মেটাভার্স শব্দটি প্রযুক্তি শিল্পের কল্পনার জগতে সর্বশেষ আলোড়ন তোলা একটি শব্দ। মেটাভার্সের ধারণা এতটাই আলোড়ন তুলেছে যে, সবচেয়ে বিখ্যাত ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলো একে আলিঙ্গন করার জন্য নিজেদের রি-ব্র্যান্ডিং করছে।

সেই ধারাবাহিকতায় ফেসবুক-এর সি ই ও মার্ক জাকারবার্গ ঘোষণা দেন যে, তিনি তার কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে মেটা প্ল্যাটফর্মস ইনকর্পোরেটেড, বা সংক্ষেপে মেটা করছেন। এর আগে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কোম্পানি অকুলাসও কিনে নিয়েছে ফেসবুক।

সায়েন্স ফিকশন লেখক নীল স্টিফেনসন তার ১৯৯২ সালের উপন্যাস ‘স্নো ক্র্যাশ’-এ সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এরপর মেটাভার্সের ধারণা নিয়ে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হতে যাচ্ছে ফেসবুকের এই নাম বদল। তবে ফেসবুক ছাড়াও আরও অনেক কোম্পানিও মেটাভার্স তৈরি করার চিন্তা করছে।

মেটাভার্স আসলে কী?

একে আপনি ইন্টারনেটকে জীবন্ত করে তোলা বা অন্ততপক্ষে থ্রিডিতে রুপান্তর করা হিসেবে ভাবতে পারেন। জাকারবার্গ এটিকে একটি ভার্চুয়াল পরিবেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে আপনি শুধু স্ক্রিনে দেখার পরিবর্তে এর ভেতরেও ঢুকে যেতে পারবেন।

মূলত এটি এক অন্তহীন আন্তঃসংযুক্ত ভার্চুয়াল কমিউনিটির একটি বিশ্ব যেখানে লোকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট, অগমেন্টেড রিয়েলিটি চশমা, স্মার্টফোন অ্যাপ বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করে দেখা করতে, নানা কাজ করতে এবং খেলতে পারবে।

মেটাভার্স-কে বলা হচ্ছে ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ, যেখানে ইন্টারনেটকে এমন জীবন্ত ও জীবনঘনিষ্ঠ করে তোলা হবে যা আমাদের বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার ধারণারও বাইরে!

মেটাভার্স হবে নতুন এক জগৎ যেখানে মানুষের বাস্তব অস্তিত্ব ও ভার্চুয়াল অস্তিত্বকে এমনভাবে মিশিয়ে দেয়া হবে যে, চোখে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভি.আর) হেডসেট ও চশমা পরে মানুষ প্রবেশ করবে এক নতুন ডিজিটাল জগতে।

সেখানে প্রতিটি মানুষের একটি করে অবতার (Avatar) সৃষ্টি হবে, যেটি দিয়ে সেই জগতে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে বাস্তব পৃথিবীর মতোই আড্ডা দেবে, কথা বলবে, ঘুরে বেড়াবে, অফিসের কাজ করবে, শপিং করবে, লাইভ কনসার্টে যোগ দেবে, খেলাধুলা করবে।

অর্থাৎ মানুষ সবই করবে, তাঁর শরীর থাকবে ঘরে বা বাইরে কিন্তু দেখার ও অনুভবের জগত হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন-ভার্চুয়াল।
নতুন প্রযুক্তি বিশ্লেষক ভিক্টোরিয়া পেট্রোকের মতে, এতে অনলাইন জীবনের অন্যান্য দিক, যেমন শপিং এবং সোশ্যাল মিডিয়াও থাকবে।

ভিক্টোরিয়া পেট্রোক বলেন, এটি যোগাযোগ প্রযুক্তির বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ, যেখানে সমস্ত জিনিস একটি বিরামহীন, ডপেলগ্যাঞ্জার মহাবিশ্বে একত্রিত হব এবং আপনি আপনার শারীরিক জীবন যাপনের মতোই ভার্চুয়াল জীবন যাপন করবেন’।

