সদ্য স্বাধীন দেশ। কিংবদন্তি স্থপতি মাজহারুল ইসলাম দেখা করবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তার সঙ্গে রয়েছেন এক তরুণ স্থপতি মুক্তিযোদ্ধা।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের একপর্যায়ে মাজহারুল ইসলাম সেই তরুণকে সামনে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই তরুণ আর্কিটেক্ট মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এদের দিয়েই এখন দেশের কাজ করাতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু সেই তরুণ স্থপতির পিঠে সস্নেহে হাত রেখে বললেন, ‘বাবারা! শুধু ঢাকা শহর নিয়ে প্ল্যান করলে হবে না। সারা বাংলাদেশ নিয়ে প্ল্যান করতে হবে।’সেদিনের সেই তরুণ স্থপতি জীবনভর বঙ্গবন্ধুর সেই অনুরোধটি পালন করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে।

সেই তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। তাকে আসলে ঠিক কতো অভিধায় রঞ্জিত করা যায় তা জানা নেই। জীবনের প্রথমভাগে তিনি অংশ নিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।

২৫শে মার্চে গণহত্যা শুরুর দু’দিন আগেও তাঁর মা আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে। কিন্তু জন্মভূমির চরম দুঃসময়ে তিনি স্বদেশ ছেড়ে নিরাপদে বিলেতে চলে যাননি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগে শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই তিনি হয়েছিলেন সন্তানের পিতা ।

কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেন এসব মায়া-ভালবাসা তুচ্ছ করেছিলেন। অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রমের অধীনে।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দেশের অভ্যন্তরে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি রণাঙ্গনে ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম গেরিলা ছিলেন।
বিনয়ী এই মানুষ রণাঙ্গনের যোদ্ধা হয়েও কখনোই মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি।

স্পষ্ট ভাষায় বলতেন ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলাদাভাবে সরকানি স্বীকৃতি নেওয়ার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।

মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি আবার ফিরে আসেন নিজ পেশা স্থাপত্যে। বিখ্যাত এই স্থপতি যেমন দুরন্ত ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে ঠিক তেমনি পটু ছিলেন তার নিজ পেশায়।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনই বুয়েটের ইতিহাসে একমাত্র শিক্ষার্থী, যিনি ফেল করেও বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন।উনি ভর্তি পরীক্ষার আগেই প্রচুর স্কেচ ও ড্রয়িং করতেন।

যখন ফেল করলেন, সোজা গেলেন আর্কিটেকচার এন্ড প্ল্যানিং ফ্যাকাল্টির প্রতিষ্ঠাতা ডিন রিচার্ড এডউইন ভ্রুম্যানের কাছে।নিজের যত ড্রয়িং বিষয়ক পুরষ্কার, পত্র পত্রিকা ছিল সব হাজির করলেন।

রিচার্ডকে বললেন, আমার এত ড্রয়িং, সংবাদপত্রে ছাপানো হয়, আমি কেন আর্কিটেকচারে ভর্তি হতে পারব না? ভ্রুম্যান বললেন, এগুলো তোমার আঁকা? তুমি কি আবার পরীক্ষা দিতে রাজি আছো? মোবাশ্বের হোসেন বললেন, হ্যাঁ।

ভ্রুম্যান একটা কাগজ আর পেন্সিল দিয়ে বললেন, ড্র এ নকশিকাঁথা।

আধাঘন্টা সময় দিলেন। মোবাশ্বের হোসেন যখন এঁকে দিলেন, ওটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে রেজিস্টারের কাছে চিঠি লিখলেন, এডমিট হিম, এখনই একে আর্কিটেকচারে ভর্তি করে নাও। (স্মৃতির খন্ডচিত্র, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন থেকে নেওয়া)

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে কর্মজীবনে চাইলে মোবাশ্বের হোসেন সরকারি চাকরির মতো নির্ঝঞ্ঝাট চাকরিজীবন ও বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে মাত্র দেড় মাস চাকরি করেই ইস্তফা দিয়েছিলেন ।

পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেন দেশ বরেন্য একজন স্থপতি। স্থপতি হিসেবে তিনি বেশ কয়েটি স্থাপনা নির্মাণে কাজ করেছেন।

স্থাপত্য শিল্পে তার সৃষ্টি কতটা নান্দনিক তার প্রমাণ চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের অপূর্ব নকশা কাঠামো। যেখানে তিনি ভবনের গৎবাঁধা নকশার চেয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন স্থাপত্যের মাধ্যমে প্রাণ সঞ্চার করাকে। একই উদাহরণ তার নকশায় করা মিরপুরের প্রশিকা ও গ্রামীণ ব্যাংক ভবনও।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন এসোকনসাল্ট লিমিটেডের প্রধান স্থপতি৷ কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস এবং আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল, এশিয়ার (আর্কেশিয়া) প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন৷

তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক পরিচালক, ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এবং সম্মিলিত ক্রীড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন।

তিনি কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস এবং বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট। স্থপতি মোবাশ্বের আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল, এশিয়া (আর্কেশিয়া)-এর প্রেসিডেন্টও ছিলেন।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন আমেরিকান স্থপতি ইনস্টিটিউট (এআইএ) প্রেসিডেন্ট পদক ২০০৯ লাভ করেন।

গত ২ জানুয়ারি, ২০২৩ রাতে মারা যান এই মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া সংগঠক ও নাগরিক আন্দোলনের সরব ব্যক্তিত্ব মোবাশ্বের হোসেন।

এমনকি তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মরদেহ চিকিৎসা শিক্ষার কাজে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম থেকে সব নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিঃসন্দেহে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের অবদান থাকবে চিরভাস্বর হয়ে।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের কীর্তি ও সংগ্রামী অভিযাত্রা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের বুকে।

বাংলাদেশ নিয়ে তিনি সবসময় ভীষণ আশাবাদী ছিলেন। বলতেন, ‘আমি পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত সম্ভাবনাময় দেশ কোথাও নেই।’

সারা দেশের গণমানুষের দোয়া, ভালোবাসা ও আর্শীবাদে যেনো প্রিয় মোবাশ্বের হোসেন কে আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন’, তার আত্মা যেন শান্তি পায় সেটাই আমাদের প্রার্থনা।

– Towhidul Islam