মাউস
———

আমরা যখন বুয়েটে ক্লাস শুরু করি, কম্পিউটার সহজলভ্য বস্তু ছিল না। ইন্টারনেট বাংলাদেশ পর্যন্ত এসে পৌঁছায় নাই। তখনকার শক্তিশালী কম্পিউটারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্র বর্তমানে প্রত্যেকের বাসায় আছে। আমি স্মার্ট ফোনের কথা বলছি না, বর্তমান কালের টিভির রিমোট কন্ট্রোলারের প্রসেসিং পাওয়ার সেই সময়ের কম্পিউটারের চেয়ে বেশি! বুয়েটে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল নতুন বিভাগ। আমাদের শিক্ষকদের অধিকাংশেরই কম্পিউটার বিজ্ঞানের উপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব ছিল, তবে ওনাদের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিলো না। আমাদের যথেষ্ট বইপত্র ছিলো না, এমনও হয়েছে ক্লাস শুরুর ১ মাস পর দেশের বাইরে থেকে বই আনানো হয়েছে। আমাদের ক্লাসের সিংহভাগ ছাত্রছাত্রী বুয়েটের ল্যাবে জীবনে প্রথমবারের মত কম্পিউটার দেখেছে। ল্যাবের কম্পিউটার গুলো তখনকার দিনের হিসাবেও প্রাগৈতিহাসিক। ৮ মেগা হার্টস ৮০৮৮ প্রসেসর, ৬৪০ কিলোবাইট র‍্যাম, ১২৮ কিলোবাইট ভিডিও র‍্যাম, মনোক্রম মনিটর এবং হার্ড ডিস্ক নাই! ওগুলোতে আমরা ডিস্ক অপারেটিং সিস্টেম (DOS) প্লাটফর্মে প্যাসকেল, সি এবং এসেম্বলি ল্যাঙ্গুয়েজে প্রোগ্রাম লিখতাম। গ্রাফিক্স সফটওয়্যার বলতে চিনতাম ব্যানার আর প্রিন্ট ম্যাজিক নামে দুটো সফটওয়্যার, যেগুলো দিয়ে আমরা ল্যাব রিপোর্টের কাভার পেইজ প্রিন্ট করতাম।

আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস চলাকালীন সময় বুয়েটের ক্যাফেতে প্রথম কম্পিউটার মেলা অনুষ্ঠিত হয় ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই বোনদের উদ্যোগে। সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচ তখন থার্ড ইয়ারে পড়তো। সেই মেলাতে হিউলেট প্যাকার্ডের স্টলে সবচেয়ে ভিড়। ওদের কম্পিউটারে মাইক্রোসফটের নতুন অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ৩ চলছে, সম্পূর্ণ গ্রাফিক্স এবং কম্পিউটারের সাথে কিবোর্ডের পাশাপাশি আছে মাউস। এর আগে দূর থেকে অ্যাপল ম্যাকিন্টোস কম্পিউটারে মাউস দেখেছি, কিন্তু তাই বলে পিসিতে মাউস চিন্তাও করতে পারি নাই! সবাই কম্পিউটার নেড়ে চেড়ে দেখছে। আমার মাথায় চিন্তা, মাউস জিনিষটা আসলে কাজ করে কিভাবে। পিছন দিকে উল্টিয়ে দেখি একটা ডালার ভিতরে রাবারের বল। ডালাটা খুলতেই বলটা বের হয়ে আসলো। ভিতরে দুটো রোলার। ও আচ্ছা, এই তাহলে ব্যাপার, মাউস নাড়াচাড়া করলে বলটা ঘুরে, ফলে রোলার দুটো এক্স এবং ওয়াই এক্সিস বরাবর রোল করে। এ তো আসলে কার্টেসিয়ান জ্যামিতি। সব কিছু বুঝে সন্তুষ্ট হয়ে যেই বলটা আবার ভিতরে ঢুকিয়ে ডালা বন্ধ করলাম, স্টলের এক কর্মকর্তা দৌড়ে এসে সবার সামনে বিশাল বকা দিলেন, “এই ছেলে তুমি কম্পিউটার চিনো? মাউস ধরেছো কোন সাহসে?” লজ্জায় মাথা কাটা যায়। আয়োজক সিনিয়র এক ভাই এসে উদ্ধার করলেন। উনি উল্টো এইচপির কর্মকর্তাকে ঝাড়ি মারলেন, “একদিন ওর পায়ের কাছে এসে আপনারা বসে থাকবেন এপ্রুভালের জন্য।” যাই হোক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ওখানেই শেষ হলো।