এমন এক বিশ্বের কথা ভেবে দেখুন যেখানে একটি কোম্পানি তাদের নতুন মডেলের একটি গাড়ি তৈরি করার পর সেটা অনলাইনে বাজারে ছেড়ে দিল এবং একজন ক্রেতা হিসেবে আপনি বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে গাড়িটি চালিয়ে দেখতে পারলেন।

অথবা ঘরে বসে অনলাইন শপিং করার সময় একটি পোশাক পছন্দ হলো। ওই পোশাকের একটি ডিজিটাল সংস্করণ গায়ে দিয়ে দেখার পরই আপনি জামাটি কেনার জন্য অর্ডার দিলেন।

বিষয়টা হয়তো বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত সাই-ফাই মুভির মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে এখন আর সেটা কল্পনার পর্যায়ে থাকছে না। এরকম এক প্রযুক্তি তৈরির কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে হয়ে গেছে।

এই প্রযুক্তির ফলে অনলাইনের ভার্চুয়াল জগতকে মনে হবে সত্যিকারের বাস্তব পৃথিবীর মতো।

ধরা যাক ফেসবুকে আপনার একজন বন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার অপূর্ব কিছু ছবি পোস্ট করেছেন। ফেসবুক দেখার সময় এই প্রযুক্তির কারণে মনে হবে আপনিও সেখানে উপস্থিত আছেন।

আর যে প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব ঘটবে তার নাম মেটাভার্স। আর বলা হচ্ছে, মেটাভার্সই হবে ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ।

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, মেটাভার্সের কারণে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতকে মনে হবে বাস্তব জগতের মতো যেখানে মানুষের যোগাযোগ হবে বহুমাত্রিক। মেটাভার্স প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনি কোন কিছু শুধু দেখতেই পাবেন না, তাতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতেও সক্ষম হবেন।

মেটাভার্সে আমরা কী করতে পারব?

ভার্চুয়াল কনসার্টে যাওয়া, অনলাইনে বেড়াতে যাওয়া, আর্টওয়ার্ক দেখা বা তৈরি করা এবং ডিজিটাল পোশাক কেনা বা বেচার মতো জিনিস করতে পারবো আমরা।

মেটাভার্স করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে বাড়ি থেকেই অফিস করার যে পদ্ধতি শুরু হয়েছে সে ক্ষেত্রেও একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে। এর ফলে ভিডিও কল গ্রিডে সহকর্মীদের দেখার পরিবর্তে, একটি ভার্চুয়াল অফিসে আপনি তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারবেন।

ফেসবুক তার ওকুলাস ভি.আর হেডসেটগুলোর সঙ্গে ব্যবহার করার জন্য হরাইজন ওয়ার্করুম নামক মিটিং সফ্টরয়্যার চালু করেছে। তবে এই হেডসেটের দাম ৩০০ ডলার বা তার বেশি। ফলে মেটাভার্সের সবচেয়ে অত্যাধুনিক অভিজ্ঞতা অনেকেরই নাগালের বাইরে রয়ে যাবে।

যারা এই হেডসেট কিনতে পারবে তারা তাদের অবতারের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি ভার্চুয়াল জগতে উড়ে বেড়াতে পারবে।

প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে এজন্য তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে একে অপরের সঙ্গে কীভাবে সংযুক্ত করা যায় তা খুঁজে বের করতে হবে। একে কার্যকর করার জন্য প্রতিযোগী প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্মগুলোকে কিছু মানদন্ড তৈরি করে তাতে একমত হতে হবে, যাতে ‘ফেসবুক মেটাভার্স’ এবং ‘মাইক্রোসফ্ট মেটাভার্সে’ আলাদা আলাদা লোকরা না থাকে, বরং সব মেটাভার্সে সবাই প্রবেশ করতে পারে।

ফেসবুক কি তাহলে ভবিষ্যতে মেটাভার্সকেই বেশি গুরুত্ব দিতে যাচ্ছে?

