দেশের মধ্যে থেকে এবং দেশের বাইরে থেকে অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রির মান নিয়ে অনেকদিন থেকেই আলোচনা শুনি।

যুক্তরাজ্যে পিএইচডি করার সময়ে অনেকের সাথে আলাপ হতো, অনেক সভা সেমিনারে অংশ নিতাম। ঐসময় থেকে আজ অবধি আমার কাছে মনে হয়েছে,

‘The purpose of doctoral research is to train a student as an independent researcher by providing the necessary skills to excel in academia’.

দেশে ফেরত আসার পরে একজন বোর্ড মেম্বার হিসেবে কিছু ডক্টরাল কমিটিতে ছিলাম এবং এখনো আছি। প্রায় সময়ই দেখি বয়সের দিক থেকে আমি বোর্ডের কনিষ্ঠ সদস্য। তথাপি যৌক্তিক বিষয়ে আমার মতামত প্রদান করতে কখনোই সংকোচ বোধ করি না।

সর্বোচ্চ এই ডিগ্রির বিষয়ে কারণে-অকারণে অনেকের সাথেই আলাপ হয়। সব সময়ই লক্ষ্য করেছি আমাদের দেশের বেশিরভাগ অধ্যাপক/গবেষক ভালো মানের পিএইচডি বুঝাতে ডিগ্রি প্রার্থী কতগুলো গবেষণা প্রবন্ধ জার্নালে প্রকাশ করেছেন এটাই বিবেচনায় রাখেন ।

ভালো জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও এই সংখ্যা দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রির মান বিবেচনা করা বিষয়ে আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করি।

আমি বিদেশ শব্দটি ব্যবহার করবো না, বরং বলবো পৃথিবীব্যাপি খুব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি চলাকালীন সময়ে একজন ছাত্রকে গবেষণা করানোর পাশাপাশি নানাবিধ বিষয়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ এই বছরে আমেরিকার খুব ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমাদের এক ছাত্রের কথা বলবো। করোনার জন্য এখনো আমেরিকা যেতে পারে নাই বিধায় সে অনলাইনে কোর্স করছে। প্রথম সেমিস্টারে দুটো কোর্স করার পাশাপাশি তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনজন অধ্যাপকের গবেষণা বিষয়ে ইন্টার্ভিউ নেয়ার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।

এই ইন্টার্ভিউ নিতে গিয়ে সে অধ্যাপকবৃন্দের কাছ থেকে যা শিখতে পেরেছে, যে আত্মবিশ্বাস পেয়েছে তা এককথায় বিস্ময়কর। আসছে সেমিস্টারে সে নিয়মিত কোর্সের পাশাপাশি,

‘Writing and Oral Communications skills for PhD students‘ শিরোনামের একটি কোর্স করবে।

আমি যখন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ‘র ছাত্র ছিলাম, তখন আমাদের বিভাগ থেকে ‘চ্যানেল ফোর’-এর একজন একট্রেস কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন কীভাবে প্রেজেনটেশন দেয়ার সময় মঞ্চে দাঁড়াতে হয়, আই কন্টাক্ট করতে হয়।

গবেষণা পোষ্টার কীভাবে প্রস্তত করতে হয় এটা নিয়ে আমরা সবাই কম পক্ষে দুইটা ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের গ্রুপে কয়েকজন পোষ্টডক ছিল, গ্রুপ মিটিং এ আমরা অনেক কিছু তাঁদের কাছ থেকে শিখতে পারতাম।

প্রায় প্রতি এক/দুই সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে কোন না কোন ভালো গবেষক গ্রুপে আসতেন, তারা তাঁদের গবেষণা উপস্থাপন করতেন, আমরা সবাই নোট নিতাম। আমরা যারা এক্সপেরিমেন্টাল গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলাম, তারা যন্ত্র ব্যবহারের জন্য সবসময় বিশেষ প্রশিক্ষণ পেতাম। কীভাবে গবেষণা ফান্ডের জন্য আবেদন করতে হয়, কীভাবে একটা ভালো প্রপোজাল লিখতে দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন অবস্থায় এটা আমাদের শেখানো হয়েছিল।

তৃতীয় বর্ষের শুরুতে একটি গবেষণা প্রবন্ধের ড্রাফ্‌ট লিখলাম, অন্তত ২০/২৫ বার আমার সুপারভাইজার এই ড্রাফ্‌ট কারেকশন করেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন, আমি চাইলে এটা একদিনে শেষ করে সাবমিট করতে পারি, তাতে তোমার শেখা হতো না, শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এসেছিলো। এর পরে গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে আমাকে আর তেমন বেগ পেতে হয়নি।

আফসোস, তাঁরাও সুপারভাইজার আর আমরাও সুপারভাইজার, আমাদের অনেক সুপারভাইজার ছাত্রের থিসিসটিও পড়ে দেখেন না।

আমার প্রজেক্টের একটি কাজের জন্য আমাকে জার্মানির ড্রেসডেনে পাঠানো হয়েছিল। আমাদের গ্রুপে যথেষ্ট যন্ত্রপাতি, এক্সপার্ট গবেষক থাকা সত্ত্বেও আমি তিনবার ড্রেসডেনে গিয়েছিলাম। আমার সুপারভাইজারের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, অন্য গবেষকদের সাথে কীভাবে কোলাবরেশন গড়ে তুলতে হয় আমি যেন তা শিখতে পারি।

