বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ প্রমোশনের কথা উঠলেই একটি অবধারিত বিষয় সমনে চলে আসে, সেটা হচ্ছে স্পেইস অথবা জমি স্বল্পতা।

এটা একামেডিশয়ানদের দিক থেকেও এই কথা খুব করে বলা হয়। অথচ দেশে সৌর বিদ্যুতের পটেনশিয়াল ইউরোপীয় বহু শহরের তুলনায় ১,৪ থেকে ১,৫ গুণ বেশি। স্পেইস সংকটের কোনই সমাধান আনা কি যায় না?

বাংলাদেশের নবায়যোগ্য নিরাপদ জ্বালানির সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা সুর্যালোকে, এর পরে রয়েছে ওয়েস্ট (এগ্রো, হিউম্যান) বায়োমাস, হাইড্রো (কাপ্তাই, নদীর স্রোত, সাগরের ঢেউ), উইন্ড, জিও থার্মাল।

এগ্রো ওয়েস্ট, হিউম্যান ওয়েস্ট, হাইড্রো, উইন্ড, জিও থার্মাল, বার্জ মাউন্টেড, বায়োমাস ইত্যাদি নিয়ে কার্যকর ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন চালিয়ে যাবার মত যুতসই গবেষণা এগিয়ে যায়নি, ফলে মাস প্রডাকশনের জন্য এই খাত গুলোর পটেনশিয়াল কতটা, তা সংশয়যুক্ত।

অনুমান ভিত্তিক পরিকল্পনা তাই এই খাত গুলোতে এগুচ্ছে না।

ত্রি মাত্রিক উইন্ড ম্যাপ নিয়ে কথা হচ্ছে না এখানে, নাই অফশরের বায়ু বিদ্যুৎ সম্ভাবনা যাচাইয়ের আলোচনা। নেই সাঙ্গুর হাইড্রো পটেনশিয়াল নির্ণয়ের তাগাদা। নেই টাইডাল ওয়েভ ও অফশোর টার্বাইনের যৌথ প্রোডাকশনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ।

বিশ্বের সবচাইতে বেশি ঘনবসতির শুহুরে আবাসনেও নেই হিউম্যান ওয়েস্ট বেইজড রিনিউএবল সোর্স খোঁজার তাগিদ!

কোস্টাল বেল্টে উইন্ড প্রতিশ্রুতিশীল হলেও সরকারগুলোর নির্লিপ্ততায় ও মানহীন দুর্নীতির কাজে বায়ু বিদ্যুতের মুহুরি এবং কুতুবদিয়া পিডীবির বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে (বায়ু বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি উৎপাদন ১৬ থেকে ২৪ টাকায় ঠেকেছে)।

বাংলাদেশে বায়ু প্রবাহের স্বল্পতা বহুল প্রচারিত। তবে এখনও আমাদের ত্রিমাতৃক বায়ু প্রবাহ বিন্যাস তৈরি হয়নি, তার পরেও বিভিন্ন থিউরিটিক্যাল উইন্ড ম্যাপ এবং আবহাওয়া জরিপে দেখতে পাই উপকূলীয় বেল্টে নাফ-কুতুব্দিয়া থেকে ফেনীর মুহুরী পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকত ও সৈকত সংলগ্ন গ্রামে এবং পঞ্চগড়ে বায়ু প্রবাহ মধ্যম পর্যায়ের কমার্শিয়াল উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত।

সীমিত সম্ভাবনাতেও যে বায়ু বিদ্যুতের যে পটেনশিয়াল আছে তাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা বিরল! সভ্যতার এই যুগেও, কথিত উন্নয়নের এই অপ্রতিরোধ্য সময়েও যেসব আভাগা উপকূলীয় রিমোট গ্রামে এখনও বিজলির আলো জ্বলেনি (সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার অনুপুস্থিতিতে বা অন্য কারণে), সেই জনপদ গুলোতে আলো নিয়ে আসা যায় দেশীয় প্রযুক্তিতেই, কম খরচে, প্রাণ ও প্রকৃতিকে বাঁচিয়েই।

অন্যদিকে সোলার পটেনশিয়াল প্রমাণিত। সোলার ইরোডিয়েন্স সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বৈশ্বিক সূচকের মাঝামাঝি থেকেও কিছুটা ওপরে, বলা চলে ইউরোপের বেশ ওপরে যেখানে ঘরের চালায় সোলার প্যানেলের সোভা খুবই কমন।

হাতে গুনা কয়েকটি একটিভ ও প্যাসিভ সমস্যা যা ব্যবস্থাপনা উতকর্ষে ও সীমীত কারিগরি বাস্তবায়নে কাটিয়ে উঠা যায়!