জাকারবার্গ ইন্টারনেটের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে যা দেখেন তাতেই বেশি বিনিয়োগ করবেন। কারণ তিনি মনে করেন যে, এটি ডিজিটাল অর্থনীতির একটি বড় অংশ হতে চলেছে।

বিগত কয়েক বছর ধরেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি নিয়ে গবেষণার কাজ করছিল ফেসবুক। সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি থেকে নিজের পরিচয় পরিবর্তন করতেই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফেসবুক। মূলত সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে ফেসবুক।

জাকারবার্গ বলেন, আমরা ইন্টারনেটের পরবর্তী অধ্যায়ের শুরুতে আছি, এবং এটি আমাদের কোম্পানির জন্যও পরবর্তী অধ্যায়।

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, প্রযুক্তি মানুষকে আরও স্বাভাবিকভাবে যোগাযোগ করার এবং নিজেদের প্রকাশ করার শক্তি দিয়েছে। আমি যখন ফেসবুক শুরু করি, তখন আমরা শুধু ওয়েবসাইটে টেক্সট টাইপ করতাম।

আমরা যখন ক্যামেরা সহ ফোন পেয়েছি, তখন ইন্টারনেট আরও ভিজ্যুয়াল এবং মোবাইল হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটের গতি বাড়ার ফলে অভিজ্ঞতা শেয়ার করার একটি সমৃদ্ধ উপায় হয়ে উঠেছে ভিডিও।

আমরা ডেস্কটপ থেকে ওয়েবে, ওয়েব থেকে মোবাইলে চলে এসেছি; টেক্সট থেকে ছবিতে এবং ছবি থেকে ভিডিও পর্যন্ত এসেছি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

পরবর্তী প্ল্যাটফর্মটি আরও বেশি গভীর হবে, যা হবে এক জীবন্ত ইন্টারনেট, যেখানে আপনি শুধু এর দিকে তাকাবেনই না বরং অভিজ্ঞতার মধ্যে থাকবেন। আমরা এর নাম দিয়েছি মেটাভার্স, এবং এটি আমাদের তৈরি প্রতিটি পণ্যকে স্পর্শ করবে।

মেটাভার্সের মূল বৈশিষ্ট্য হবে উপস্থিতির অনুভূতি- যেন আপনি বাস্তবেই অন্য ব্যক্তির সঙ্গে বা অন্য জায়গায় হাজির আছেন। অন্য ব্যক্তির সঙ্গে সত্যিকারের উপস্থিতির বোধই সামাজিক প্রযুক্তির চূড়ান্ত স্বপ্ন। এ কারণেই আমরা এটি নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করছি।

মেটাভার্সে আপনি কল্পনা করতে পারেন এমন প্রায় সব কিছু করতে পারবেন- বন্ধু এবং পরিবারের সঙ্গে একত্র হওয়া, কাজ করা, শেখা, খেলা, কেনাকাটা করা, সৃষ্টি করা- সেইসঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা যা সত্যিই আজ আমরা কম্পিউটার বা ফোন সম্পর্কে যেভাবে চিন্তা করি তার সঙ্গে খাপ খায় না। আমরা একটি ফিল্ম বানিয়েছি যাতে দেখানো হয়েছে কিভাবে আপনি একদিন মেটাভার্স ব্যবহার করতে পারবেন।

