন এই বিমানে আসেননি।
মূল নিশানা মিস হওয়ায় ক্যাপ্টেন শাদিয়ার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সিদ্ধান্তে অনড় রইল -বিমান ছিনতাই করবেই।
আইজ্যাক রবিন না এলে কি হলো, ইসরাইলের আরো যাত্রী আছে, এদের জিম্মি করেই অনেক কিছু আদায় করা যাবে। তাছাড়া পুরো বিশ্বে একটা হইচই ফেলা যাবে। বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া যাবে, ফিলিস্তিনিরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য যেকোনো ভয়ঙ্কর পন্থা অবলম্বন করতেও পিছপা হয় না।
বিমান তখন তির গতিতে উড়ে যাচ্ছিল এথেন্স অভিমুখে। ক্যাপ্টেন শাদিয়া তার সিটবেল্ট খুলে ফেলল। চোখে চোখে কথা হল সহযোগী সেলিম ইসায়ির সঙ্গেও। কাজ শুরু করতে হবে। দুজনই নিজ নিজ আসন থেকে উঠে সোজা বিমানের ককপিটে চলে গেল।
পাইলট আপনমনে বিমান চালানোয় মশগুল। ঘাড়ের নিচে শীতল কিছু একটার স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো সে। স্পর্শটা ক্যাপ্টেন সাদিয়ার বন্দুকের নলের। পাইলট ফিরে তাকাতেই ক্যাপ্টেন সাদিয়া শান্ত-শীতল শক্ত কন্ঠে নির্দেশ দিল, ‘বিমানের গতি এথেন্স থেকে ঘুরিয়ে তেলআবিব মুখী করে দাও।’
পাইলট কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। বিলম্ব দেখে শাদিয়ার শান্ত-কঠোর কন্ঠ আবারও বেজে উঠলো, ‘ভালো চাও তো যা বলছি ঠিকঠাক মতো করো, নইলে পুরো বিমান উড়িয়ে দেব। ফিলিস্তিনি মুক্তিকামীরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে তবেই কোন অপারেশনে নামে, মনে রেখো।’
বন্দুকধারী তরুণীর কথা পাইলটের একটুও মিথ্যে মনে হলো না। সে ভালো করেই জানে এদের প্রাণের মায়া বলতে কিছু নেই। বাধ্য ছেলের মত সে বিমানের গতি পরিবর্তন করে তেল আবিবমুখী করে দিল।
এদিকে সেলিম ইসায়ি বিমানের অন্য কর্মচারীদের হুঁশিয়ার করে দিল, ‘কোন প্রকার চালাকির চেষ্টা করবে না, ভালো চাও তো যা বলি শুনবে। অন্যথায় পুরো বিমান উড়িয়ে দেয়া হবে। স্বয়ংক্রিয় বোমা কিন্তু আমাদের শরীরেই সেট করা আছে।
পাইলট বিমানের গতি পরিবর্তন করার পর ক্যাপ্টেন শাদিয়ার কন্ঠ শোনা গেল বিমানের সাউন্ডবক্সে: ‘সম্মানিত যাত্রী মহোদয়গণ, অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমরা আপনাদের দুঃসংবাদ দিচ্ছি যে বিমানটি এখন ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি)-এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে । তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য তারা এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের দাবি মেনে নেয়, তবে আপনাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। অন্যথায় পরিণতি কি হবে, সময় বলে দেবে।’
ভয়ে-আতঙ্কে একেবারে পাংশু হয়ে গেল যাত্রীদের চেহারা। কি হবে এখন! মৃত্যু ছাড়া বোধহয় আর কোন উপায় নাই। ক্যাপ্টেন শাদিয়া সব বিমানঘাঁটিতে জানিয়ে দিল তার বিমান ছিনতাইয়ের এর খবর। ইসরাইল ও তার মিত্র দেশগুলো পেরেশান হয়ে ওঠে।