১। ডিস্ট্রিবিউশন এন্ডে যে কোন পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিক্রির তরে গ্রীড টাই আপ উপযোগী ইনফাস্ট্রাকচারের অনুপস্থিতি এবং এতদসংক্রান্ত দুর্নীতি বান্ধব নীতিমাল বিষয়ক জটিলতা নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশে বড় বাঁধা।

২। সৌর বিদ্যুতের গ্রাহক অবান্ধব মডেল যা ব্যক্তি গ্রাহককে নিজ খরচের অরিতিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করতে দিচ্ছে না। কিংবা সম্পূর্ণ বিক্রয় উপযোগী উদ্যোক্তা মডেলকে সুচনা করতেই দেয়া হচ্ছে না। ফলে এই খাতে ক্ষুদ্র বা মাঝারি উদ্যোক্ত তৈরি হচ্ছে না।

পিডীবি, পিজিসিবি ,পল্লী বিদ্যুতের উৎপাদন সঞ্চালন ও বিতরণের কাঠামোর অনুপস্থিতিতেও রিমোট কোস্টাল কিংবা দ্বীপাঞ্চলে সৌর কিংবা বায়ু বিদ্যুতের ডিস্ট্রিবিউশনে কমিউনিটি গ্রীড অথবা কমিউনিটি বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেয়া হচ্ছে না।

৩। মানহীন সোলার প্যানেল, অতি নিন্ম মানের ব্যাটারি, ডিসি এপ্ল্যায়েন্স এর প্রমোশনহীনতা ও ডিসি-এসি কনভার্শন জনিত উচ্চ খরচ।
তবে চাইলেই এই কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা নীতি কেন্দ্রিক সমস্যা গুলো কাটিয়ে উঠা যায়।

তবে স্থান ও জমির সংকট বাংলাদেশকে উরতে উঠতে হবে।

ক। বাংলাদেশের রাজধানী ও অন্য বড় বড় শহর গুলো ঘনবসতি পুর্ণ ইট পাথরের দালানে ভরা।

একটি পুরো এলাকার ভবন গুলোর পাশপাশি দূরত্ব এত কম যে (এমনকি রাস্তাও এত সংকীর্ণ যে), এই স্থাপনা গুলোকে নির্দিস্ট বা কাছাকাছি ভার্টিক্যাল উচ্চতার এলাকা ভিত্তিক “ওভার দ্য গ্রাউন্ড” স্পেইস রূপ দেয়া মোটেই জটিল কিছু নয়।

শুধু ছাদের উপরস্থ পানির ট্যাংকের ডিজাইন কিছুটা মডিফাই করার দরকার পড়বে তাও সব খানে নয়। এখানে উল্লেখ্য বেশ কিছু এলাকায় ইতিমধ্যেই রাজউকের সর্বোচ্চ উচ্চতার বাস্তবায়ন হয়েছে (উত্তরা, ধানমন্ডী, নিকেতন, নিকুঞ্জ, বনশ্রী, মহানগর সহ রাজউকের প্রজেক্ট গুলো উল্লেখযোগ্য)।

খ। রাজধানীতে ও এর বাইরে লক্ষ লক্ষ স্কয়ার ফিটের সরকারি অফিসের ছাদ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত একাডেমিক ও হল ভবন, সচিবালায়, আদালত পাড়া, রেইলওয়ে কলনী, পোস্টাল কলোনী, এজিবি, আজিমপুর, আগারগাও কলোনী পাড়া গুলোর শত শত নির্দিস্ট উচ্চতার সুবিশাল ও বিস্তৃত ভবনের ছাদ যুগ যুগ ধরে অব্যবহৃত থেকে গেলেও আমরা সেগুলোতে “স্পেইস” সমস্যার সমাধান দেখিনি বা দেখার চেষ্টা করিনি।

