২০০২ সালে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিংগাপুরে (NUS) PhD করার সুযোগ আসে। ল্যাবে তেমন কাজ করার অভিজ্ঞতা ছাড়াই নতুন ল্যাবে জয়েন করি। সেখানে আমি প্রথম বাংলাদেশী।
সুপারভাইজর ছিলেন তাইওয়ানিজ চায়নিজ। কাজ শুরু করার কয়েকদিন পর উনার রুমে ডাকলেন, বললেন- হোসেন, দরজা বন্ধ করো।
ভয়ে পেয়ে গেলাম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যদি নিজেকে প্রমান না করতে পারি তবে তিনি আমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবেন।
আমি তা শুনে রীতিমত বিস্মিত। আমি মাত্র এসেছি, খাপ খাওয়াতে কিছু সময় লাগবে- জবাবে বললাম।
এরপর থেকে প্রচন্ড ভয় কাজ করতে থাকল। সকাল সকাল ল্যাবে এসে রাত ১০টায় বাসা ফিরতাম।
সন্ধ্যার পর লাইব্রেরী গিয়ে রিসার্চ বুঝার চেষ্টা করতাম। যে বিষয়ে কাজ করতে বলা হলো সেই টার্ম (Microarray) সিংগাপুরে গিয়ে প্রথম শুনলাম! ল্যাবের প্রায় সবাই চায়নিজ।
এরা কিছু করতে চাইত না। তাই অন্যরা যখন কিছু করে তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। ল্যাবের কোন মেশিন বিকট আওয়াজ করলে তখন জোরে বলে উঠত -হোসেইন, অর্থাৎ এটি আমি করেছি!
প্রতিবাদে কিছু বলতে গিয়েও চুপ থেকে ধৈর্য ধরতাম। অন্যরাও আমার সম্পর্কে সুপারভাইজরের কাছে মিথ্যা নালিশ করত যা পরে ওরাই আমাকে বলত আর হাসত!
সুপারভাইজর প্রায় ২ সপ্তাহ পর পর রুদ্ধদ্বার মিটিং করে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখাতেন।
প্রায় ৩ মাস পর একটি ঘটনা ঘটল। একটি এক্সপেরিমেন্ট ল্যাবের কেউ পারছিল না। সেটি ছাড়া কোন পেপার পাবলিশ করা যাবে না। অর্থাৎ প্রজেক্ট ফেইল করবে।
সেটি সমাধান করতে ব্রিটিশ একজন রিসার্চারের সাথে (তিনি সিংগাপুরে কাজ করতেন mircroarray) মিটিং ঠিক করেন । সুপারভাইজর মিটিং যাওয়ার সময় বললাম আমি কি যেতে পারি? আমি সংগী হলাম।
মিটিং এ অনেক জ্ঞানগর্ব আলোচনা হলো। ফেরার আগ মুহুর্তে এক্সপেরিমেন্টটি কেন কাজ করছে না সেসম্পর্কে আমার একটি ফিডব্যাক আছে বলে অনুমতি চাইলাম।
বিষয়টিকে বাস ভর্তি যাত্রীর উদাহরন টেনে বললাম- আমার মনে এখানে সমস্যা। RT-PCR করতে বেশী RNA নিতে হবে। আসার পর পথে সুপারভাইজর রাগ না করে বললেন-তুমি ট্রাই করতে পারো।
ল্যাবে প্রজেক্টির যে দায়িত্বে ছিল (NUS graduate, Malay Muslim girl) সে আমার পরামর্শ মত ট্রাই করল। কিন্তু সফল হলো না।
এরপর সুপারভাইজর বললেন- এবার তুমি চেষ্টা করো। প্রথম প্রচেষ্টাই সফল! সেই মেয়েটি রেগে আমার শত্রু হয়ে গেল।
নির্ধারিত প্রটোকল না মেনে নিজের মত করলাম যদিও প্রটোকলে বলা আছে বেশী RNA নিলে রিয়াকশন কাজ করবে না। আমার গাটস ফিলিংস ছিল যে সেটি কাজ করবে।
এরপর পেপার জমা দেয়া হলো। কিন্তু আমাকে অথার করা হলো না যদিও সেটি ছিল ক্রিটিক্যাল এক্সপেরিমেন্টটি সেই প্রজেক্টের জন্য (identifying latency-related genes from virus, See link this publication). রিভিউয়ার বললেন এই এক্সপেরিমেন্ট আবার করতে হবে। এবারও সেই মালে মেয়েটি পারল না।
অবশেষে আমার ডাক পড়ল এবং সেটি পাবলিশ হলো যেখানে আমি থার্ড অথার হলাম। এটি মাত্র প্রথম ৩-৪ মাসের ঘটনা।
মজার ব্যাপার হলো সেই মালে মেয়েটি আমার প্রচন্ড ধৈর্য দেখে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল! তোমার মত ধৈর্যওয়ালা হাজবেন্ড পাওয়া মুস্কিল!
ভাবলাম, আমি হয়ত এবার নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছি। ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম কিছুদিন। এরপর আবার রুদ্ধদ্বার বৈঠিক এবং রীতিমত আবার থ্রেট।
তখন নিয়মিত সিটামল ট্যাবলেট সাথে রাখতাম কেননা প্রায়ই জ্বর জ্বর লাগত। যদি দেশে ফিরে যেতে হয় তবে কিভাবে মুখ দেখাবো। এভাবে প্রায় আরো দুবছর কাটল।
আরো একটি পাবলিকেশন হলো ফার্স্ট অথার হিসেবে Virology জার্নালে। প্রতিষ্ঠানে ইয়ারলি প্রেজেন্ট দিলাম (সব পিএইচডি স্টুডেন্টকে দিতে হয় যেখানে প্রতিষ্ঠানের সবাই উপস্থিত থাকে)। প্রজেন্টেশনের পর সবাই প্রশংসা করল।
আমি বরাবর সায়েন্টিফিক প্রেজেন্টেশনে ভাল করি; মানে সহজ করে বুঝাতে পারি। এরপর থেকে বাংলাদেশী প্রথম পিএইচডি স্টুডেন্ট হিসেবে চেনা শুরু করল।
জুনিয়র রিসার্চ ফেলো (এটা স্পেশাল স্কলারশিপ যা জব হিসেবে কাউন্ট করা হয় যার কাজ হচ্ছে পিএইচডি করা) হিসেবে আমরা ইয়ারলি বোনাস পেতাম। পে-স্লিপ দেখে অবাক।
আমার বোনাস অর্ধেক। সবাই ফুল এমাউন্ট পেয়েছে। এইচআর ম্যানেজার এর সাথে দেখা করে জানতে চাইলাম তারা কোন ভুল করেছে কিনা। তোমার সুপারভাইজর তোমাকে কম দিতে বিশেষভাবে সুপারিশ করেছে।
তিনি জানতে চাইলেন কি হয়েছে, তাকে ফিডব্যাক দিতে। আপনি তো আর আমার সুপারভাইজর নন, তাই আপনাকে বলে কিছু হবে না- বলে চলে আসলাম।
সিদ্ধান্ত নিলাম পিএইচডি-ই আর করব না।
পিএইচডি একাডেমিক কাউন্সিলের প্রধানের সাথে দেখা করে বিষয়টি বললাম এবং পিএইচডি না করার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম।
তিনি শুনে রীতিমত বিস্মিত। সরোয়ার, তোমার পিএইচডি প্রায় শেষের দিকে কেননা রিকুইয়ারমেন্ট ইতিমধ্যে পূরণ করে ফেলেছো।
তিনি জানালেন- পারফরমেন্সের ভিত্তিতে সেই প্রতিষ্ঠানে ৪০ পিএইচডি স্টুডেন্টদের মধ্যে আমার অবস্থানA ক্যাটাগরির মধ্যে আছে।
একাডেমিক কমিটি গোপনে গ্রাডিং করতেন। এটা কনফিডেন্সিয়াল তথ্য কিন্তু তোমাকে জানালাম। আর মাত্র এক বছর বাকী। ভাল করে চিন্তা কর। আমি বললাম পিইচডি আমার দরকার নেই। মনে অশান্তি থাকলে এই পিএইচডি দিয়ে কি হবে।
পিএইচডি’র চেয়ে জীবন বড়। বেঁচে থাকলে আবার ট্রাই করব। আমেরিকায় এপ্লাই করলে তুমি আমাকে রিকমেন্ডেশন লেটার দিও বলে চলে আসলাম। পরে তিনি পরামর্শ দিলেন প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরের সাথে দেখা করতে।
আমার ইস্যুটি প্রাতিষ্ঠিক রূপ নিল। ডিরেক্টরের সাথে দেখা করে বললাম- আপনি প্রতিষ্ঠানে প্রধান হিসেবে আমার বিষয়টি না দেখে আমার মত স্টুডেন্ট এর কি অবস্থা হতে সেভাবে নিতে বললাম।
তোমাদের অনেক ক্ষমতা, আমি অত্যন্ত দুর্বল। আসার সময় বলে আসলাম যদি কোন মিটিং হয় তবে যেন আমাকে না ডাকা হয়।
সেই সময় বিখ্যাত King’s College এর একজন নামকরা প্রফেসর প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হিসেবে জয়েন করেন। একাডেমিক মিটিং-এ আমার বিষয়টি আলোচনা হয়।
আমার সুপারভাইজরকে ডেকে একাডেমিক কমিটি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন- Sorowar, wants to change the lab. Do you agree? তারা সুপারভাইজরের কোন কথাই শুনেননি।
আমার সুপারভাইজর ছিলেন প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে সিনিয়র প্রফেসর। সুপারভাইজর অফিসে ফিরে মনমরা হয়ে ডাকলেন- এ কি করলে তুমি! আমি তো তোমার প্রডাক্টিভিটি বাড়াতে চাপে রাখতাম।