এই ভবিষ্যতে, আপনি রাস্তা দিয়ে যাতায়াত ছাড়াই অফিসে, বন্ধুদের সঙ্গে কনসার্টে বা আপনার বাবা-মায়ের বসার ঘরে হলোগ্রাম হিসাবে তাৎক্ষণিকভাবে টেলিপোর্ট বা হাজির হতে সক্ষম হবেন। আপনি যেখানেই বাস করেন না কেন এটি আরও সুযোগ উন্মুক্ত করবে। আপনি আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে আরও বেশি সময় ব্যয় করতে, ট্র্যাফিকের সময় কমাতে এবং আপনার কার্বন নিঃসরণ কমাতে সক্ষম হবেন।

এখন থেকে আমরা মেটাভার্স-ফার্স্ট হব, ফেসবুক-ফার্স্ট নয়, অর্থাৎ মেটাভার্সই আমাদের প্রধান কাজ হবে। এর মানে হল যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অন্যান্য পরিষেবাগুলো ব্যবহার করার জন্য আপনার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টের আর প্রয়োজন হবে না।

 

মেটাভার্স কি শুধু একটি ফেসবুক প্রকল্প?

না। মেটাভার্স নিয়ে কাজ করা অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে রয়েছে মাইক্রোসফট এবং চিপমেকার এনভিডিয়া।
এনভিডিয়ার ওমনিভার্স প্ল্যাটফর্মের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড কেরিস বলেছেন, ‘আমরা মনে করি মেটাভার্সে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড এবং পরিবেশ তৈরি করার জন্য প্রচুর কোম্পানি হতে চলেছে, ঠিক যেভাবে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে অনেক কোম্পানি কাজ করছে।

উন্মুক্ত এবং প্রসারণযোগ্য হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আপনি বিভিন্ন জগতে টেলিপোর্ট করতে পারেন, তা একটি কোম্পানি বা অন্য কোম্পানির মাধ্যমেই হোক, যেভাবে আমরা এক ওয়েব পেজ থেকে অন্য ওয়েব পেজে যাই।

ভিডিও গেম কোম্পানিগুলোও এতে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। জনপ্রিয় ফোর্টনাইট ভিডিও গেমের পেছনের সংস্থা এপিক গেমস মেটাভার্স তৈরির উদ্দেশ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় সহায়তা করার জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে।

গেম প্ল্যাটফর্ম রোব-ক্স আরেকটি বড় সংস্থা, যারা মেটাভার্সকে কল্পনা করেছে এমন একটি জায়গা হিসেবে যেখানে ‘লোকে শিখতে, কাজ করতে, খেলতে, সৃষ্টি করতে এবং সামাজিক যোগাযোগের লক্ষ লক্ষ থ্রিডি অভিজ্ঞতার মধ্যে একত্রিত হতে পারবে’।

ভোক্তা ব্র্যান্ডগুলিও এই প্রবণতায় তাল মেলানোর চেষ্টা করছে। ইতালীয় ফ্যাশন হাউস ‘গুচি’ শুধুমাত্র ডিজিটাল যন্ত্রপাতি বিক্রি করার জন্য রোব্লক্স এর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। কোকা-কোলা এবং ক্লিনিক ডিজিটাল টোকেন বিক্রি করেছে মেটাভার্সের দিকে একটি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে।

ফেসবুক মেটাভার্স এর ফিচারসমুহ

ফেসবুক এর পরিকল্পিত মেটাভার্স এর মাধ্যমে একাধিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক মেটাভার্স এর মাধ্যম কি কি করা সম্ভব হবে।

১. হরাইজন হোম
হরাইজন হোম হলো একটি ভার্চুয়াল ঘরের মত, যেখানে মেটাভার্স এর অন্যান্য ব্যবহারকারীগণ বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন, একসাথে আড্ডা দিতে পারবেন, ভিডিও দেখতে পারবেন ও একই সাথে গেম খেলতে পারবেন।

২. ফিটনেস
ইতিমধ্যে অনেকেই ভি.আর ব্যবহার করে এক্সারসাইজ করে থাকেন। আগামী বছর নতুন এক্সেসরিজ আনবে ফেসবুক এর প্যারেন্ট কোম্পানি মেটা, যার মাধ্যমে ভার্চুয়ালি ফিটনেস বজায় রাখা আরো সহজ হবে।

