ছোটবেলায় মানুষ কতকিছু হতে চায়! ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, অভিনেতা, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে আইসক্রিমওয়ালা পর্যন্ত কত বিচিত্র সব স্বপ্ন! বড় হতে হতে দেখা যায় একটা একটা করে স্বপ্নের দরজা বন্ধ হতে শুরু করে। ক্লাস ফাইভে থাকতে তোমার সামনে সব দরজা খোলা ছিল, ক্লাস নাইনে এসে সায়েন্স-কমার্স-আর্টসের যেকোন একটি নিতে হলো তোমাকে, বন্ধ হয়ে গেল অন্য দরজাগুলো! এভাবে জীবনে প্রতি ধাপে পা বাড়ানোর সাথে সাথে স্বপ্নগুলোও অনেক সীমিত হয়ে আসে।
▪যে লোকটি ছোট থাকতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিল সে কিন্তু কর্মজীবনে এসে চাইলেই হুট করে চাকরি ছেড়ে রাজনীতি করা শুরু করতে পারে না! তার বেতনের উপর গোটা পরিবারের খাওয়াপরা সহ অনেক কিছু নির্ভর করে, জীবনের বাস্তবতায় তাকে অনেক স্বপ্নের কথা ভুলে থাকতে হয়। নতুন কিছু শুরু করতে অনেক ঝুঁকি আর বিপদের সম্ভাবনা ঘিরে ধরে, সেটি কাটিয়ে উঠার জন্য অনেক সাহস আর অনেক অনেক উদ্যম প্রয়োজন, সেটি সবার থাকে না।
▪কিন্তু কারো কারো থাকে; সব প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সত্যিকারের সকল কাজের কাজী হতে জানেন তারা! আজ তেমনই একজনের গল্প বলবো তোমাদের।
▪উইসকন্সিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি
মারিসা মেয়ারের (Marissa Mayer) জন্ম ১৯৭৫ সালে, উইসকন্সিনের এক ছোট্ট শহরে। ছোট্ট মারিসা স্বভাবে অসম্ভব চঞ্চল, সবকিছুতে তার দারুণ আগ্রহ। “এটা কেন হলো, ওটা কিভাবে কাজ করে?” সারাক্ষণ তিড়িংবিড়িং প্রশ্ন করে সবাইকে অতিষ্ঠ করে তোলে সে! অবশ্য তাতে কেউ আপত্তি করতো না। বরং প্রকৌশলী আর শিক্ষক বাবা-মা তাকে বরাবরই উৎসাহ দিয়ে যান বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানতে, নতুন নতুন জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে।
▪বাবা-মায়ের সম্মতি যখন আছে, মারিসাকে আর পায় কে! ভর্তি হয়ে গেল বেলি নাচের কোর্সে, স্কুল শেষে ছুটলো আইস স্কেটিং খেলতে, অবসরেও তাকে ঘরে পাওয়া যায়না, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় স্কুলের সেরা প্রতিনিধি হিসেবে তখন সে শহরের বাইরে!
▪এত কিছুর মাঝেও পড়ালেখাটা মারিসা বরাবরই অনেক গুরুত্বের সাথে করতো। জীবনে সফল হতে যে অনেক অনেক জ্ঞানের প্রয়োজন। তাই শুধু ক্লাসে ভাল করার জন্য নয়, জানার আগ্রহেই ক্লাসের সব বই পড়ে ঝারাঝারা করে ফেলে সে! অঙ্ক আর বিজ্ঞানে তার বেজায় আগ্রহ, এগুলো পড়তে বসলে সে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়, বিজ্ঞানের অপার বিস্ময়ের জগত ছোট্ট মেয়েটিকে একদম অবাক করে দিতো!
▪মারিসার অবশ্য ইচ্ছে ছিল বেলি ড্যান্সার হওয়ার। একটু বড় হয়ে সেটা বদলে ইচ্ছে ঠিক হলো ডাক্তার হওয়ার। তারপর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে তার পরিচয় হলো আজব এক যন্ত্রের সাথে। টিভির মত একটা বাক্স, সেটা দিয়ে যা খুশি করা যায়, কি মজার ব্যাপার! ‘কম্পিউটার’ নামের এই জাদুর বাক্স মারিসাকে এতটাই প্রভাবিত করলো যে ডাক্তারি পড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়বে!