ইসরায়েলি কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়্যারলেসে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছিল ক্যাপ্টেন শাদিয়াকে। শাদিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ভালো চাও তো গালিগালাজ বন্ধ করো। বিমান ও বিমানের যাত্রীদের অক্ষতভাবে ফেরত চাইলে আমি যা বলি, পালন করো। কন্ট্রোল রুম থেকে ঘোষণা করো, নিউইয়র্ক থেকে আসা টিডব্লিউএ ৮৪০:৭০৭ বোয়িং বিমান ফিলিস্তিনি মুক্তিকামীদের সংগঠন পিএফএলপি তাদের বৈধ দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য ছিনতাই করেছে। কথামতো কাজ না করলে এখনই বিস্ফোরণ ঘটাব বিমানে। ‘
ইসরাইলি কন্ট্রোল রুমে বসা লোকটি অগত্যা ঘোষণাটি পাঠ করল। মুহূর্তেই পুরো দুনিয়ায় চাউর হয়ে গেল ফিলিস্তিনি এক নারীর দুঃসাহসিক অভিযানের কথা।
বিমান তখন ফিলিস্তিনের আকাশে। ইসরাইলি দুইটি জঙ্গিবিমান সেটাকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। কোন কাড়াকাড়ি করলেই ক্যাপ্টেন শাদিয়া তার দেহে বেঁধে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটাবে।
বিমানের যাত্রীদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেছে। এদিকে ইসরায়েলিরা কোনক্রমেই চাচ্ছিল না বিমানটি তেল আবিব বিমানবন্দরে অবতরণ করুক। চরম উত্তেজনার ভেতর সময় পার হচ্ছে।
মধ্যস্থতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে এল। ক্যাপ্টেন শাদিয়া ও তার সহযোগী সেলিম ইসায়িরও তেলআবিবে অবতরণের তেমন ইচ্ছে ছিল না
তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলিদের একথা জানিয়ে দেওয়া-আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য জীবনকেও তুচ্ছজ্ঞান করি। জিবন দেব, তবুও তোমাদের বশ্যতা আমরা স্বীকার করব না। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছেও এ বার্তা পৌঁছে দেওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে ইসরাইল কখনোই আমাদের বস করতে পারবে না। ফিলিস্তিনিরা তাদের মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য যেকোনো ভয়ঙ্কর পথ অবলম্বন করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
ক্যাপ্টেন শাদিয়ার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ইতিমধ্যে পুরো বিশ্ব জেনে গেছে তাদের দুঃসাহসিক কার্যক্রমের কথা। এখন আর বিমান কোথায় অবতরণ করবে এ নিয়ে ক্যাপ্টেন শাদিয়ার ততটা আগ্রহ নেই। কিন্তু হঠাৎ তার মনে একটা উদগ্র আকাঙ্ক্ষা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মাতৃভূমি দেখার আকাঙ্ক্ষা।
ক্যাপ্টেন শাদিয়ার জন্মভূমি বর্তমান ইসরাইলের হাইফা শহর। সেই চার বছর বয়সে এই শহর থেকে বিতাড়িত হয়ে তার পরিবারের সঙ্গে হিজরত করে এসেছিল, তারপর আর কখনো সেখানে যাওয়া হয়নি।
তখন বিমান ইসরাইলের আকাশে উদ্দেশ্যহীন উড়ছিল। ক্যাপ্টেন শাদিয়া পাইলটকে নির্দেশ দিলে হাইফা শহরের দিকে নিয়ে যেতে। পাইলট খানিক ইতস্ততার সঙ্গে আমতা আমতা করে বলল, ‘কিন্তু ম্যাডাম, হইফায় তো কোনো বিমানবন্দর নেই!’