৩. ভার্চুয়াল ওয়ার্কস্পেস
ভি.আর ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ওয়ার্কস্পেসের কথা আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি। মেটাভার্স ওয়ার্কস্পেসে ফেসবুক একাউন্ট ছাড়াই আলাদা প্রফেশনাল একাউন্ট দিয়ে লগিন করা যাবে। যারা বাসা থেকে কাজ করেন তারা তাদের মেটাভার্স ওয়ার্কস্পেসে ভার্চুয়ালি উপস্থিত হয়ে কাজ করতে পারবেন।

৪. গেমিং
মেটাভার্স এর বিশাল একটি অংশ হতে যাচ্ছে গেমিং। কানেক্ট কিনোট এর সময় ফেসবুক এর গেমিং প্ল্যাটফর্ম, কুয়েস্ট এ বিট সেবার গেমটি ১০০ মিলিয়ন ডলার আয়ের কথা জানান জাকারবার্গ। এছাড়াও কুয়েস্ট এর আপকামিং ভার্সনে রকস্টার গেমস এর জনপ্রিয় গেম, জি.টি.এ স্যানএন্ড্রিয়েস আসতে যাচ্ছে।

৫. ভিআর মেসেঞ্জার কল
মেসেঞ্জার অ্যাপে বেশকিছুদিন আগেই ভিআর সাপোর্ট এর ঘোষণা দেয় ফেসবুক। হেডসেট ব্যবহার করে বন্ধুদের কুইক মেসেজ পাঠানো যাবে। এছাড়াও ভিআর এর মাধ্যমে মেসেঞ্জার অডিও কল আসতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই। সাপোর্টেড প্ল্যাটফর্মগুলোতে একই সাথে ভিআর হেডসেট ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারবেন ব্যবহারকারীগণ।

এই মেটাভার্স ধারণা নিয়ে বেশ আশাবাদি ফেসবুক এর প্যারেন্ট কোম্পানি, মেটা। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে নিজেদের লক্ষ্যে তারা সফল হতে পারে কি না। আপনি মেটা নিয়ে কী ভাবছেন?

প্রযুক্তির নতুন জগতে আইনি চ্যালেঞ্জ

মেটাভার্স প্রযুক্তি শুধু একা ফেসবুকের উদ্ভাবন নয়, অনেক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি বিভিন্ন প্রকারের মেটাভার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে। মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গুগুল- কে নেই এই দৌড়ে! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence- AI) এবং মেশিন লার্নিং হবে এই প্রযুক্তির চালিকাশক্তি।

মেটাভার্সের দুনিয়ায় জড়িয়ে যাবে মানুষের ব্যক্তিজীবন, পেশাজীবন, সমাজজীবন, শিক্ষা, অর্থনীতি, শিল্প, বিনোদনসহ প্রায় সব কিছুই। কিন্তু, মানবজীবন তো আর থ্রি-ডি ভিডিও গেইম নয়। তাই এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আইনগত বিষয়গুলো কেমন হবে সেটিও বর্তমানে ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেছে।

প্রথমত, এটি অনস্বীকার্য যে, আইন প্রযুক্তির তুলনায় পিছিয়ে থাকে। প্রযুক্তি আগে আসে, আইন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে পরবর্তীতে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। যেহেতু মেটাভার্স এখনো কার্যকর হয়নি, মেটাভার্সের ফলে কীভাবে মানুষের জীবন পরিবর্তিত হবে তা পুরোপুরি নিশ্চিত নয় বরং অনুমান নির্ভর।

তাই আইনের প্রি-এম্পটিভ অ্যাকশনের সুযোগ নেই। তবে, মেটাভার্স দুনিয়ায় আইনগত চ্যালেঞ্জ কী কী হতে পারে তা নিশ্চয় কিছুটা অনুমান করাই যায়।

