২০০৬ সালের মার্চ মাসে জ্যাক ডরসি, নোহাস গ্লাস, বিজ স্টোন এবং ইভান উইলিয়ামস টুইটার প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই বছরের জুলাই মাসে এটি চালু হয়।

শুরুর পর এটি মাইক্রো ব্লগিং সাইট বা ইন্টারনেটের এস এম এস সার্ভিস হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। শুরুর দিকে একটি টুইটে ১৪০ ক্যারেক্টার ব্যবহার করার লিমিট ছিলো যা ২০১৭ সালে ২৮০ ক্যারেক্টার করা হয়।

এলন মাস্ক তার প্রথম টুইট পোস্ট করেন ২০১০ সালের জুন মাসে। সেলিব্রেটিদের মিডিয়া হিসেবেই টুইটার বেশী জনপ্রিয় ছিলো, কারণ বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক নেতা এবং স্টাররা টুইটারের মাধ্যমে তাদের মতামত তুলে ধরেন। ২০১২ সালে বারাক ওবামা তার নির্বাচনে জয়ের খবর প্রথম টুইটারেই প্রকাশ করেন।

কিন্তু ২০২১ সালে আমেরিকার নির্বাচনের সময় ট্রাম্পকে ব্যান করা নিয়ে টুইটার সবার সমালোচনার মুখে পড়ে। মাস্কের টুইটার ক্রয়ের প্রাথমিক সূচনা হয় ২০২২ সালের ৩১শে জানুয়ারিতে, যখন তিনি ৯.১ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়ে সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডার হন। এরপর টুইটারের পক্ষ থেকে তাকে বোর্ড অব ডিরেক্টর এ যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়।

এপ্রিলের শুরুতে ইলন মাস্ককে বেশ খুশিই মনে হচ্ছিল টুইটারের পরিচালনা বোর্ডে যোগ দিতে পেরে। তিনি ঘন ঘন টুইট করছিলেন কিভাবে এই কোম্পানি এখন বদলে যাবে।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে আসলে সমস্যা ডানা বাঁধছিল। তার সঙ্গে টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পরাগ আগরওয়ালের বৈঠকে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কিভাবে টুইটারের নানা সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে, সে প্রশ্ন দুজনের মধ্যে বেশ মতভেদ তৈরি হয়েছিল। ইলন মাস্ক বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন।

এরপর ইলন মাস্ক ১৪ এপ্রিল একটা ঘোষণা দিয়ে সবাইকে চমকে দিলেন- তিনি টুইটার একাই কিনে নিতে চান। এজন্য তিনি ৪৪ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ চার হাজার ৪শ কোটি ডলার দাম অফার করে বললেন, এই দামে হলে তিনি কিনবেন, নইলে নয়।

টুইটারের বোর্ড সাথে সাথেই এই দাম প্রত্যাখ্যান করলো। তারা এমন কিছু ব্যবস্থাও নিল, যাতে করে ইলন মাস্ক টুইটার কিনতে না পারেন। কিন্তু তারপরেই অবশ্য টুইটারের বোর্ড তাদের মত বদলালো। তারা বললো, ইলন মাস্কের প্রস্তাবে তারা রাজী। ২৫ এপ্রিল টুইটার আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দিল।

ইলন মাস্ক টুইটার কেনার ঘোষণা দেয়ার পরের সপ্তাহ এবং মাসগুলোতে শেয়ার বাজারে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম পড়ে যাচ্ছিল। কোম্পানি হিসেবে টুইটারের দামও তখন কমতে থাকে। তখন অনেক বিশ্লেষকই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন, মি. মাস্ক টুইটারের জন্য বেশি দাম দিয়ে ফেলেছেন কিনা।

তবে মাস্ক প্রকাশ্যে ভিন্ন কিছু প্রশ্ন তুলছিলেন- তার একটা হচ্ছে, টুইটারে আসল ব্যবহারকারী একাউন্টের সংখ্যা কত?
ফোর্বস এবং ব্লুমবার্গ বিশ্বের সেরা ধনীদের যে তালিকা করেছে, ইলন মাস্ক আছেন তার শীর্ষে। তার সম্পদের পরিমাণ নাকি ২৫০ বিলিয়ন, অর্থাৎ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।

ইলন মাস্ক অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে যাচ্ছিলেন যে, টুইটারে বট বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি করা ভুয়া একাউন্টের সংখ্যা অনেক বেশি। টুইটার কেনার জন্য তার দেয়া প্রস্তাব যখন গৃহীত হলো, তখন তিনি বার বার জানতে চাইছিলেন, টুইটারের সত্যিকারের ব্যবহারকারীর সংখ্যা আসলে কতো।

