প্রধানমন্ত্রী!,

পায়রা বন্দরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ঋণ প্রদানের যে সিদ্ধান্ত আপনি নিয়েছিলেন, সে সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ছিল। এটা প্রমাণিত হয়েছে। সাফাই গাইয়েন না, প্লিজ।

পায়রা বন্দর নিজেই অকার্যকর থাকে যাবে, আপনারা নিজেরাও ভুল পরিকল্পনা বুঝতে পেরে গভীর সমুদ্রবন্দর পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন। হিমালয়ান মিহি পলিবাহিত বৃহৎ নদীর সাড়ে দশ মিটার গভীর চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে গভীর সমুদ্রবন্দর হতে পারে না (জাইকা প্রতিবেদন)।

তদুপরি এই বন্দর ডলারে আয় করবে না বলে এখানে রিজার্ভ ঋণ ভুল পরিকল্পনা ছিল। এখন বলছি না। প্রথম থেকেই এটার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছি।

প্রধানমন্ত্রী আপনি আজ বলেছেন, ‘বিদেশি অর্থায়নে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। সে কারণে আমাদের রিজার্ভের টাকা দিয়ে, সম্পূর্ণ আমাদের টাকা দিয়ে অর্থাৎ বাংলাদেশের যে রিজার্ভ, সেই রিজার্ভের টাকা দিয়ে একটা ফান্ড তৈরি করেছি।

এই ফান্ড নামটাও আমি নিজেই দিয়েছিলাম, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ইনফ্রাস্টাকচার ফান্ড (আইডিএফ)। অর্থাৎ, বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল। এটা তৈরি করি এবং আমদের রিজার্ভের টাকা দিয়ে এই ফাণ্ডটা সৃষ্টি করি। সেই ফান্ড থেকেই আমরা এই বন্দরের ড্রেজিং কাজটা শুরু করেছি।’

আপনি আজকে সাফাই গাইছেন। অথচ আপনার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য জবাবদিহি করা দরকার ছিল। যে ডলার রিজার্ভ ভুল পরিকল্পনায়, ভুল হাতে ঋণ দিয়ে আটকে রেখেছেন, সেই ডলারের জন্যই আজকে আপনার দল, বিদেশি অর্থায়নের জন্য আইএমেফ, এডিবি, জাইকার দ্বারে দ্বারে ঘুরছে।

সম্ভবত দ্বিমুখী পরিকল্পনা এবং লজ্জায় পড়ে আপনার নিজের অর্থমন্ত্রীও আজ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, তিনি অফিস করেন না।

স্পষ্ট স্বীকার করা উচিৎ ছিল, আইডিএফ দিয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে ঋণ দিয়ে আপনি দেশের রিজার্ভকে সংকটাপন্ন করেছেন।

শুধু ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে নয়, আপনি রপ্তানি সহায়তায় ঋণ দিয়েছে প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার। আমরা আপনাকে সতর্ক হতে বলেছিলাম, কেননা সব ব্যবসায়ী সৎ নয়। আজকে তা প্রমাণিত হয়েছে।

এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের স্বল্পমেয়াদি ঋণ কেন ফেরত আসছে না, এর উত্তর আপনার কাছে আছে?

‘বাংলাদেশঃ অর্থনীতির ৫০ বছর’ (পৃষ্ঠা ২০৯-২১২, প্রকাশ- ১লা মার্চ ২০২১, আদর্শ)

বইতে ”ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ থেকে ঋণ” নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলাম। আমরা বলেছি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা তৈরি গেছে, তাই এটা দিয়ে নতুন করে ঋণের বিপরীতে অর্থ তৈরি নয়, কেননা প্রকল্প গুলো বৈদেশিক মূদ্রায় আয় করতে পারবে এমন নিশ্চয়তা নেই।

