তখন রাত দুটা বাজে। ২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর। বাসে করে লন্ডন হিথরো বিমান বন্দর থেকে অক্সফোর্ডে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার পেরিয়ে শুক্রবার হয়ে গেছে।

নতুন শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের শেষ দিন। সবাই যেখানে freshers’ week এ আনন্দ করছে, আমি সেখানে কেবল শেষ দিনে যাচ্ছি।

পড়ুন Oxford: City of Dreaming Spires

এর কারণ, আমি আমার ইউকে ভিসা পাই সেদিনই। বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ড থেকে জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরে যাই ভিসা নিতে।

ফ্লাইট কিনে নিই সে রাতের জন্যই। ডুসেলডর্ফ থেকে সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। তাই ফ্রাংকফুর্ট থেকে রাতের শেষ ফ্লাইটের টিকেট কিনে নিই।

সাথে ডুসেলডর্ফ থেকে ফ্রাংকফুর্ট যাবার বুলেট ট্রেনের টিকেট, কারণ হাতে একদমই সময় নেই। তখন ব্যাংকে কোন টাকাই নেই, তবে তত দিনে একটি ক্রেডিট কার্ড করতে পেরেছিলাম।

এতটা দেরিতে ভিসা পাওয়ার মূল কারণ আমার স্কলার্শিপ নিশ্চিত হয় কেবল এর এক মাস আগে।

তখন আমি মাস্টার্স থিসিস শেষ করে বাংলাদেশে চলে গেছি। জীবনে কেবল এই একটি পিএইচডিতে দর্খাস্ত দিই। এটা না হলে আমেরিকার জন্য এর পরের বছর চেষ্টা করার ইচ্ছা ছিল।

তাই স্কলার্শিপটির ইমেইল যখন শেষ পর্যায় পেলাম, তখন দ্রুত সামিদের ওখানে (নেদার্ল্যান্ডে) চলে যাই ভিসার দর্খাস্তটি জার্মানি থেকে করতে। আমি প্রায় সম্পূর্ণরূপে আসা ছেড়ে দিয়াছিলাম।

স্কলার্শিপ ছাড়া তো আর যাওয়া সম্ভব নয়। অক্সফোর্ডে পিএইচডিতে এডমিশন পেয়েছি – এটুকুই বা কম কী?

স্কলার্শিপটি এত পরে আসার একটি গল্প আছে। তখন ইউকেতে ব্রিটিশ বা ইউরোপীয়দের চেয়ে বাকি সবার টিউশন ফী লাগত ৩ গুণ (এখন ইউরোপীয়োদেরও ৩ গুণ প্রয়োজন হয়)।

আমাদের ডিপার্টমেন্টে এ ধরণের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মাত্র কয়েকজনের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ থাকে।

বছরে মাত্র কয়েকজনকে এখান থেকে স্কালার্শিপ দেয়া হয়, যার অধিকাংশ দেয়া হয় আমেরকার এমআইটি বা স্ট্যানফোর্ডের মত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য।

আমার প্রফেসরের কাছ থেরে পরে জানতে পারি সিলেকশন কমিটির সবাই প্রথমে আমাকে বাঁধা দিয়েছিল এই বলে যে, এই জার্মান ডিগ্রী ওয়ালা বাংলাদেশিকে না নিয়ে আমরা তিন জন জার্মানকে নিতে পারি!

এই হাসানটা এমন কী? সেখানে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। বেশ কয়েক মাস এভাবে চলার পর আমার কেসটিই জিতে যায়। আমার প্রফোসর আমাকে পরে বলেছিলেন যে, অক্সফোর্ডের জন্য ১০০ জন ছাত্র নেয়ার চেয়ে ১ জন ভাল ছাত্র নেয়া বেশি প্রয়োজন।

মেধার মূল্য এদের কাছে সবার আগে। তখন ঠিক কথাগুলো বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি। অক্সফোর্ড এমনই ১ নম্বর নয়।

যা হোক, আবার ফিরে যাই অক্সফোর্ডের পথে সেই বাসে। বাসটি ধীরে ধীরে বাঁক নিতে নিতে হঠাৎ যেন অতীতে চলে গেল। মনে হল আমি হঠাৎ বর্তমান থেকে কয়েকশ বছর পুরোনো কোন দেশে চলে এলাম।

ইউরোপের আর কোন শহর তো এমন নয়। গ্লস্টার গ্রীন (Gloucester Green) স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই Wolfson College এ। ট্যাক্সি ড্রাইভার আফগানিস্তানের।

আমি বাংলাদেশি হিসেবে এখানে পিএউচডি করতে এসেছি শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি! Wolfson College এ গিয়ে রুমের চাবি নিলাম। খুব পুরোনো একটি ঘর।

খুব বেশি ভাবার সময় পেলাম না। তখন খুব ক্লান্ত। শুধু জার্মানি থেকে আসার ক্লান্তি নয়। এ ক্লান্তি ছয় বছর জার্মানিতে প্রতিদিন যুদ্ধ করবার ক্লান্তি।

হঠাৎ যেন শরীর থেকে হাজার টন বোঝা নেমে গেলে। সেই সাথে চলে আসল শান্তির ঘুম।

শুক্রবার রেজিস্ট্রেশন শেষ করে অক্সফোর্ড শহরের কেন্দ্রে Radcliffe Camera নামক লাইব্রেরীর দিকে যাই। এই দালানের ছবিই আপনারা সব জাগায় দেখে থাকেন।

এর পাশ দিয়ে যখন হেঁটে চলছি, হঠাৎ যেন বাস্তবতা আমাকে ঘিরে ধরে। আমার হাঁটুগলো যেন কাঁপছে। জ্ঞান জগতের সর্বোচ্চ এই স্বর্গে হঠাৎ নিজের অবস্থানকে অনুধাবন করার প্রতিটি ক্ষণ যেন অনুভব করছি।

অসংখ্য নিদ্রাহীন রাত আর অজস্র ত্যাগের মূল্যায়ণ যেন একই সাথে হাতে পেলাম।

আমার জীবনের সেরা পাঁচটি বছর ছিল অক্সফোর্ডের সময়টি। একটি পিএইচডি আর একটি পোস্টডক। আমার পিএইচডিতে আমি সর্বপ্রথম একটি বিশেষ সমস্যার সমাধান করি এবং একটি সূত্র আবিষ্কার করি (এ নিয়ে পরে লিখব)।

পাই সমগ্র ইউকেতে প্রকৌশল বিষয়ে সেরা পিএইচডিগুলোর পুরষ্কার।

ছবিটি অক্সফোর্ডে আমার প্রথম বর্ষে তোলা।

লেখক- হাসান সাদ ইফতি

এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।