ক্যাপ্টেন শাদিয়া কঠিন গলায় বলল, ‘যা বলেছি, করো। দ্বিতীয় কোনো কথা বলবে না। আর শোনো, হাইফায় ঢোকার পর বিমান যথাসম্ভব নিচ দিয়ে চালাবে। আমি আমার জন্মভূমি খুব কাছ থেকে দেখতে চাই।’
ক্যাপ্টেন শাদিয়ার শক্ত-কঠিন কণ্ঠস্বর হঠাৎ ভিজে উঠল। শেষের কথাগুলো কান্নার মতোই শোনাল। বিমানের পাইলট অবাক হয়ে চকিতে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার মনোযোগ দিলো আপন কাজে। বিমান ঘুরিয়ে দিল হাইফা অভিমুখে।
হাইফার আকাশে যথাসম্ভব নিচু হয়ে শহরটি দুবার প্রদক্ষিণ করল ৭০৭ বিমানটি। হাতে তাজা গ্রেনেড নিয়ে দুনিয়ার তাবৎ কুৎসিতকে ভুলে গিয়ে বিমানের জানালায় মুখ লাগাল ক্যাপ্টেন শাদিয়া। জানালার বাইরের দৃশ্যের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
চোখের শিশিরবিন্দুর মতো জল টলমল করছে শাদিয়ার। এই তো, এই তো তার জন্মশহর হাইফা। ছোট-বড় খেজুর গাছ আর ধূসর রঙের বালু তাকিয়ে আছে তার দিকে। ওরা কি ডাকছে তাকে? তাদের বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় ছিল, ঠাহর করার চেষ্টা করল শাদিয়া, পারল না। আচ্ছা তাদের বাড়িঘর কি আছে এখনো? প্রশ্নটা মনে আসতেই আপন মনে হাসে শাদিয়া। সে হাসির রংটা বড় করুন।
দীর্ঘ ২০ বছর পর শাদিয়া তার জন্মভূমির দেখা পেল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এত কাছে এসেও জন্মভূমির মাটি স্পর্শ করার সুযোগ হলো না তার।
মাতৃভূমিকে চোখ ভরে দেখার পর এবার দামেস্কের উদ্দেশ্যে বিমান চালানোর নির্দেশ দিল শাদিয়া। বিমান ঘুরে গেল দামেস্কের দিকে।
কিছুক্ষণ পর দামেস্ক বিমানবন্দরে অবতরণ করল শাদিয়ার অপহরণকৃত বিমান। পিএফএলপি ইসরায়েলি দুই যাত্রীকে আটক করে বাকিদের ছেড়ে দিল।
পরবর্তী সময়ে এই দুই ইসরায়েলিকে জিম্মি করে ইসরাইলের সঙ্গে বন্দি বিনিময় করে পিএফএলপি।
ক্যাপ্টেন শাদিয়া তার ছদ্মনাম। ৭০৭ বোয়িং বিমানটি ছিনতাইয়ের জন্য ভিসা-টিকেট-পাসপোর্টে নামটি নিয়েছিলেন তিনি। তার আসল নাম লায়লা খালেদ। ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল ফিলিস্তিনের হাইফা শহরে লায়লার জন্ম। ছোট্ট ছিমছাম আর বেশ পরিপাটি শহর হায়ফা। তখন স্বাধীন ছিল শহরটি।
জন্মের পর চার বছর স্বাধীনতা হাইফার আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেন। তারপর আসে ১৯৪৮ সাল। ফিলিস্তিনের বুকে তৈরি হয় নতুন এক রাষ্ট্র ইসরায়েল। দখল হতে থাকে একের পর এক ফিলিস্তিনের স্বাধীন শহরগুলো।
অন্যান্য শহরের মতো হাইফাও দখল হয়ে যায়।
লাখ লাখ স্থানীয় আরব মুসলিমরা বাস্তুচ্যুত হয়। কিছু আরব মুসলিম এসব নির্যাতন সহ্য করেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকে নিজের বাপ-দাদার ভিটায়।
জন্মভূমি ছেড়ে দিতে এত সহজে কি কারো মন চায়। লায়লার পিতা-মাতা ও মাটি কামড়ে হাইফাতেই থেকে গেলেন।
গুলি-বোমা আর গ্রেনেডের কানফাটা আওয়াজ এর ভেতর লায়লা বেড়ে উঠতে লাগলেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্য থেকে জীবনযাপন কতদিন আর সম্ভব? সন্তানসন্ততি এমনকি নিজের প্রাণেরও এক মুহূর্তের নিরাপত্তা নেই। এই চিন্তা থেকেই লায়লার পিতা সিদ্ধান্ত নিলেন স্ত্রী-সন্তানকে দক্ষিণ লেবাননে পাঠিয়ে দেবেন। আর নিজে থেকে যাবেন হাইফায়।