মাউসের ব্যাপারটা মাথা থেকে নামলো না। সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে এক কম্পিউটারের দোকানে খোঁজ নিলাম মাউসের দাম কত। ৩০০০ টাকা দাম শুনে আত্মা শুকিয়ে গেল। যে আমলে বুয়েটের ক্যাফেতে ১০ টাকায় ভালোমত দুপুরের খাওয়া হয়ে যায়, সেসময় ৩০০০ টাকা অনেক বড় অঙ্ক। তাছাড়া আব্বুর কষ্টার্জিত টাকায় বাসায় যে কম্পিউটার কেনা হয়েছে, সেটাতে উইন্ডোজ চলবে না ১০০% নিশ্চিত, শুধু মাউস কিনলেই তো হবে না। মাউস কিভাবে কাজ করে সেটা শেখার জন্য ডিপার্টমেন্ট ও বুয়েটের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে খুঁজে কোন বই পেলাম না। গেলাম সিভিল বিল্ডিংএর কম্পিউটার সেন্টারে। ওইখানে একটা বই পড়ে জানতে পারলাম মাউস কাজ করে সিরিয়াল পোর্ট দিয়ে, RS-232 প্রটোকলে। জাস্ট এইটুকুই।

সেকেন্ড ইয়ারের শেষ দিকে আমার একমাত্র চাচা, যিনি আমার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড়, প্রথমবারের মত কলকাতা যাচ্ছেন নিজের কাজে। ভারত কম্পিউটার বিজ্ঞানে বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে। আমি চাচাকে রিকুয়েস্ট করলাম, আপনি সময় পেলে একটু পাঠ্যবই পাড়ায় খুঁজে দেখবেন RS-232 প্রটোকলের উপর কোন বই পান কিনা। উনি সারা জীবন কমার্সের ছাত্র ছিলেন, খুব একটা ভরসা ছিলো না উনি পারবেন। উনি ঠিকই সময় বের করে আমার জন্য এই সাবজেক্টের উপর একটা বই নিয়ে আসলেন। সেই বই পড়ে শিখলাম সিরিয়াল পোর্ট দিয়ে কিভাবে তথ্য আদান প্রদান করা যায়, মাউস কিভাবে কম্পিউটারের সাথে কথা বলে, ইত্যাদি।

থার্ড ইয়ারে একটা কোর্স ছিল CSE-300 “সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট স্টুডিও ২”। কোর্স টিচার সিদ্ধান্ত নিলেন, এই কোর্সে এবার হবে গ্রুপ প্রজেক্ট, একেবারে ইন্ড্রাস্টির মত। একজন আর্কিটেক্ট থাকবে, যে প্রজেক্টের দেখভাল করবে, বাকিরা সবাই মিলে তার নেতৃত্বে সারা সেমিস্টার ধরে একটা বড় সফটওয়্যার বানাবে। আমি এমনিতে খুব একটা ভালো স্টুডেন্ট না হলেও ভালো সফটওয়্যার লিখতে পারতাম বলে কিছুটা নাম, যশ ছড়িয়েছিল। অতএব, আমাকে দেয়া হল আর্কিটেক্ট পজিশন। সবাইকে কাজ ভাগ করে দেয়ার পর দেখলাম, আগামী কয়েক মাস আমার আসলে কোন কাজ নাই আল্লাবিল্লা করা ছাড়া – সবাই যাতে সময়মত নিজ নিজ কাজ শেষ করতে পারে এবং আমি শেষমেশ সবার কাজ জোড়া দিতে গিয়ে গুবলেট না করে ফেলি। প্রজেক্টটা ছিলো ডাটা ফ্লো ডায়াগ্রাম এডিটর বানানোর উপর। টেকনিক্যাল কচকচানির মধ্যে যাবো না, তবে প্রজেক্টটা যেহেতু গ্রাফিক্স সম্পর্কিত, মাথায় আসলো মাউস সংক্রান্ত পুঁথিগত বিদ্যা কাজে লাগানোর। যদিও আমরা এমনভাবেই সিস্টেম ডিজাইন করছি যাতে করে কিবোর্ড দিয়েই সব কাজ করা যায়, তারপরও মনে হলো মাউস ইন্টারফেইস দেয়ার চেষ্টা করতে ক্ষতি কি।

