যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সাময়িকী প্রসপেক্ট গত ১৪ জুলাই ২০২০ সালের সেরা ৫০ চিন্তাবিদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে।

বিশ্বের ৫০ চিন্তাবিদের সেই তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশের স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম।

প্রসপেক্ট সাময়িকীতে বলা হয়েছে, ব্যবহারিক ধারণা ও চিন্তা সম্পর্কে অজানা প্রশ্নের উত্তর দিতে মানুষের মাঝে উপলব্ধি তৈরির চেয়ে জরুরি কিছুই নেই।

প্রকৃতির সাথে মিল রেখে ভবন তৈরি করেন তিনি। বাংলাদেশি স্থপতি তাবাসসুম তার তৈরি নকশাগুলোতে আমরা সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর কী করে যাচ্ছি তার চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছেন, বলা হয় সাময়িকীতে।

তারই স্বীকৃতি হিসেবে এই তালিকায় টাই পেয়েছেন বলে জানিয়েছে ম্যাগাজিনটি।

সম্প্রতি স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম স্থানীয় উপকরণ দিয়ে হালকা ওজনের ঘর তৈরি করে দেখিয়েছেন যা সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানো যায়।

নদী বা সমুদ্রের পানি বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশকে নিয়মিতই যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার একটি সমাধান দেবে এ প্রযুক্তিটি।

Bait ur Rouf Mosque. Photo by Rajesh Vora.

স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম সুলতানি যুগের আদলে পোড়ামাটির ইটের তৈরি বায়তুর রউফ মসজিদটিকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এমনভাবে তৈরি করেন যাতে পানি এলেও এটি ভেসে থাকতে পারে।

মসজিদটির নকশা তৈরির জন্য স্থাপত্য পুরস্কারের অন্যতম প্রাচীন ও সম্মানজনক পুরস্কার আগা খান অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন তিনি।

বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে তিনিই প্রথম আগা খান পুরস্কারে ভূষিত হন। যদিও এর আগে বাংলাদেশের তিনটি স্থাপত্য এই পুরস্কার পেয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর স্থপতি ছিলো বিদেশি।

এছাড়া তিনি কমনওয়েলথ, ব্রিটেনের স্মিথ এওয়ার্ডসহ বিভিন্ন পুরষ্কার পেয়েছেন। তাকে নিয়ে এ মাসেই বিবিসি, গার্ডিয়ান, এনডিটিভি বিশেষ স্টোরি করেছে।

ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদের নকশা করেছেন যা টেরাকোটা ইট দিয়ে নির্মিত। মসজিদের নকশা রীতিমতো সুলতানি আমলের কথা মনে করিয়ে দেয়।

স্থপতি কাসেফ মাহবুব এর তৈরি ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার, যার জন্য তিনি আগা খান পুরষ্কার পান

এ ছাড়া আরেক স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর (বুয়েট) সঙ্গে যুগ্মভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের নকশা করেছেন মেরিনা।

২০১৫ সাল থেকে নিজস্ব স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস (এমটিএ) পরিচালনা করছেন তিনি এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে কি ধরণের ভবন রয়েছে এ নিয়ে গবেষণা করে প্রশংসিত হয়েছেন।

তিনি কাউন্টার পাঞ্চ ও থট জার্নালের নিয়মিত লেখক।

মেরিনা তাবাসসুম ও নির্মাণাধীন বায়তুর রউফ মসজিদ

মেরিনা তাবাসসুম ও তার স্থাপত্য

(শুভ্র সুমন)

স্থাপত্য সাধনারই আরেক নাম। সংগীত, চিত্রকলা কিংবা সাহিত্যের মতো সৃজনশীল একটি পেশা স্থাপত্য। স্থাপত্য একদিকে যেমন বিজ্ঞান, অন্যদিকে শিল্পের আধার।

তাই তো দর্শন এসে যুক্ত হয় তার পথচলায়। স্থাপত্য ধারণ করে শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস, প্রযুক্তি, সভ্যতা, সময় ও শিল্পীর শিল্পবোধ।

প্রথাগত শিক্ষায় হয়তো স্থাপত্য জ্ঞান লাভ সম্ভব কিন্তু স্থপতি হতে হলে প্রয়োজন সাধনা আর স্থাপত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা।

স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের সেই দীর্ঘ সাধনার স্বীকৃতি তার ‘আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার-২০১৬’।

তিনি তার এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘স্থাপত্যচর্চাকে আমি কাজ মনে করি না, এটা আমার নেশা।’

স্থাপত্যের ভুবনে নোবেলতুল্য ‘প্রিত্জকার স্থাপত্য পুরস্কার’-এর পরই অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কার ‘আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার’, যা ১৯৭৭ সালে চতুর্থ আগা খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক’-এর স্থাপত্যবিষয়ক একটি সম্মাননা।

তিন বছর পরপর ইসলামিক সমাজের প্রয়োজন ও উচ্চাশা ধারণ করে নির্মিত স্থাপনাকে স্বীকৃতিস্বরূপ একাধিক প্রকল্পকে এ পুরস্কার দেয়া হয়, যার আর্থিক মূল্য ১০ লাখ মার্কিন ডলার।

পুরস্কারটিতে স্থাপত্যে শ্রেষ্ঠত্ব, পরিকল্পনা ও ঐতিহাসিক সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি স্থাপত্যের মাধ্যমে সামাজিক প্রত্যাশা পূরণের বিষয়টিও বিবেচ্য।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ছয়টি প্রকল্প এ সম্মাননা লাভ করে, যার তিনটি জাতীয় সংসদ ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রকল্প এবং রুদ্রপুর মেটিস্কুল প্রকল্পে কাজ করেন তিনজন বিদেশী স্থপতি।

২০১৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের দুজন স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ও কাশেফ মাহবুব চৌধুরী স্থাপত্যে অনন্য এ সম্মান লাভ করেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩৪৮টি প্রকল্পের ভেতর থেকে ১৯টি প্রকল্পকে চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য বাছাই করা হয়, যেখানে স্থাপত্যের স্বকীয়তায় স্থান করে নেয় স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের ঢাকার ‘বায়তুর রউফ মসজিদ’ এবং স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর গাইবান্ধার ‘ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার’।

আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট, আগা খান পুরষ্কার জয়ী স্থাপনা

সর্বশেষ ২০১৯ সালে আরেক বাঙালি স্থপতি সাইফ উল হক স্থানীয় সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে সাশ্রয়ী, স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব এক স্থাপনা ‘আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট’ নির্মাণ করে স্থাপত্যের অনন্য সম্মান ‘আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার, ২০১৯’ লাভ করেন।

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করার মধ্য দিয়ে স্থাপত্যে যাত্রা শুরু করেন মেরিনা তাবাসসুম।