খোদ বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার আঁতুড় ঘর বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, ডুয়েট, আই আই টির ভবন গুলোর ছাদ অথবা ঢাবি, জবি, রাবি,জাবি, চবি, খুবি, ইবি, কৃবি’র সুবিশাল একাডেমিক ও হল ভবনগুলোর সুবিস্তৃত ছাদ গুলো সৌর প্যানেলের উৎপাদন মূখী শোভা পায়নি এটা বড়ই লজ্জাকর।

গ। গ্রামীণ সমাজে টিনের চালার ঘরে এখনও দেশের মেজরিটি শ্রমজীবী মানুষের আবাস। টিনের চালার ঘরের ভার্টিক্যাল রিপ্লেইস্মেন্ট দিয়ে কৃষি ভূমির সংরক্ষণ নিয়ে যেমন কথা হয়নি, তেমনি টিনের চালাকে সোলার প্যানেল দিয়েও রিপ্লেইস করার উপলভদ্ধি আসেনি।

ঘ। সৌর বিদ্যুতের জন্য শহুরে ছাদ বা গ্রামীণ ঘরগুলোর চালের মডেল ঠিক কিরূপ করলে বেশি এনার্জি পাওয়া যাবে তার সাধারণ বা বিশেষায়িত গাইডলাইন তৈরি হয়নি।

অর্থাৎ সূর্যের উদয়-অস্তের বাৎসরিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঘরের চাল দেয়া বা ছাদের পানির ট্যাংক বসানোর কোন গাইডলাইন নেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শহরে বা গ্রামে পরিবেশ সম্মত ভার্টিক্যাল গণ-আবাসনের ডিজাইন ও বাস্তবায়নের নতুন উদ্যোগ নেয়া চাই।

যেখানে একদিকে গ্রীষ্মে গরম, বর্ষায় ড্রেনেইজ ও শীতে ঠাণ্ডার বিপরীতে অন্তত নিন্ম মধ্যবিত্ত, নিন্ম বিত্ত ও একেবারেই প্রান্তিক নাগরিককে কিছুটা কম্ফোর্ট দেয়া যাবে, একই সাথে বিপর্যয়কর কৃষি ভূমি ভরাট থেকে রক্ষাও করা যাবে।

অন্যদিকে এই নতুন গণ-আবাসনকে সৌর শক্তির প্রাপ্তি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ব্যবহৃত পানির রিসাইকেল ও ওয়েস্ট প্রসেসিং ইত্যাদি নবায়নযোগ্য জ্বালানির সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে সাশ্রয়ী দেশীয় সবুজ প্রযুক্তির বিকাশে মনোযোগ দেয়াও কর্তব্য।

সাথে সাথে একটু শহুরে উচ্চ বিত্তীয় বাড়ি ও তার ছাদ কিভাবে সোলার, রেইন ওয়াটার ও সুয়েজ ওয়াটার রিসাইকেলের পুর্ণ বেনিফিট নিতে পারে তারও কর্যকর গ্রীণ মডেল নিয়ে ভাবতে হবে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানীর বিকাশের নীতিমাল কার্যকর নয়, এটা উৎপাদন বিমূখী।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিতরণের কারিগরি অবকাঠামো নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রমোট করার আদলে পরিকল্পিত করা হয়নি। এরও বাইরে রয়েছে দেশীয় আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠা চ্যালেঞ্জ গুলোর কোন বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধানের উদ্যোগের স্বল্পতা প্রকট।

এই তিনে বিপর্যস্ত দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানীর আশু কিংবা দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশকে নন নিউক্লিয়ার নবায়নযোগ্য শক্তির সহজীকরণের সমাধান খুঁজতে হবে, নিজ উদ্যোগেই!

স্তানীয় জ্ঞান না থাকায় বিদেশীরা এসেও স্থানীয় ডেমগ্রাফিক ও ইকোনোমিক সিসুয়েশনের উপযোগী টেকসই সমাধান বের করতে পারবে না।

তাই নেতৃত্বকে, দেশীয় শিক্ষাবিদ ও প্রযুক্তিবিদদের জেগে উঠার ডাক দিয়ে যাই!
এনার্জি ব্যবস্থাপনা দুরদর্শী হোক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক!

লেখক- প্রকৌশলী ফাইজ আহমেদ তৈয়ব

টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক