জীবনে শুরুটা সাদামাটা হলেও স্বপ্নের তাড়না আর চেষ্টার প্রেষণা মানুষকে নিয়ে যেতে পারে এক অনন্য উচ্চতায়৷ আজকের গল্পটাও ঠিক তেমনই একজনকে নিয়েই যার ছোট ছোট স্বপ্নের বুনিয়াদ তাকে আই আই টির ছোট্ট লাল ভবন থেকে নিয়ে গেছে বিশ্বের অন্যতম টেক জায়ান্ট অ্যামাজনের স্বপ্নের দুয়ারে। তাই আর দেরি না করে চলুন ভাইয়ের কাছে শুনে আসা যাক তার অ্যামাজন যাত্রার গল্প-

” ছোটকাল থেকেই কম্পিউটার নিয়ে বেশ কৌতুহলী ছিলাম। তাই কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ার এক সুপ্ত বাসনা তখন থেকেই লালন করতাম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমার চয়েজ লিস্টের প্রথমে আমি বুয়েটকেই স্থান দিয়েছিলাম। কিন্তু সব ইচ্ছাই যে পূরণ হতে হবে এমন তো কথা নেই। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানে A+ না পাওয়ার দরুন বুয়েটের এডমিশন টেস্ট দেয়ার সু্যোগ হারালাম। কিন্তু তাই বলে হাল ছাড়িনি। কেননা তখনো আমার সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ অপেক্ষা করছিল।

ভর্তির পূর্বে বিভিন্ন সাব্জেক্ট নিয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে CSE ছাড়াও Institute of Information Technology (IIT) তে Software Engineering নামে নতুন একটি সাব্জেক্ট খোলা হয়েছে। যেহেতু নতুন একটি ডোমেইন তাই এর প্রতি এক অন্যরকম কৌতুহল কাজ করল।

এছাড়া এই সাব্জেক্ট সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পারলাম আই আই টি প্রথম ব্যাচ কতৃক পরিচালিত “আই আই টি ফোরাম” থেকে। উপরন্তু আই আই টির কারিকুলাম এবং ইন্টার্নশিপ অফার দেখে চয়েসলিস্টের টপে আই আই টিকেই রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আই আই টিতে আসার পর অনার্সের প্রথম দুই বছর প্রোগ্রামিং, আড্ডা, ফ্রেন্ডস, একাডেমিকস নিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্তেই কেটে যায়। আমার ফিউচার প্ল্যানিং এর মূল পর্বটা শুরুটা হয় ৩য় বর্ষ থেকে। তখন থেকেই ভাবতে লাগলাম ফিউচার প্রোগ্রেসের জন্য কোন দিকে আগানো যায়।

কেননা আই আই টিতে ফাইনাল ইয়ারে এসে হয়ত রিসার্চ না হয় প্রোজেক্ট বেসড কাজ করতে হয়। যেহেতু ২য় ও ৩য় বর্ষে অলরেডি প্রোজেক্ট বেসড কাজ করা হয়েছিল তাই ভাবলাম এবার নাহয় নতুন কিছুই করা যাক। উপরন্তু অনেককেই দেখছিলাম রিসার্চ ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছিল আর তাছাড়া আমার দেশে মাস্টার্স করারও কোন ইচ্ছা ছিল না। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে রিসার্চ করার অপশনটাই বেছে নিলাম।

এরপর আই আই টির গন্ডি পেরিয়ে জয়েন করলাম ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু একই সাথে চাকুরি এবং হায়ার স্টাডিস এর জন্য পড়াশোনা করাটা বেশ চ্যালঞ্জিং হয়ে দাড়াল। কিন্তু আমি থেমে যাইনি।

যেহেতু ৩য় বর্ষ থেকে আমি প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছিলাম তাই আমার জন্য জব করার সাথে সাথে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা খুব বেশি কঠিন হয়নি। তারই ফলশ্রুতিতে অবশেষে University of Alberta থেকে মাস্টার্স করার জন্য অফার লেটারটা পেয়ে যাই।

এরপর আমার মাস্টার্স শেষ করে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে সফটওয়্যার ডেভেলাপার হিসেবে জয়েন করি। এখানে আরেকটা বিষয় জেনে রাখা দরকার যে দেশের বাইরের কোন কোম্পানিতে জব করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সুযোগ পাওয়াটা তুলনামূলক কঠিন।

কেননা তাদের নিজেদের দেশের বাইরে থেকে কাউকে হায়ার করার অর্থই হল ঐ দেশের মেধাবীদের স্কিপ করে বাইরের দেশগুলো থেকে নিয়োগ দেয়া। তাই যারা মেধা, গুণে, মানে অন্যদের তুলনায় ব্যতিক্রম তারাই মূলত এই সুযোগটা লুফে নিতে পারে। এক্ষেত্রে কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং, অলিম্পিয়াড, হ্যাকাথনে যদি ভাল এচিভমেন্ট থাকে তাহলে তোমার জার্নিটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।

