পদ্মা সেতু নির্মাণে ম্যানেজমেন্ট আর টেকনিক্যাল পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে কিছু পয়েন্ট দিচ্ছি। মনোযোগ দিয়ে পড়ুন
১) ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মেগা প্রোজেক্টে বিশ্বের প্রথম সারির কোম্পানিগুলো কাজ করে। যাদের থাকে প্রয়োজনের চাইতে বেশী এক্সপেরিয়েন্স, টেকনোলজি, আর এক্সপার্টিজ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়ন থাকে সিকিওরড, সরকার পরিবর্তনে ফান্ডের ফ্লো এর ব্যাঘাত হয় না, কাজের জন্য কাউকে উপরি বা ঘুষ দিতে হয়না, বাজেটে রিস্ক কম থাকে। বাজেট এস্টিমেটাররা অত্যন্ত এক্সপেরিয়েন্সড থাকায় প্রোজেক্টগুলো হয়, ‘ফিক্সড প্রাইস প্রোজেক্ট’ যেখানে ফিক্সড বাজেটে , নির্দিষ্ট শিডিউলে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়।

ফান্ডিং এর রিস্ক এর কারনে বিশ্বের টপ র‍্যাঙ্কিং কোম্পানিগুলো দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্বের সরকারের অর্থায়নের প্রজেক্টে কাজ করে না।

অতএব, বাংলাদেশ যখন নিজ অর্থায়নে সেতু করবে বলে ঘোষণা দেয়, তখন সেতু নির্মাণে এগিয়ে আসে অপেক্ষাকৃত কম মানের কোম্পানিগুলো। এরা সাধারণত ক্লায়েন্ট সরকারের সাথে পলিটিক্যালি ইনভল্ভড থাকে আর এদেরকে অপেক্ষাকৃত সহজে ইনফ্লুয়েন্স করা যায়। ফলে এক টাকার জায়গায় বিল দশ টাকা ধরতে বললে, এদের এথিকালি খুব একটা প্রবলেম হয় না।

এবার চলুন দেখি চীনের যেই কনট্রাক্টর কোম্পানি ‘China Major Bridge Engineering Co’ (MBEC) কে মুল সেতুর কাজটা দেয়া হয়েছে গ্লোবাল র‍্যাঙ্কিং এ তাদের স্থান কোথায়। কোম্পানির নিজ প্রোফাইল পেইজেই বলা হচ্ছে, “The Company was ranked among 225 top international contractors and listed as one of the top ten international bridge contractors by Engineering News Record (ENR) in 2004.” (১) অথচ এই লিস্ট ২০১৪/১৫ সালে লাস্ট বের হয়েছে, আর সেই লিস্টে প্রথম ২৫০ এর মাঝে এদের নাম নাই। (২)

MBEC সম্বন্ধে জানতে তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে কোন তথ্য পাই নাই। তারা একটা পোস্ট আজ পর্যন্ত দেয় নাই। না তাদের বাংলাদেশ পেইজে না আন্তর্জাতিক। (৩)

পদ্মা সেতু হবে এই কোম্পানির সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক প্রোজেক্ট, “It was the largest international bridge construction project that Chinese enterprises have ever undertaken, with a bid amount of 1.549 billion U.S. dollars.” (৪)

তাদের প্রফাইলে এও বলেছে যে তারা পাকশি সেতু নির্মাণ করেছে, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু, “The Largest Bridge in Bangladesh – Paksey Bridge” । (১) অথচ পাকশি সেতুর উদ্বোধন হয়েছে ১৯১৫ সালে

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কেন এমন কোম্পানিকে কাজ দেয়া হলো যাদের আন্তর্জাতিক ভাবে এত বড় সেতু করার পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই? আমার জানামতে বাংলাদেশের কন্সাল্যেন্টগন, যারা কোম্পানি বাছাইয়ে ইনভল্ভড ছিল তারা এমবিইসি কে এই কাজ দিতে চায়নি, কিন্তু সরকারের উপর লেভেলের প্রেসারে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই কোম্পানি বাংলাদেশে এর আগে আরও ৪টি কাজ করছে। অতএব এরা চেনা পরিচিত ছিল।

২) কাজের অগ্রগতি আর খরচের পরিমান দেখেই বুঝা যাচ্ছে এটা ‘কস্ট প্লাস’ প্রজেক্ট বা চুক্তি। এই চুক্তির নেচার হচ্ছে, কোম্পানি যত ঘন্টা কাজ করবে তত বিল করবে। এও বুঝা যাচ্ছে, টেন্ডার কলের সময় ব্রিজের ‘স্পেসিফিকেশানে’ প্রজেক্টের রিকয়ারমেন্ট গুলোকে স্পষ্টভাবে লেখা হয় নাই। বুঝে কিংবা না বুঝে, যেভাবেই হোক অনেক কিছু উহ্য রেখেই ব্রিজের কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়েছে। ফলে প্রয়োজনে/অপ্রয়োজনে রিকয়ারমেন্ট ক্রিপ হয়ে কাজ ডিলে হচ্ছে আর খরচ বাড়ছে।

৩) এই প্রজেক্টের ইন্টারেস্ট রেইট অত্যন্ত বেশী। যেখানে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেইট ছিল ০.৭৫% সেখানে বাংলাদেশ সরকারের ইন্টারেস্ট রেইট হচ্ছে ১০%, আর টাকা আসছে লোকাল ব্যাংকগুলো থেকে। কিন্তু সরকার যখন এসব ব্যাংককে টাকা ফেরত দিবে তখন দিবে ৫-৬%, অর্থাৎ সরকার শুল্ক হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে ৪-৫%। চাইনিজ অর্থায়ন কেবল মাত্র রেললাইন কন্সট্রাকশানের উপরে, আর তাতে সুদের হার কেবল ২-২.৫%।