ডিপার্টমেন্টে একটা মাউস আছে, ওটা আলমারিতে তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকে, কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখেছি। স্যারকে গিয়ে ওটা চাইতেই পত্রপাঠ নাকচ করে দিলেন, এইসব আলগা কাজ বাদ দিয়ে প্রজেক্টে মনোনিবেশ করতে বললেন। জিদ চেপে গেলো। আমি আর আমার এক সহপাঠী বন্ধু মিলে মাউসের ডিভাইস ড্রাইভার লিখলাম, সি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে কোড লিখলাম কিভাবে মাউস দিয়ে আমাদের সফটঅয়্যারের বিভিন্ন ফিচার কন্ট্রোল করা যাবে। এমন কোন আহামরি কাজ না, কিন্তু নতুন। ক্লাসের কারোই মাউস নাই, ফলে এই কোড টেস্ট করারও উপায় নাই। উপায়ান্ত না দেখে সিরিয়াল কেবল দিয়ে ল্যাবের দুটো কম্পিউটারের মধ্যে কানেকশন দিলাম। আরও অতিরিক্ত একটা সফটওয়্যার লিখলাম যেটা দিয়ে এক কম্পিউটারের কি বোর্ড দিয়ে মাউসের মত করেই বিভিন্ন সিগনাল পাঠাবো দ্বিতীয় কম্পিউটারে যেখানে আমাদের মুল সফটওয়্যার চলছে, এবং দেখবো মাউসের ফাংশানালিটি আসলেই কাজ করছে কিনা।

সেমিস্টার শেষে প্রজেক্টের কাজ শেষ করার পর ডেমো দেয়ার পালা। ফের স্যারের কাছে গিয়ে মাউস চাইলাম। স্যার অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে না আগেই বলেছি এইসব আলগা কাজ বাদ দিতে। বিনীত ভাবে বললাম, স্যার, মাউসের কোড লিখে ফেলেছি, তাই দেখাতে চাচ্ছিলাম। আর মাউস না কাজ করলেও কিবোর্ড দিয়ে তো সবকিছু কাজ করবে। স্যার বললেন, ঠিকাছে, তবে মাউস কাজ না করলে কিন্তু নাম্বার কাটা হবে। যদিও অতিরিক্ত ফিচার না কাজ করলে নাম্বার কাটা যৌক্তিক না, তবুও তর্কে গেলাম না। শুধু বললাম, নাম্বার কাটলে আমারটা কাটেন, অন্যদের করা কাজগুলো তো মাউস ছাড়াও কাজ করছে।

আলমারি থেকে মাউস বের করা হয়েছিল। মাউসের ব্যবহার সহ সব ফিচারই সুচারুরূপে কাজ করেছিল। জীবনে ওই একবারই আমরা ক্লাসের ৩০ জন মিলে একটা প্রজেক্টে কাজ করেছিলাম। ২৪ বছর পরেও ডস বেইজড সেই সামান্য প্রোগ্রামটি সযত্নে আগলে রেখেছি আমার কম্পিউটারে।

আমরা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলাম যখন কম্পিউটার বিষয়ক সুবিধাদির অসম্ভব রকম অপ্রাচুর্য ছিলো। আমাদের হাতে দুটো পথ খোলা ছিল – ১) অপ্রতুল সুবিধাদির বিষয়ে অভিযোগ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা, অথবা ২) যেটুকু সুযোগ আছে তার সর্বোচ্চ ব্যাবহার করে কিছু একটা করে দেখিয়ে দেয়া। আমরা দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিলাম।
Masud Karim Khan
working at United States Patent and Trademark Office.