জীবনবাজি রেখে আমৃত্যু লড়ে যাবেন দখলদারিত্ব ইসরাইলের বিরুদ্ধে। লায়লার মা বেঁকে বসলেন। স্বামীকে রেখে তিনি হাইফা ছাড়বেন না। যেতে যদি হয় তবে সবাই যাবে। স্বামী অনিশ্চয়তার মাঝে থাকবেন আর তিনি সন্তান সন্তানাদি নিয়ে লেবাননে নিরাপদ জীবন যাপন করবেন, হতে পারে না। লায়লার বাবা সন্তানসন্ততির দোহাই দিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে বললেন, ‘এ অনিরাপদ শহর তোমাকে ছাড়তে হবে অন্তত আমাদের বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য। এরা বড় হয়ে আবার ফিরে আসবে, এ ভূমি তাদেরই উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু তোমার সঙ্গে যদি আমিও চলে যাই তাহলে তো এটা প্রিয় জন্মভূমি সঙ্গে গাদ্দারি হবে। আমাকে থাকতে হবে। দখলদার এ বাহিনীর সঙ্গে আমৃত্যু আমি লড়াই করে যাব। ততদিনে আমার ছেলেমেয়েকে তুমি ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধারের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলো।’
লায়লার মা আর কথা বাড়ালেন না। স্বামীকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ লেবাননের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।
সময় বয়ে যেতে লাগলো আর আপন গতিতে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠছিলেন লায়লাও। কিন্তু লায়লা জানতেন না তার বাবা কোথায় আছেন। হাইফা ছাড়ার পর বাবার কোনো খবর পৌঁছায়নি তাদের কাছে। বাবা আছেন নাকি শহীদ হয়ে গেছেন কিছুই জানেন না তারা।
কিশোরী লায়লার ভেতর সেই ছোটকাল থেকেই একটা ঘৃনা জন্ম নিয়েছিল ইসরায়েলিদের প্রতি। ইসরায়েলিদের নাম শুনলেই ঘৃণায় রি রি করে উঠত তার পুরো সত্তা। প্রতিশোধের অদম্য এক আক্রোশ ছড়িয়ে পড়ত শরীরের শিরা-উপশিরায়।
লায়লার বয়স বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয় তার জ্ঞান বুদ্ধি ও চিন্তার পাপড়িগুলো। জন্মভূমি হইফার কথা তিনি ভুলতে পারেন না।
ভুলতে পারেন না ছোটবেলার বন্ধু ও সহপাঠীদের কথা। বাবাকে প্রচন্ড মনে পড়ে লায়লার। মনে পড়লেই চোখ ফেটে কান্না আসে। বাবা কোথায় আছেন? জন্মভূমির জন্য বাবার এত্ত মায়া!
আমাদের দূরে সরিয়ে তিনি যেখানেই পড়ে রইলেন মাটি কামড়ে। স্বাধিকারের জন্য জীবন বাজি রেখে আমাদের থেকে হারিয়ে গেলেন। লায়লা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন তিনি বাবার মত হবেন। বাবার মত নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ইসরায়েলিদের মোকাবেলা করবেন। কিন্তু বাবার মত হারিয়ে যেতে চান না তিনি। তাঁর প্রতিজ্ঞা-তিনি পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন ইসরাইলিদের দখলদারি থেকে উদ্ধার করবেনই।
কৈশোরের সেই প্রতিজ্ঞা লায়লা খালেদ তার তারুণ্যে এসে বাস্তবতায় রূপ দেন। ১৯৬৭ সালে তিনি যোগ দেন ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনে। সংগঠনটি পিএফএলপি নামে পুরো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। এই আলোড়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন লায়লা খালেদ।
পিএফএলপিতে যোগদানের অল্প দিনের ভেতরে তিনি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেন। একজন নারী হয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণে লায়লা যে যোগ্যতা দেখান, কমান্ডার হতবাক হয়ে যান তার পারফরমেন্সে।
তিনি বুঝতে পারেন ভেতরে আগুন পোষা এ তরুণীর দ্বারা ভয়ংকর সব অপারেশনেও সফল হওয়া সম্ভব। লায়লাকে পিএফএলপি আলাদা একটা গুরুত্ব দিতে থাকে। দুঃসাহসী কোনো অপারেশন চালাতে হবে এতরুণীর দ্বারা।
লায়লা তখন প্রতিশোধের আগুনে উন্মাতাল এক তরুণী। ইসরায়েলের নাম শুনলেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে তার ভেতরটা।
বাবার কথা মনে পড়ে তার। এই ইসরাইলিদের কারণে পিতৃআদর থেকে তিনি বঞ্চিত আজ কতদিন! চোখের তারায় ভেসে ওঠে শৈশবের স্মৃতি মাখা হাইফার খেজুরবীথি, জলপাই বাগান, বিকেলে খেলাধুলা আর হই-হুল্লোড়ের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে খেজুরবীথির ধূলিকণায়!