এক্ষেত্রে আরেকটা কথা না বললেই নয়। আমি যেসকল কোম্পানিগুলোতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি তার পিছনে লিংকডইনের অবদান অনস্বীকার্য।

লিংকডইন প্রোফাইল অনেকটা ডিজিটাল সিভি এর মতন কাজ করে যেখানে তুমি কোন টেকনোলজিতে ভাল এবং কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তার সম্যক বিবরণ থাকে। কোম্পানির রিক্রুটার যখন স্পেসিফিক কোন স্কিল লিংকড-ইন এ সার্চ করে তখন সহজেই তোমাকে তোমার স্কিল এর বেসিস এ তোমাকে খুজে নিতে পারে।

এমনকি আমার অ্যামাজন জার্নিটা শুরু হয় লিংকডইনে একজন রিক্রুটারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে। এরপর সেই রিক্রুটারের সাথে ফোনালাপে আমার স্কিল, কাজের ধরণ ইত্যাদি বিষয়ে কথোপকথন হয়।

এরপর যখন আমি ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য মনস্থির করি তখন অ্যামাজন থেকেই আমাকে কল করা হয়। অ্যামাজনের রিক্রুটিং প্রসেসটা মূলত ৩টি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে অনলাইন এসেসমেন্টের মাধ্যমে যাচাই করা হয় যে তোমার কোডিং দক্ষতা এবং ওয়ার্কিং স্টাইল কেমন, অ্যামাজনের ওয়ার্ক ইনভায়রনমেন্টের বা কালচারের জন্য তুমি যথোপযুক্ত কিনা ইত্যাদি।

যদি এই ধাপের ফলাফল সন্তোষজনক হয় তাহলে দ্বিতীয় ধাপ বা ফোন ইন্টারভিউ স্কিপ করে সরাসরি তৃতীয় ধাপে নিয়ে যাওয়া হয় যেটা কিনা একটা অনসাইট ইন্টারভিউ প্রসেস। অন্যথায় সবাইকে দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করেই তৃতীয় ধাপে অংশ নিতে হয়।

ফাইনাল স্টেপ তথা অনসাইট ইন্টারভিউ মূলত ৪/৫ টি সেগমেন্ট এ ভাগ করা থাকে যার প্রতিটির সময়সীমা হয় ১ ঘন্টা করে। এই সকল সেগমেন্টে কোডিং, সিস্টেম ডিজাইন, লো লেভেল ডিজাইন, ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম ইত্যাদি বিষয়ের উপর দক্ষতা যাচাই করা হয়।

আর প্রত্যেক সেগমেন্টের শুরুতেই থাকে বিহেভিওরাল ইন্টারভিউ, যার মাধ্যমে তুমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অ্যামাজনে সফল হবে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করা হয়।

এই সকল ধাপ যদি সফলতার সাথে অতিক্রম করতে পার তাহলে অ্যামাজনে তোমাকে স্বাগতম।

টেক জায়ান্টে জয়েন করার স্বপ্ন কেই না দেখে! যদি তুমিও এমন স্বপ্নবাজ হও তবে তোমার দায়িত্ব হবে ভার্সিটির শুরু থেকেই তোমার সেই স্বপ্নকে একটু একটু করে যত্ন করে বড় করে তোলা। এক্ষেত্রে প্রথমেই তোমাকে একাডেমিকস এর প্রতি সর্বোচ্চ গুরত্বারোপ করতে হবে৷

কেননা আন্ডারগ্র‍্যাডে পড়াশোনা করার যে সময় পাওয়া যায় তা আর কখনো তুমি ফিরে পাবে না। এক্ষেত্রে শুধু কোর্স টিচারের উপর নির্ভর না করে তোমার উচিত নিজ দায়িত্বে কোর্সগুলো ভালোভাবে কমপ্লিট করা।

এছাড়া একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য সহশিক্ষা বিষয়ক কাজ যেমন কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং, হ্যাকাথন, সফটওয়্যার শো-কেসিং কম্পিটিশন, বিভিন্ন টেক ব্লগিং ইত্যাদির সাথে লেগে থাকা উচিত।

এতে নিজের স্টাডি এরিয়া ছাড়াও তোমার পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট বের করতে পারবে। শুধু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে নিজের ভাল লাগার বিষয়টি খুজে পাওয়া কঠিন।

সুতরাং তুমিও যদি তোমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ন করতে চাও তাহলে উদ্যমী এবং ত্যাগী। সময় অপচয় না করে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তোমাকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এবং মনে রাখতে হবে কখনো হাল ছাড়া যাবে না।

যত বাধাই আসুক না কেন যদি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে টিকে থাকতে পার, তবে বিজয়ের মুকুট হবে শুধুই তোমার।”

Rashed Rubby Riyad
BSSE 4th Batch, IIT DU
Software Development Engineer, Amazon