লিখেছিলাম ৭১ সালে আমরা যে কারণে স্বাধীনতার লড়াই করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে চলতে হবে।
অনেকেই তখন জানতে চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? অনেকেই জানতে চেয়েছেন, তবে কী ধর্ম আলাদা? বিজয়ের এই মাসের প্রথম দিনে একটা উদাহরণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম আর ধর্মনিরপেক্ষতা তিনটাই বোঝাতে চাই।
একটু ৭১ এ ফেরেন। পরিবারে কোন মুক্তিযোদ্ধা থাকলে তার কাছে যান। পরিবারে কেউ না থাকলে আশপাশের কোন কোন মুক্তিযোদ্ধার কাছে যান। এই যেমন আমার এক চাচার নাম শামসুদ্দিন। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা।
চাচার কাছ থেকেই গল্প শুনেছি, একজন মুসলমান হিসেবে আল্লাহ আর রাসুলের (সা.) নাম নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। রোযার দিনে তারা রোজা রেখেছেন। রোজা রেখেই যুদ্ধ করেছেন।
কোন মুসলমান মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে মারা যাওয়ার আগে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলল্লাহ বলেছেন।
এই যে আল্লাহ রাসুলের নাম নিয়েছেন সেটা হচ্ছে ধর্ম। আর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তিনি যে লড়েছেন সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ।
এই মুক্তিযুদ্ধে তিনি যে আল্লাহ রাসুলের নাম নিয়েছেন সেটা ধর্ম। কিন্তু যেমন বাংলাদেশের স্বপ্নে তিনি লড়াই করেছেন সেটা কখনোই ইসলামিক রাষ্ট্র ছিল না। তারা চেয়েছেন ধর্মনিরপক্ষে এক বাংলাদেশ।
কেমন হবে সেই বাংলাদেশ এই প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধাই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের স্লোগান ছিল জয় বাংলা। তাদের গান ছিল, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ,
বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি ।
এই যে বাঙালি পরিচয় সেটাই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশর ছবি। এই ছবির জন্যই হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। মনে রাখবেন আজকে যারা বাংলাদেশে ভাস্কর্য বা মুর্তি নিয়ে বিতর্ক করছেন যারা এতো বড় বড় ধর্মের কথা বলছেন তাদের মধ্যে কে মুক্তিযোদ্ধা ছিল? তাদের মধ্যে কারা কারা স্বাধীনতা চেয়েছিল? কতোজন তাদের মধ্যে বাংলাদেশ চেয়েছিল?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই দেখবেন তারা রেগে যাবে।গালিগালাজ করবে। নানা প্রসঙ্গে চলে যাবে। আরে বেটা স্বাধীন যে বাংলাদেশ তুই চাসনি সেই বাংলাদেশ কোন নীতিতে চলবে সেটা তুই বলার কে?
আর যদি বলতেও চাস তাহলে আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মেনে বলতে হবে।
আমার খুব পরিস্কার কথা। একাত্তরে যেমন আল্লাহ রাসুলের নামে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার জন্য মুসলমানারা যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধ করেছে অন্য সব ধর্মের মানুষ এমনকি যারা বাম রাজনীতি করেন তারাও যুদ্ধে করেছেন, তাদের সবার লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।
সেই বাংলাদেশের মূল নীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। কাজেই এই নীতি থেকে সরে আসার কোন কারণ নেই।
হ্যা একটা কথা আপনারা বলতেই পারেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে কী লুটপাট, দুনীতি-অপশাসন চলবে?? মোটেও না।
মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছিল গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য। কোন অপশাসনের জন্য নয়। কিন্তু এটাও মনে রাখবেন তারা চেয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ।
এখান থেকে সরে আসার কোন কারণ নেই। আর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কখনোই ধর্মহীনতা নয় যেটা মুক্তিযোদ্ধারা দেখিয়েছেন, যার কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু।
ডিসেম্বেরর শুরুর দিনের প্রথম লেখাটা শেষ করতে চাই একাত্তরের এক কিশোরীর গল্প দিয়ে। সালটা ১৯৭১।
ঘটনাস্থল কুড়িগ্রাম। ১১ নং সেক্টরের অধীনে কুড়িগ্রামে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে একটা ক্যাম্প করেছেন। ওই ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন মুক্তিযোদ্ধা মুহিব হাবিলদার।
ক্যাম্পের রান্নাবান্নার জন্য একটা সাহসী মেয়ে খুঁজছিলেন। এক কিশোরিকেও বাছাই করলেন তিনি। কিন্তু আপত্তি করলেন মেয়েটার মা।
মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মুহিব তখন ওই কিশোরির মাকে বললেন, আমার নিজের মেয়ের মতো করেই আগলে রাখবে।
দেশের জন্য মেয়েটাকে দিয়ে দেন। মা কুলসুম বেওয়া রাজি হলেন। সাথে সাথে লেখা হয়ে গেল নতুন এক ইতিহাস।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মেয়েটা শুরু করলেন রান্না। সেখানেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নানা গল্প শুনতেন। মেয়েটা জেদ ধরলেন তিনিও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবেন। ওই কিশেরারি সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখালেন।
শেখালেন কী করে হানাদারদের বুক বরাবর বুলেট ছুড়তে হয়। মেয়েটাও দারুণ শিখলেন। এর মধ্যেই একদিন তার বীরত্ব পুরো ক্যাম্পে গল্প হয়ে গেল।
সেদিন মধ্য দুপুর। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই খেতে বসেছে৷ কিশোরির দায়িত্ব পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কি না তা দেখা। সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারিদিকে লক্ষ্য রাখছিলো সেই কিশোরি৷
হঠাৎ দেখল, পাক বাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে৷ মেয়েটি দ্রুত সবাইকে খবর দিলেন। সবার আগে নিজেই অস্ত্র হাতে নিলেন।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চললো৷ হানাদাররা সেদিন পরাস্ত হলো। অনেক পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারামনও একের পর এক হানাদারের বুকে বুলেট ছুড়লেন। এরপর শুরু হলো রোজ নতুন নতুন ঘটনা।
শুধু সম্মুখ যুদ্ধই নয়৷ হানাদারদের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে মেয়েটি চলে যেত পাক বাহিনীর শিবিরে৷ কখনও সারা শরীরে কাদা মাটি, কখনো বা কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজে চলে গেছে হানাদার ক্যাম্পের কাছে। চুল এলো করে কখনো বোবা সেজে মেয়েটি আবার কখনো হানাদারের খোঁজে নদী সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন।
আমি জানি না আপনাদের কেমন লাগছে। কিন্তু আমার চোখ ভিজে উঠেছে। এই কিশোরির নামটা জানেন কী? নাম তার তারামন বিবি। সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই দেশে মাত্র দুজন নারী ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছিলেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম আরেকজন আজকের গল্পের তারামন বিবি।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তো “বীর প্রতীক” উপাধি পেল। কিস্তু কোথায় তারামন? ৭৫ এর পট পরিবর্তনে সবাই তো ভুলেই গেল সাহসী মেয়েটাকে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে আর কেউ খোঁজেনি।
তবে ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে প্রথম তারামন বিবির সন্ধান পান।
তাকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী। স্বাধীনতার ২৪ বছর পর রাষ্ট্র তার হাতে তুলে দেয় বীরত্বের পুরস্কার।
অবশ্য ফের তারামন বিবিকে ভুলতে সময় লাগেনি আমাদের। অর্ধাহারে-অনাহারে দুই বছর আগে এই দিনে পৃথিবী ছাড়েন তারামন বিবি।
আমরা যারা এই দেশের ১৭ কোটি মানুষ, তাদের মনে রাখা উচিত এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে তারামন বিবির জন্য।
এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে আমার মুক্তিযোদ্ধা চাচা শামসুদ্দিনের জন্য। এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে অস্টম শ্রেণীতে পড়ুুয়া বাবার জন্য যিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাড়ি ছেড়ে পালয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন।
আমরা যেন মনে রাখি সেই মুক্তিযোদ্ধার কথা যারা আল্লাহ রাসুলের নাম নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে ইসলাম বা সব ধর্ম থাকবে কিন্তু গোড়ামি থাকবে না।
তারা চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক সুন্দর এক বাংলাদেশ যেই বাংলাদেশে দুর্নীতি-লুটপাট থাকবে না। যেই দেশটা আসলেই হবে সোনার বাংলা। আমি রোজ সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। মৃত্যুর আগমুহুর্ত পর্যন্ত সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে যাবো। আমার জন্য, আমার সন্তানের জন্য, আগামীর জন্য।
লেখকঃ শরিফুল হাসান
সাংবাদিক
সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়