▪পাশ না করতেই ১৪টি চাকরির অফার
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মারিসা দর্শন, মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব আর কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করলেন! তবে সময়গুলো কিন্তু কেবল বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজেই কাটেনি, সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন, বিতর্ক সবখানেই ছিল তার সরব উপস্থিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে বেলি নাচে মুগ্ধ করা মেয়েটি ছুটে যেতেন সুদূর বারমুডায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে, অসহায় শিশুদের জীবনে একটু সুখের ছোঁয়া আনতে শিশু হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকের কাজেও তার নাম সবার আগে।
▪এমন অনেক কৃতিত্বের পাশাপাশি মারিসা ইন্টার্ন করতে যোগ দিলেন দুইটি বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে, সেখানে কাজ করার সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর তার বিভিন্ন আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে গেল সবখানে।
▪বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসলেন, এমন গুণী মেয়ে তো লাখে একটা মেলে না! তাই তো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে বের হতে না হতেই মারিসার দোরগোড়ায় কড়া নাড়লো ১৪টি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের মোটা বেতনের লোভনীয় সব চাকরির প্রস্তাব!
▪অবাক করা এক সিদ্ধান্ত
তোমার কাছে এতগুলো চমৎকার লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব আসলে কি করতে? নিশ্চয়ই দেখে-শুনে যাচাই করে সবচেয়ে ভাল প্রস্তাবটা গ্রহণ করতে। সবাই হলে হয়তো তাই করতো, কিন্তু মারিসা যে ভিন্ন ধাতের মানুষ! গৎবাধা জীবনে তার মন কখনোই টিকেনি, তাই তিনি এত লোভনীয় সব প্রস্তাব ঠেলে যোগ দিলেন নিতান্তই অখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানে, যার নামও কেউ কোনদিন শোনেনি। সবাই হায় হায় করে উঠলো, এ কি করলে মারিসা! অবশ্য মানুষকে দোষও দেওয়া যায় না, মারিসা যখন চাকরিতে যোগ দিলেন তখন দেখা গেল তাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মোট কর্মী মাত্র বিশজন! তিনি সেই বিশতম কর্মী এবং প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র নারী প্রকৌশলী!
▪কি এমন ছিল সেই অখ্যাত প্রতিষ্ঠানটিতে যার আকর্ষণে এত লোভনীয় সব ক্যারিয়ারের সুযোগ পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিলেন মারিসা?
উত্তরটা খুব সহজ। মাত্র বিশজন মানুষের সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল “Google”!
▪বিন্দু থেকে সিন্ধু
মারিসার ছোটবেলার সেই স্বভাব, সবকিছুর খুঁটিনাটি জানতে হবে, সব কাজ একদম নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত থামাথামি নেই; এই ব্যাপারটা সবার নজর কাড়লো। ছোট্ট ছোট্ট প্রজেক্ট থেকে তুলে এনে মারিসাকে দেওয়া হলো প্রোডাক্ট ম্যানেজারের মত গুরুত্বপূর্ণ সব পদ। অল্পদিনেই চমৎকার কাজ দেখিয়ে সবার মন জয় করে নিলেন তিনি। গুগল ততদিনে আর অখ্যাত দীনহীন কোন প্রতিষ্ঠান নেই! সারা বিশ্বে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তাদের।
তিনি ঠিক করলেন সময় হয়েছে এবার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু করার
▪এই সময়ে মারিসার শিল্পমনা দিকটি খুব কাজে এলো। তিনি গুগলের হোমপেইজ থেকে শুরু করে সবকিছুর ডিজাইন ঢেলে সুন্দর শৈল্পিক করে সাজিয়ে তুললেন। গুগলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় করার জন্য অসংখ্য তরুণ মেধাবী কর্মী নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়োগ করা শুরু করলেন তিনি। একটু একটু করে গোটা প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে গেলেন এক নতুন উচ্চতায়। গুগল সার্চ, ম্যাপ, নিউজ, টুলবার, জিমেইল থেকে শুরু করে সবকিছু এই মারিসার তত্ত্বাবধানেই গড়ে উঠেছে। ভাবতে অবাক লাগে, পৃথিবীজুড়ে শতকোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গুগল এমন ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে, তার পেছনে একটি মানুষের কত্তো ভূমিকা!
▪নতুন অভিযানের শুরু
দীর্ঘ তের বছর আগে মারিসা যখন গুগলে যোগ দিয়েছিলেন, তখন ভবিষ্যৎ ছিলো অনিশ্চিত। সামনে কি হবে, প্রতিষ্ঠানটি কোথায় যাবে কিছু জানা ছিল না। এই অজানা পাড়ি দেওয়ার রোমাঞ্চেই মারিসা এক যুগ নিরলস শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছেন গুগলকে। এখন গুগল পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ধনী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। সেই শুরুর দিকে হাল ধরেছিলেন যে সৈনিকেরা, তারা আজ অনেক বড় বড় পদে কর্মরত। কিন্তু মারিসার মন টিকছে না আর গুগলে। সেই যে সারাজীবন অজানার রোমাঞ্চ তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো, সেই অনুভূতিটা তো আর আসছে না! তিনি ঠিক করলেন সময় হয়েছে এবার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু করার।
▪ইয়াহু সিইও
গুগল ছেড়েই মারিসা যোগ দিলেন ইয়াহুতে, যেন তেন পদে নয়, একদম সিইও হিসেবে! ইয়াহুর সেই আগের জৌলুস ততদিনে আর নেই। মারিসার তত্ত্বাবধানে গুগল এতটাই এগিয়ে গিয়েছে যে, বেশিরভাগ মানুষ ইয়াহু ব্যবহার করা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছে! কি মজার ব্যাপার, এতদিন যিনি একাই ইয়াহুকে ধ্বসিয়ে দিলেন, তিনিই আজ হাল ধরলেন প্রতিষ্ঠানটির হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার অভিযানে!