বাংলাদেশে আমাদের বিভাগগুলোতে যন্ত্রপাতি তেমন নেই এটি যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি সত্যি যে একই যন্ত্র রয়েছে একাধিক সংখ্যক । একজন শিক্ষকের কাছে যে যন্ত্র রয়েছে অন্য শিক্ষক বা অন্য শিক্ষকের ছাত্ররা তা ব্যবহারের সুযোগ পান না,বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যেই কোন ধরনের কোলাবরেশন গড়ে উঠে না।

ছাত্ররা কোলাবরেটিভ রিসার্চ শিখবে কোথা থেকে !! তিন বছর নয় মাস গ্লাসগো তে যখন ছিলাম তখন প্রতিদিন নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। বিশেষ করে থিসিস লেখার সময় নাকের পানি চোখের পানি সব এক হয়ে গিয়েছিলো, কীভাবে একটি থিসিস অরগেনাইজ করতে হয় তা পদে পদে শিখেছিলাম।

বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দিক থেকে শেখার যে সুযোগ ছাত্ররা পায়, তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আর এসব কারণেই বিদেশের ঐ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রির মান উন্নত হয়।

কয়েকটি ডক্টরাল কমিটির সদস্য হিসেবে আমাদের ছাত্রদের পিএইচডি থিসিস মূল্যায়নের সুযোগ পাচ্ছি। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, পিএইচডি ডিগ্রির যে উদ্দেশ্য আমরা এখনো তার ধারে কাছে পৌছাতে পারিনি। একটি বোর্ডে ছাত্র দেখাল সে দশটি গবেষণা প্রবন্ধ জার্নালে প্রকাশ করেছে, কেউ কেউ এটাকে যুগান্তকারী থিসিস হিসেবে আখ্যা দিলেন।

আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, তার প্রকাশিত প্রবন্ধের অন্তত তিনটি সারবত্তাহীন প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত। কেউ বলতে পারেন, বাকি সাতটা তো মোটাদাগে ভালো জার্নালে প্রকাশিত। প্রশ্নটি ঐখানে না, একজন ছাত্র পিএইচডি ডিগ্রি পেয়ে যাচ্ছে অথচ তাকে আমরা শেখাতে পারিনি যে, ওইসব জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা অপরাধ।

আমরা তার রুচিবোধে পরিবর্তন আনতে পারিনি, গবেষণায় নৈতিকতার গুরুত্ব আমরা তাকে বুঝাতে পারিনি, এখানেই আমাদের ব্যর্থতা, এখানেই মানের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আমরা বলি খুব অল্প হলেও আমাদের দেশ থেকে ভালো মানের কিছু পিএইচডি ডিগ্রি অর্জিত হয়েছে। ব্যাপারটি আসলে এমন নয়।

একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম, আমরা বড়জোর বলতে পারি এই অল্প কিছু ছাত্র খুব মেধাবী, যথেষ্ট শ্রম দিয়ে তারা দেশে থেকে গবেষণা করে ভালো ফলাফল পেয়েছে। এস এন বোস পিএইচডি করেননি, কিন্তু যুগান্তকারী গবেষণা করেছেন। পৃথিবীতে যখন পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হতো না তখনও শত শত ভালো গবেষক ছিলেন।

আমাদের ব্যতিক্রমী এই ছাত্ররাও হয়তো এরকম ভালো গবেষক, ভাগ্যক্রমে হয়তো তারা ভালো তত্ত্বাবধায়কও পেয়ে গিয়েছিলেন। ভালো মানের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে ঐ ছাত্ররা গবেষণায় তাঁদের মেধার প্রমাণ দিয়েছেন। বিদেশের শত শত ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক হাজার পোষ্টডক পজিশন রয়েছে।

আমাদের ব্যতিক্রমি ঐ দুই চারজন ছাত্র বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্টডক পজিশন পেতেই পারে। এই পরিসংখ্যান থেকে এটি কখনোই বলা যাবে না যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আমরা ভালো মানের পিএইচডি দিতে পারি !!

আসলে মান সম্মত পিএইচডি’ র কোন দেশ-বিদেশ নেই, যেখান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা হচ্ছে/প্রদান করা হচ্ছে ঐখানের গবেষণা সংস্কৃতি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

একটি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মান সম্মত পিএইচডি প্রদান করে না, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সেটা করে। আমরা একটি অনুন্নত গবেষণা সংস্কৃতির দেশে বসবাস করছি।

শুনতে খারাপ লাগলেও যা সত্য তা হল, ভালো মানের পিএইচডি প্রদানের মতো গবেষণা সংস্কৃতি এখানে সুদূর পরাহত, ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা এবং পরিবেশ আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো গড়ে উঠেনি। তাই এইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসম্মত পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অবকাশ নেই।

এখানে ছাত্রদের কোন দোষ নেই, ছাত্রদের মেধা নিয়েও কোন প্রশ্ন নেই, এই ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের।

ভালো মানের পিএইচডি প্রদান করতে হলে আমাদের অনেক কিছুতেই যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে হবে, এই অনেক কিছু কি সেটা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখার প্রয়োজন হবে।

একই সাথে আমাদের সুপারভাইজারদের অন্তর থেকে বুঝতে হবে পিএইচডি ডিগ্রি করানোর উদ্দেশ্য কি, এর পেছনের দর্শন কি, কি কি গুণ অর্জন করতে পারলে একজন ছাত্র সর্বোচ্চ এই ডিগ্রি পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

এখানে সত্যিকারের মানসম্মত পিএইচডি ডিগ্রির কথা বলছি, জালিয়াতি, খয়রাতি, বিনিময়ি ডিগ্রিসমূহ এই আলোচনার আওতামুক্ত।

– মোহাম্মদ বাসিত
শিক্ষক
বুয়েট