টুইটারের নির্বাহীরা তখন জানিয়েছিলেন, প্রতিদিনের সক্রিয় ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫ শতাংশেরও কম আসলে ‘বট’ বা স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম ব্যবহারকারী। কিন্তু এই পরিসংখ্যান শুনে ক্ষেপে গিয়েছিলেন ইলন মাস্ক। টুইটারের সঙ্গে ইলন মাস্কের চুক্তি তখন বাদ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।

এরপর ৮ ই জুলাই তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চান।তবে টুইটার এসব কথা মানতে চাইছিল না। তারা যুক্তি দিচ্ছিল যে, টুইটার কেনার জন্য যে চুক্তি ইলন মাস্ক করেছেন, সেই চুক্তি মানতে তিনি আইনগতভাবে বাধ্য এবং এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

দুই পক্ষই এরপর নামী-দামী আইনজীবীদের নিয়োগ করেন, এবং ১৭ অক্টোবরে ডেলাওয়ারে এক আদালতে মামলার শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়, যেখানে মাস্ককে চুক্তি মেনে কোম্পানিটি কিনতে বাধ্য করা হবে।

আদালতে দাখিল করা কাগজপত্রে টুইটার বলেছিল, এই প্লাটফর্মের প্রকৃত ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য তারা ইলন মাস্ককে দিয়েছে। কিন্তু মাস্ক বলেছিলেন, বট একাউন্টের সংখ্যা সম্পর্কে টুইটার প্রকাশ্যে যে দাবি করে, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো তার কয়েকগুণ। তিনি এমনকি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ পর্যন্ত এনেছিলেন।

বিষয়টা যেন অবধারিতভাবেই আদালতে একটা মামলার দিকে গড়াচ্ছিল। মাস্ক নিজে, টুইটার, বিচারকরা, সাংবাদিকরা- সবাই প্রস্ততি নিচ্ছিলেন এই মামলার জন্য। কিন্তু তারপরই ঘটনা আবারও নাটকীয় মোড় নিল। টুইটারের বিরুদ্ধে নানা রকমের গাদা গাদা অভিযোগ করার পর আচমকা মাস্ক আবার ঘোষণা করলেন, তিনি চুক্তি মোতাবেক টুইটার কিনতে চান।

তিনি বললেন, “টুইটার কেনার মানে হচ্ছে ‘‘এক্স’’ অ্যাপ তৈরির কাজ ত্বরান্বিত হওয়া। এই এক্স অ্যাপকে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘এভরিথিং অ্যাপ’ বা সবকিছু করতে পারে এমন একটি অ্যাপ হিসেবে।
কেন তিনি তার মত বদলালেন?

হয়তো তিনি ভেবেছিলেন মামলায় তিনি হেরে যেতে পারেন। নিজের সিদ্ধান্ত বদলের কয়েকদিন আগে টুইটারের আইনজীবীদের এক প্রশ্নোত্তর পর্বে মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল তার। তিনি হয়তো একটা এরকম কড়া জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে অনেক তথ্য প্রকাশে বাধ্য হতে চাননি।

২৮ অক্টোবর লন্ডন সময় বিকেল পাঁচটার মধ্যে মিস্টার মাস্ককে টুইটার কেনার জন্য অর্থ পরিশোধ করতে হবে বলে কথা ছিল। ২৭ অক্টোবরেই মাস্ক টুইটার কেনা সম্পন্ন করেন। টুইটার কেনার জন্য তিনি প্রতিটি শেয়ার ৫৪.২০ ডলারে কিনে নেন যা তখনকার শেয়ারের মূল্যের চেয়ে ৬৪% বেশী।

ইলন মাস্কের ব্যাংক এবং ধনী বন্ধুরা এজন্যে শত শত কোটি ডলার ঢালছেন। বাকীটা দিচ্ছেন তিনি নিজে, কিছুটা টেসলায় তার শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। যে চুক্তিটা একদম ভেস্তে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল, তা এখন শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়েছে।

টুইটার কেনা সম্পন্ন হওয়ার পরেই তিনি সিইও, সিএফও, আইনী কাঠামো প্রধানসহ অসংখ্য কর্মকর্তাকে চাকরীচ্যুত করেন এবং তাদের বেশীরভাগই ভারতীয় এবং লিবারেল ঘরানার বলে জানা যাচ্ছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী তিনি টুইটারে মোট কর্মচারীদের সংখ্যা ৭৫% কমানোর চিন্তা করছেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী তিনি টুইটার ব্লু-সার্ভিসকে মাসিক ৮ ডলার পেইড সাবস্ক্রিপশন সিস্টেমে আনার ঘোষণা দিয়েছেন।

পাবলিক কোম্পানিকে প্রাইভেট করার এরকম আরেকটি উদাহরণ হলো ডেল। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল ডেল ২০১৩ সালে এটিকে প্রাইভেট কোম্পানিতে রুপান্তর করেন এবং পরে আবার পাবলিক করেন ২০১৮ সালে।