প্যারিস শহরে পড়াশোনার জন্য এসেছে এক কিশোর। কিন্তু, সে ঠিক শহুরে বাতাসে খাপ খাওয়াতে পারছে না নিজেকে।
হোমসিকনেস খুব গাঢ় করেই তার চেতনায় আঘাত করছে। পড়ার টেবিলে বসে বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে, গ্রামের স্মৃতি ভেসে ওঠে -মাছ ধরা, ছবি আঁকা খুব মিস করে সে।
কিশোরটির নাম লুই পাস্তুর;(ডিসেম্বর ২৭, ১৮২২— সেপ্টেম্বর ২৮, ১৮৯৫)। যিনি ব্যাকটেরিওলোজির জনক, যার জ্ঞান ও গবেষণা সমস্তটুকুই সমর্পিত ছিলো মানুষ এবং দেশের কল্যাণে।
আস্তে আস্তে সে মানিয়ে নেয় নিজেকে। প্রথম জীবনে তিনি মধ্যবিত্ত মানের ছাত্র হলেও, Ecole Normale Superieure থেকে কৃতীত্ত্বের সাথে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন এবং সেখানেই গবেষণা শুরু করেন ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে।
মোলেকিউলার কাইরালিটি এবং অপটিক্যাল আইসোমারিজম সম্পর্কে প্রথম এক্সপ্লানেশান পাওয়া যায় তার কাছেই।
১৮৫৪ সালে তাকে University of Lille এর সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডীন করা হয়। তখন ফ্রান্সের মদ শিল্পের এক চরম সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসে এক ছাত্র। মদের অম্লতার কারণে অনেক মদ নষ্ট হয়।
পাস্তুর তখন গবেষণার পরে বললেন, বিভিন্ন মাইক্রোঅর্গানিজমের আক্রমণের কারণেই এই ওয়াইন টকে যায় এবং এর প্রতিকারও করলেন তিনি, যাতে মাইক্রোবসগুলো ধ্বংস করে ওয়াইনগুলো সুস্থ রাখা যায়।
এই পদ্ধতিতে দুধ সংরক্ষণের কথাও বলেন তিনি। যা পাস্তুরাইজেশান নামে এখনো পৃথিবীতে প্রচলিত। এছাড়া তার ফার্মেন্টেশান নিয়ে কাজ মদশিল্পকে আরও উন্নত করে।
কিন্তু পাস্তুরের অবদান এখানেই শেষ নয়, এ কেবল শুরু।
এরপর তিনি ফ্রান্সের রেশমশিল্পেকে বৃহৎ ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। অ্যান্থ্রাক্স ও মুরগীর কলেরায় পুরো পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি যখন মহামারীতে আক্রান্ত তখন পাস্তুর আবিষ্কার করলেন ভ্যাক্সিন।
যা ফ্রান্সকে অনেক সমৃদ্ধশালী ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করে। কিন্তু তখনও তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বাকী ছিলো।
তখনকার যুগের এক ভয়ংকর রোগ ছিলো হাইড্রোফোবিয়া । কি মর্মান্তিক মৃত্যুই না ঘটত এ রোগে। মস্তিষ্ক বিকৃত অবস্থায় মৃত্যু! রোগী অবসন্ন হয়ে পড়তেন, তৃষ্ণা পেলেও জলের সংস্পর্শে আসা সম্ভব হতো না।
এ ভয়ংকর রোগেরও ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করে ফেললেন এই বিজ্ঞানী। কিন্তু প্রয়োগের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না কারণ এই ভ্যাক্সিন নিয়ে এখনো পুরোপুরি গবেষণা সম্পন্ন হয়নি।
মানবদেহে এটি কীভাবে প্রয়োগ করা যায় সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। কিন্তু তিনি একরকম ঝুঁকি নিয়েই ভ্যাক্সিন প্রয়োগ শুরু করেন এক রোগীর দেহে। কয়েকটি ডোজ প্রয়োগের মধ্যেই ছেলেটি সুস্থ হতে শুরু করলো।
প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলো পাস্তুরের সৃষ্টি। চারিদিকে পাস্তুরের জয়জয়কার শুরু হয়ে গেল।
যদিও তাকে নিয়ে অনেক কন্ট্রোভার্সি আছে। অনেকেই বলেছেন যে, একজন গবেষক যার নেই কোনো মেডিকেল লাইসেন্স সে কীভাবে একজন মানুষের ওপর ভ্যাক্সিনেশান শুরু করেন?
কিন্তু আমি বলব, রিস্ক নেয়া ছাড়া বড় কাজের সফলতাও পাওয়া যায় না। তিনি যদি ওই বালকটির মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে থাকতেন রিস্ক না নিয়ে তাহলে হয়তো ছেলেটিকে মৃত্যুর সাথেই সাক্ষাৎ করতে হতো, গবেষণা পিছিয়ে যেত, প্রাণ হারাতো অনেক মানুষ।
তারপরেও অনেকেই ক্রিটিসাইজ করেছে এই ব্যাপার নিয়ে, কিন্তু তাতে কি? নিন্দুকেরা নিন্দা করবেই।
তার কাজের জন্য অনেক অনেক সম্মাননা ও পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি । ১৮৯২ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর তার জন্মদিন উপলক্ষে অভিনন্দন জানানোর জন্য দেশ বিদেশের অনেক বিজ্ঞানী জড়ো হয়েছিলেন ফ্রান্সে।
তার নামে প্যারিসে প্রতিষ্ঠা হয়েছে পাস্তুর ইনস্টিটিউট৷ আমৃত্যু তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ফ্রান্সের তৃতীয় নেপোলিয়ন তাকে বলেছেন, “ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ সন্তান।”
~ মো.রাকিবুল হাসান