তুমি তো ভাল কাজ করো, তোমার অনেক আইডিয়া (ল্যাব মিটিং-এ আমাকে আইডিয়াম্যান হোসেন বলা হতো)।
আমার ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানে রীতিমত তোলপাড় হলো।
প্রতিষ্ঠানের পিএইচডি স্টুডেন্টদের জন্য নীতিমালা তৈরি করা হয় যাতে সুপারভাইজররা অমানবিক না হতে পারেন এজন্য মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা হয়।
আমার আগে এধরনের ঘটনা আরো হয়েছে কিন্তু কেউ ইস্যুটি টপ ম্যানেজমেন্টের কাছে কেউ তুলেনি এবং চুপ করে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছে।
একজন তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে ৪ মাস হাসপাতালে ছিল। পায়ের তলায় মাটি নেই জেনেও পার্সোনালি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ডিরেক্টরের কাছে এই বিষয়টি জানিয়েছিলাম।
এসব বিষয়ে কেনজানি আমার ভয় কাজ করে না।
একাডেমিক কমিটি থেকে বলা হয় তুমি স্বাধীন। ইচ্ছা করলে যে কোন ল্যাবে জয়েন করতে পারো।
এই পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে একজন হাংগেরিয়ান সায়েন্টিস্ট আমাকে সাপোর্ট দেন যিনি একাডেমিক কমিটির সদস্য ছিলেন।
Dr. Lazlo Orban আমাকে বললেন, সরোয়ার, তুমি চাইলে প্রফেসর উইলিয়াম চিয়া (ডিরেক্টর, যার ল্যাব থেকে ন্যাচার, cell- এ পাবলিকেশন করা ডালভাতের মত ব্যাপার)।
জবাবে বললাম- আমি তোমার ল্যাবেই পিএইচডি করতে চাই। উনি বললেন- আমি তেমন আহমরি কাজ করি না। মি মানসিক শান্তি নিয়ে পিএইচডি করতে চাই।
বুদ্ধি থাকলে আর আল্লাহ চাইলে আমি এখানেও কিছু করতে পারব। নতুন সুপারভাইজর প্রথমদিন বললেন- তোমার হাতে ৪ বছর। নিজের ইচ্ছেমত প্রজেক্ট ডিজাইন করো। আমি কখনোই বাধা দিবো না। এটা তোমার ব্যাপার।
প্রজেক্ট ডিজাইন করার সময় সাহায্য চাইলে তিনি বলতেন- তোমাকেই বের করতে হবে। অবশেষে ২০০৯ সালে ডেভোলোমেন্টাল বায়োলজিতে পিএইচডি থিসিস জমা দিলাম।
সেই ল্যাবের দুটি প্রধান পাবলিকেশন হওয়া মেন্ডামেন্টাল কাজ আমার দ্বারা শুরু হয়েছিল। পরে অন্যান্য পোষ্টডক কমপ্লিট করার পর Stem Cell Report and Cell Report এ পাবলিকেশ হয়।
সুপারভাইজরের শুধুমাত্র মানবিকতার জন্য আমার পিএইচডি’র ৩ বছর অপচয় হয়েছে। এজন্য আমার পিএইচডি শেষ করতে ৮+ বছর লেগেছে।
তাই আমার কাছে সুপারভাইজরের মানবিকতা তথা হিউম্যান কোয়ালিটি মুখ্য বিষয়। মানসিক অশান্তি নিয়ে বড় কিছু করেও তৃপ্তি নেই।
পিএইচডি সময়টি অনেক কঠিন, সাধারনত অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়। সুপারভাইজর অমানবিক আচরণ করলে তা প্রতিষ্ঠানিকভাবে জানানো উচিত বলে মনে করি।
সমস্যা হচ্ছে-বেশির ভাগ স্টুডেন্ট ভয় পায়। একাডেমিক লাইফে পিএইচডি সময়কার ক্ষতের কারনে আমার সাথে ছাড়া কাজ করেন তাদেরকে কড়া ফিডব্যাক বা বাজে ব্যবহার জানা মতে করিনি।
এজন্য স্টুডেন্টরা- কলোবোরেটররাও একদম পেয়ে বসে! সব বোঝা আমার উপর চাপাতে চেষ্টা করে!
পিএইচডি’র সেই কঠিন সময়ের স্মৃতিগুলো বর্তমান সময়ের বাধা অতিক্রম করতে মানসিক শক্তি জোগায়। জীবনের সবরকমের অভিজ্ঞতাই মূল্যবান।
লেখকঃ মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন
মাইক্রোবায়োলজিস্ট
সহযোগী অধ্যাপক
ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভারসিটি
সংযুক্তিঃ এই পেপার নিয়ে যত কাহিনী
রিসার্চ নিয়ে জানতে যোগ দিন আমাদের রিসার্চ কমিউনিটি গ্রুপে