দ্বিতীয়ত, যেহেতু মেটাভার্স তৈরিতে বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে তাই এসব কোম্পানির মধ্যকার প্রযুক্তি বিনিময়, সমন্বয় ও মেটাভার্সের মালিকানা নির্ধারণে আইনের ভূমিকা থাকবে। বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি করা ডিভাইস ও ভার্চুয়াল স্পেসের লাইসেন্স ও ব্যবহার বিধি প্রণয়নে আইনগত কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে।

তৃতীয়ত, ফেসবুকের মালিকানায় থাকা মেটাভার্সের নিরাপদ ব্যবহার ও নৈতিক আচরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নির্ধারণের দায়িত্ব পেয়েছে হংকং ইউনিভার্সিটি এবং সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বাস্তবের দুনিয়ায় যে রকম অপরাধ হয়, মেটাভার্সের ভার্চুয়াল জগতেও তেমন অপরাধ সংঘটিত হতে পারে।

যেমন, ভার্চুয়াল প্রতারণা, ডিজিটাল ব্ল্যাকমেইলিং, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি ও তথ্যের অপব্যবহার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন, ভার্চুয়াল সম্পদ লুণ্ঠন, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস লঙ্ঘন প্রভৃতি।

চতুর্থত, বর্তমান দুনিয়ার আইন মানুষ-কেন্দ্রিক। কিন্তু মেটাভার্সের পৃথিবী হবে বহুমাত্রিক যেখানে মানুষ আর মুখ্য থাকবে না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হবে সবকিছুর চালিকাশক্তি। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নতুন নতুন অনেক পণ্য ও সেবার জন্ম দেবে যা মানুষের দ্বারা হয়তো সম্ভব হতো না।

প্রশ্ন হলো, সেসব পণ্যের পেটেন্ট মালিকানা, কপিরাইট ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার কার হাতে থাকবে? মানুষ নাকি মেশিন? মেশিনকে উদ্ভাবক হিসেবে পেটেন্ট অধিকার প্রদান করা যেতে পারে কি? মেটাভার্স দুনিয়ায় এই আইনগত বিষয়গুলোর সুরাহা হবে বলে আশা করা যায়।

পঞ্চমত, মেটাভার্স জগতে বর্তমান বাণিজ্য আইন ও মুদ্রানীতি অকার্যকর হয়ে যাবে। ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ ও ক্রিপ্টোকারেন্সি সামনে চলে আসবে। এই ডিজিটাল মুদ্রা কারা ব্যবহার করবে?

কিভাবে করবে? মালিকানা কীভাবে হবে? কে বেচবে? কে কিনবে? কে বাণিজ্য করতে পারবে? কে পারবে না? সবকিছুর জন্য নতুন আইন ও আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে।

তদুপরি, বর্তমান সময়ের চেয়ে মেটাভার্স জগত হবে অনেক বেশি বায়োমেট্রিক তথ্য নির্ভর। অর্থাৎ, মেটাভার্স কোম্পানিগুলো আমাদের আঙুলের ছাপ শুধু নয়, বরং আমাদের চোখের দৃষ্টি, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন, মস্তিষ্কের চিন্তা-ভাবনা, এমনকি আমাদের প্রাত্যহিক যাবতীয় কর্মকান্ডের ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।

যেহেতু মানুষ জাগ্রত অবস্থা এমনকি নিদ্রিত অবস্থারও বেশিরভাগ সময় মেটাভার্স জগতে ব্যয় করবে, এর ফলে সেসব মানুষের ব্যক্তিগত সমস্ত তথ্যের মালিকানা কার হাতে থাকবে? ব্যক্তিগত তথ্য যদি চুরি হয় কিংবা অপব্যবহার হয়- তাহলে কে দায়ী হবে? কীভাবে দায়ী হবে?