রপ্তানি আয়ের বিপরীতে আমদানি আরো বেশি কমে গিয়ে, হুন্ডি বন্ধ হয়ে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি উত্তরোত্তর বাড়ছে। ডিসেম্বর ২০২০ শেষে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি ৪২ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া কি শক্তিশালী অর্থনীতির চিত্র, নাকি বিনিয়োগ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির স্থবিরতা, আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক অর্থনীতিরই স্তবিরতা এই আলোচনা প্রাসঙ্গিক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রিজার্ভের বিকল্প ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, রিজার্ভের ডলার থেকে ঋণ নেয়ার সম্ভব্যতা যাচাই করতে বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থায়নে রিজার্ভ থেকে সরাসরি ঋণদানে মত নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ‘সরকারি খাতের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরাসরি অর্থায়ন করতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রচলিত পদ্ধতিতে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয়া হয়, সরাসরি কোনো প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে কঠিন কিছু শর্ত সাপেক্ষে বৈদেশিক মুদ্রা ধার দিয়ে, বিক্রি করে বা আমানত রেখে উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা করতে পারে।

এক্ষেত্রে প্রকল্পটি সরকারি খাতের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হতে হবে, এর বিপরীতে সরকারের গ্যারান্টি থাকতে হবে। প্রকল্পকে অবশ্যই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে হবে, তা না হলে অর্থায়ন পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবে না।

প্রকল্পের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ব্যাপারে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করতে হবে। সম্ভাব্য কোনো বিপর্যয়ের কারণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাধাগ্রস্ত হবে কিনা তাও দেখতে হবে।’ (যুগান্তর ১/১১/২০২০)।

বৈদেশিক রিজার্ভ কখনই অলস নয়।

বড় রিজার্ভের বিপরীতে অর্থ প্রত্যাবাসন সহজ হয় বলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার এবং দেশের ঋণমান (ক্রেডিট রেটিং) নির্ধারণে রিজার্ভের গুরুত্ব অপরিসীম। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে জোগান হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার যৌক্তিক পর্যায়ে ধরে রাখতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রায় তারল্য বাড়ানো হয়, ফলে বিনিময় হার দীর্ঘদিন ধরেই স্থিতিশীল।

সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসলে অলস পড়ে থাকে না, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহের ইকোসিস্টেমকে সচল রাখে। তাই রিজার্ভের অর্থের নীতিবিরুদ্ধ বিকল্প ব্যবহারের সুযোগও নেই।

তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত কাম্য নয়

সরকার চাইলে খুব দরকারি কর্মসংস্থান বান্ধব খাতে মুলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে উৎসাহ দিতে পারে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানোর খাতে যেখানে বহু লোকের কর্ম হবে, দেশে ও দেশের বাইরে করোনাকালে নতুন যেসব পণ্যবাজার গড়ে উঠেছে, সেখানে।

এতে পুরানো খাতে বিরক্ত হওয়া শিল্পউদ্যোক্তারা নতুন খাতে বিনিয়োগ করবে, অর্থনীতির সরবারহ সংকট উত্তরণ হবে। কর্মসংস্থান হয়ে ডিমান্ড সাইড অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে।

পাশাপাশি যেহেতু করোনাকালীন একটা অনিশ্চয়তা এবং বৈশ্বিক সংকটে বিরাজমান, তাই কিছুটা বর্ধিত রিজার্ভ সম্ভাব্য যে কোন নতুন সংকট মোকাবেলাতেও কাজ দিবে। বৈদেশিক রিজার্ভের দুরদর্শী ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা দরকার।

পাশাপাশি বিদ্যমান স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা কাঠামোকে সম্মান করাও জরুরি, বৈশ্বিক বাস্তবতাও তাই বলে।”

ইতিহাস সাক্ষী দিবে, আমরা শুধু সমালোচনাই করিনি, বরং সৎ ও কার্যকর পরামর্শও দিয়েছিলাম।

আজকের সংকট আপনার উপর শতাভাগ আরোপিত নয়, বরং আপনারা নিজেই চলমান ডলার সংকটের একটা বড় অংশের নির্মাতা।

লেখক: প্রকৌশলী ফাইজ তাইয়েব আহমেদ