৪) দেশের বর্তমান সরকার যেখানে ঘুষকে ঘুষ মনে করে না, মনে করে স্পিড মানি, সেখানে সরকারী অর্থায়নে এই মেগা প্রজেক্টে কত স্পীড মানি কার পকেটে ঢুকছে তার হিসাব কে জানে……।

৫) প্রজেক্ট শুরুর আগে নদী শাসন ইনকমপ্লিট থাকা অবস্থায় , সরকার জনগণকে কাজের প্রগ্রেস দেখানোর জন্য এপ্রোচ সাইড দুটো ড্রাইল্যান্ডে করে ফেলায়, নদীর ভিতরে পিয়ারগুলো অপ্টিমাম লকেশানে বসাতে পারে নাই। এর ফলে অনেক গভীরে পাইলিং করে পিয়ার বসাতে হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে।

৬) ধারনা করেছিল পিয়ারের সংখ্যা কমিয়ে, স্প্যানের লেন্থ (দৈর্ঘ্য) বাড়িয়ে সেতুর খরচ কমাবে, কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উলটা। স্প্যানের লেন্থ বাড়ায় প্রতিটি পিয়ারের উপর যেহেতু লোড বেড়ে গেছে, তাতে পাইলিং করতে হয়েছে অনেক বেশী। একই সাথে ট্র্যাসের রিডিজাইন করতে হয়েছে। ফলে খরচ গেছে বেড়ে।

৭) পাইলিং এর জন্য বিশ্বের বেস্ট হ্যামার তৈরি করে জার্মানি। সেখান থেকে প্রথম যে দুইটা হ্যামার আনা হয়েছিল, টেকনিক্যাল কারনে তা অকেজো হয়ে পড়ে আছে। যেহেতু এই হ্যামারগুলো সময় মতন ঠিক করার জন্য বাংলাদেশের লোকাল এক্সপার্টিজ নাই, তাই অপেক্ষা করতে হচ্ছে জার্মানির ইঞ্জিনিয়ারদের আগমনের উপর। এত বড় ব্রিজ নির্মাণে এখন কাজ করছে মাত্র একটি হ্যামার। এই কারনে কাজের শিডিউল বেড়ে গেছে।

৮) প্রোজেক্টের কনসাল্টেন্ট হিসাবে বাংলাদেশ থেকে যেসব প্রযুক্তিবিদদের নিয়োগ করা হয়েছে তারা বিভন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার, শিক্ষক। তারা এই ধরনের জটিল প্রজেক্টে এর আগে কাজ করে নাই। তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান আছে ঠিকই, কিন্তু প্রফেশনাল এক্সপেরিয়েন্স নাই। যার কারনে তারা অনেক কিছু প্রেডিক্ট করতে পারেন নাই, ডিজাইনের ভুলগুলো সময় মতন ধরতেও পারে নাই। ফল স্বরূপ বেশ কিছু রিডিজাইন করতে হয়েছে, এডিশোনাল চেঞ্জ অর্ডার এসেছে। এতে কস্ট বাড়ছে, শিডিউল দির্ঘায়িত হচ্ছে।

‘আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিব’ এটিট্যুড নিয়ে নিজ অর্থায়নে কাজ শুরু করেছে হাসিনা সরকার। কিন্তু না আছে নিজেদের এক্সপার্টিজ, না আছে প্রজুক্তি, তার উপর কাজ দেয়া হয়েছে এমন কোম্পানিকে যারা এত বড় মেগা বাজেটের কাজ এর আগে করে নাই। এখানে ব্লাইন্ডস আর লিডিং দ্যা ব্লাইন্ডস। ফলত সবাই যাচ্ছে লং লার্নিং কার্ভের মধ্য দিয়ে। ভুল হচ্ছে, ডিজাইন চেঞ্জ হচ্ছে, খরচ বাড়ছে, সময় লাগছে। দেখবেন ২০১৮ সালেও পদ্মাসেতুর কাজ শেষ হবে না। যদি সব ভুল সংশোধন করে, পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে চায় তাহলে মিনিমাম ২০২০-২১ পর্যন্ত সময় লাগবে। আর নির্মাণ বাজেট কোথায় যেয়ে শেষ হবে তা এই মুহূর্তে প্রেডিক্ট করা মুশকিল। কারন ডিজাইনে আর কতো ভুল আছে, কে কতো কমিশন খাবে, কতো দিন এসব চলবে তা প্রেডিক্ট করা মুশকিল।

কাজ যখন ঠিকঠাক করে শেষ হবে, তখন তা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে সন্দেহ নাই, কিন্তু একই সাথে এই বিশাল বাজেটের বোঝাও এই দেশের ট্যাক্স পেইং জনগন টানবে।
১) http://www.ztmbec.com/english/tabid/3792/Default.aspx
২)https://www.enr.com/…/2015_Top_250_International_Contractor…
৩) https://www.facebook.com/pages/China-Railway-Major-Bridge-Engineering-Group-Co-Ltd-MBEC/1489568231351446
৪) http://en.hubei.gov.cn/…/news…/201406/t20140606_504501.shtml
৫)চার পিলার বানিয়েই ৫২% অর্থ নিয়ে গেছে চায়না মেজর ব্রিজ
Writter: Sabina Ahmed