প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষকদের অনেকে মনে করছেন, মেটাভার্সের মাধ্যমে ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো বর্তমানের চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত তথ্য আরও সহজে হাতিয়ে নেবে, মানুষ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি ডিজিটাল সারভেইলেন্স-এর শিকার হবে, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে এরা আর্থিকভাবে আরো লাভবান হবে এবং তথ্যের অপব্যবহার ঠেকানো কঠিনতর হয়ে উঠবে। মেটাভার্স হবে ডাটা ব্যবসায়ীদের জন্য সোনার খনি।

মেটাভার্স-কে কী প্রতিরোধ করা যাবে?

সম্ভবত না, এবং সেটির প্রয়োজনও নেই। কিন্তু উপযুক্ত আইনি কাঠামোই পারে মেটাভার্সের নিয়ন্ত্রকদের হাতে লাগাম পরাতে, মেটার পৃথিবীতে মানুষের পার্সনাল ডেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। এমনটিই মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

NFT কী? Non Fungible Token কিভাবে কাজ করে?

আজ থেকে মাত্র ১০ বছর আগেও কল্পনা করিনি আমাদের সবার হাতে স্মার্টফোন থাকবে অথচ আজকাল আমরা স্মার্ট ফোন ছাড়া একটি দিনও কল্পনা করতে পারিনা। ভবিষ্যতে হয়তো মেটাভার্স এর দুনিয়ায় স্মার্টফোনের চেয়েও অনেক বেশি ডুবে থাকবো কারণ এটি হতে যাচ্ছে এক ধরনের ইন্টারনেট ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা।

বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য আমরা স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের সাহায্য নিচ্ছেন অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি চশমা মেটা ভার্স এর দুনিয়ায় কোন ডিভাইস স্ক্রিনে আপনাকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। মনে হবে যেন আপনি নতুন কোনো জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন যেখানে সব কিছু ঘটবে আপনার চোখের সামনে।

শুধু ফেসবুকে নয় বহু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব Metaverse জগত তৈরি করতে শুরু করেছে। মাইক্রোসফট ও অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব মেটাভার্স জগত তৈরি করছে।

বর্তমানে আমরা যেমন একটি ওয়েবসাইট থেকে আরেকটি ওয়েবসাইটে ভিজিট করি ভবিষ্যতে ঠিক একইভাবে মেটাভার্স এর একটি ভার্চুয়াল জগত থেকে আরেকটি জগতে যেতে পারবে। তবে মেটাভার্স সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হতে যাচ্ছে ভিডিও গেমিং ইন্ডাস্ট্রিতে।

EPIC game এবং ROBLOX ইতোমধ্যেই বিলিয়ন ডলার অর্থ খরচ করে তাদের ত্রিমাত্রিক জগত তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে। মেটাভার্স প্রযুক্তি আমাদের জীবনে প্রবেশ করলে ফেসবুকের মত প্রযুক্তি দানব প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের জীবনকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে ভার্চুয়াল জগতের কথাকথিত উন্নত জীবন আমাদের বাস্তব পৃথিবীতে আমাদের অনেক বেশি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মেটাভার্স এর মতই ভবিষ্যৎ এর মুদ্রা ব্যবস্থা হল ক্রিপ্টোকারেন্সি। এ ধরনের ভার্চুয়াল কারেন্সি কোন দেশের সরকার বা বড় কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রথম পরীক্ষামূলক মুদ্রা বিটকয়েন। স্বর্ণের উপর মানুষের আস্থা থাকার কারণে স্বর্ণের দাম যেমন বেড়ে যায় ঠিক একইভাবে বিটকয়েন এর উপর মানুষের ক্রমবর্ধমান আস্থার ফলে দিন দিন এর দাম বেড়েই চলেছে। বর্তমানে এক বিটকয়েনের দাম বাংলাদেশ ৫০ লক্ষ টাকার বেশি।

Writer: মোঃ আবু তালহা