পিএফএলপি তে যোগ দেওয়ার পর প্রশিক্ষণ আর ছোটখাটো অপারেশনের ভেতর দিয়ে লায়লার বছর দুয়েক কেটে যায়। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তিনি দুঃসাহসীক বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন।
তারপর আসে ১৯৬৯ সালের সেই ২৯ আগস্ট। সেই দুঃসাহসী বিমান ছিনতাইয়ের অভিযান। এই ঘটনায় পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন লায়লা খালেদ।
এরপর আবারও তিনি বিমান ছিনতাই করেন। দ্বিতীয় বারেরটা ছিল ১৯৭০ সালে। ইসরাইলি একটি বিমান। বিমানের আরোহী ছিলেন ইসরাইলের বড় এক জেনারেল। জেনারেলকে বিমানেই হত্যা করেন প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ এই দুঃসাহসী তরুণী।
১৯৭০ সালের এ অভিযানটা মোটেই সহজ ছিল না। কারণ, ততদিনে তার মুখটা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারের ফলে সবার কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল।এ জন্য আগের মত কেবল নাম পাল্টিয়ে অভিযান পরিচালনা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু মুশকিলকে যেকোন উপায়ে আসান করতে হবে।
পিছপা হওয়ার পাত্রী তিনি নন। অভিযানে তাকে সফল হতে হবে যেকোন উপায়ে।
লায়লা খালেদ সিদ্ধান্ত নেন তার মুখে প্লাস্টিক সার্জারি করাবেন। মানুষ প্লাস্টিক সার্জারি করে নিজের রূপ বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু তার উদ্দেশ্য মোটেও তা নয়। উদ্দেশ্য কেবল চেহারা পাল্টানো, কেউ যাতে তাকে চিনতে না পারে। ১৯৭০ সালের ভয়ঙ্কর সেই অভিযান নিজের মুখ পাল্টিয়েই তিনি করেছিলেন। পুরো বিশ্ব দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হয়েছিল ফিলিস্তিনের এ আগুনকন্যার দুঃসাহস দেখে।
সুইডিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা লিনা ম্যাকবাউল এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৫৮ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন। লায়লা খালেদ: হাইজ্যাকার নামে এই ডকুমেন্টারিটি ২৮ জানুয়ারি ২০০৬ সালে মুক্তি পায়। এই ডকুমেন্টারিতে লায়লা খালেদের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করেন।
লায়লা খালিদ যখন প্রথম বিমানটি হাইজ্যাক করেন তখন ছিল চে গেভারার যুগ। মাত্র দুই বছর আগে চে গুয়েভারা বলিভিয়ায় মারা যান। সশস্ত্র উপায়ে নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লায়লা খালেদের এই বিপ্লবী প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। সে সময় ছাত্র ও বামপন্থী লোকদের বাড়িতে এই বিপ্লবী নায়কদের ছবি ঝুলাতে দেখা যেত। লায়লা খালেদ প্রথম নারী যিনি দাবি আদায়ে এমন একটি পদক্ষেপ নেয়। অর্থাৎ, লায়লা খালেদ প্রথম নারী যিনি দাবি আদায়ে বিমান ছিনতাই করেন।
ফিলিস্তিনি সংগ্রামের ইতিহাসে লায়লা খালেদ এক উজ্জ্বল তারকার নাম। একজন নারী হয়েও কিভাবে অমন দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই বীরাঙ্গনা।
একসময়কার রক্ত শীতল করা চাঞ্চল্যকর অভিযানের মূল নায়িকা লায়লা খালেদ আজ বার্ধক্যে উপনীত। কিন্তু তার সংগ্রাম আজও থামেনি। নিজের সবটুকু বিলিয়ে আজও তিনি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনকে ইহুদীদের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য।
( ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত )
আরো রেফারেন্স