দেখা গেল ইয়াহুতে এসেও কাজের ক্ষুধার গতি এতটুকুও কমেনি তার! ফরচুন ম্যাগাজিনের বছরের সেরা সিইও নির্বাচিত হলেন তিনি। ইয়াহুকে পতনের দ্বারপ্রান্ত থেকে তুলে ধরলেন বিপুল উদ্যমে ও পরিকল্পনায়।
▪মারিসার সাফল্যের রহস্য
একটা মানুষ একই সাথে নাচ, চাকরি, সংসার, গবেষণা, মিটিং, প্রচারণা, ব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা সহ আরো কত কত কাজ এত সফলভাবে সামলে চলেন কিভাবে তা ভেবে অবাক লাগছে কি?
উত্তরটা শুনে বিশ্বাস নাও হতে পারে।
মারিসা মেয়ার সপ্তাহে ১৩০ ঘন্টা অফিসে কাজ করেন।
১৩০ ঘন্টা!
প্রতিদিন গড়ে ১৮ ঘন্টা।
একদিন দুইদিন না; প্রতি দিন, প্রতি বছর!
▪এই মানুষটা বিছানায় ঘুমানোর সুযোগ পান খুব কম। বেশিরভাগ দিন অফিসের ডেস্কে কাজ করতে করতেই ২-৩ ঘন্টার জন্য ঘুমিয়ে নেন। গুগলে ১৩ বছরের কর্মজীবনে এমন একটি সপ্তাহও যায়নি যেখানে কাজের চাপে সারারাত ঘুমাতে পারেননি এমন হয়নি। কিন্তু মারিসার সদা লাবণ্যমাখা সতেজ হাসি দেখে একটুও বুঝবার উপায় নেই টানা ৪০ ঘন্টা ঘুম হয়নি তার!
▪জমজ সন্তানের জন্মের পর হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও কাজ করার নজির আছে তার। ইয়াহুর কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ৮ সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ১৬ সপ্তাহ করেছেন তিনি, কিন্তু নিজে প্রথম সন্তানের জন্মের মাত্র ২ সপ্তাহের ভেতর কাজে ফিরে প্রমাণ করেছেন কেন তিনি আর সবার থেকে ভিন্ন।
▪সেই যে ছোটবেলার এত এত বিচিত্র সব স্বপ্ন, মারিসা কিন্তু সেগুলোকে ভুলে যাননি! এখনো নাচের সুযোগ পেলে, সৌন্দর্যের গুণে হাজারো মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া মারিসা মডেলিং এর জগতেও কম যান না। “Glamour Magazine” এর বর্ষসেরা রমণী নির্বাচিত হয়েছেন ২০০৯ সালে। হয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন “Vogue” এর মডেল, “Fortune 500” এর জরিপে আর কোন সিইও’র নেই রূপ ও মেধার সমন্বয়ে এমন সাফল্যের নজির!
▪তরুণদের উদ্দেশ্যে মারিসা বলেন, “সাফল্য সবসময় প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে। আপনার প্রতিভা কম হতে পারে, কিন্তু পরিশ্রম দিয়ে আপনি সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যক্তিটিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন সাফল্যে। সুতরাং স্বপ্ন দেখেই থেমে থাকবেন না, সেটা সত্যি করতে কাজে নেমে পড়ুন! একটাই তো জীবন, বিজয়ের নিশান না উড়ানো পর্যন্ত ঘুমানো ভুলে যান!”
▪এখানেই মারিসা অতুলনীয়, অনন্য। এভাবেই তিনি স্বপ্ন দেখিয়ে যান তরুণ প্রজন্মকে। তোমার যদি একটা স্বপ্ন থাকে, সেটা যত অসম্ভবই লাগুক না কেন, উদ্যম থাকলে স্বপ্ন সত্যি হবেই! মারিসা প্রতিদিন ১৮ ঘন্টা করে কাজ করেছেন তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে, তাহলে তুমিইবা পিছিয়ে পড়বে কেন? আজই ঝাঁপিয়ে পড়ো নতুন এক উদ্যমে !!