কামরুল হাসান মামুনঃ

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানে কি?

অন্যসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য হলো এখানকার শিক্ষকরা দুটো চাকুরী করে

১। শ্রেণীকক্ষে পড়ানো এবং ২। গবেষণা।

কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষে পড়ানো ছাড়াও ছাত্রদের গবেষণা করানো এবং শেখানোও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।

যদিও শিক্ষকতা বললে আমাদের মানসপটে শ্রেণীকক্ষে পড়ানো ভেসে উঠে তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হলো গবেষণা।

সকলেরই স্কুল সার্টিফিকেট, কলেজ সার্টিফিকেট, অনার্স-মাস্টার্স সার্টিফিকেট এমন কি পিএইচডি এবং তার উপর পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতাও থাকতে পারে। তবে সব কিছুর উপরে গবেষণা, গবেষণার মান, সাইটেশনের সংখ্যা ইত্যাদি দেখা হয়।

এছাড়া যার সাথে পিএইচডি করেছে তার কাছ থেকে রেকমেন্ডেশনসহ আরো অন্তত দুইজন পিয়ারের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন চাওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই এইগুলোর কোনটিই দেখা হয় না। তাহলে রেঙ্কিং রেঙ্কিং করে চেঁচিয়ে লাভ আছে?

বিশেষ করে আমেরিকাতে ভালো গবেষণা থাকলেই কেবল চাকরি পার্মানেন্ট (অর্থাৎ tenured পজিশন) করা হয়। আবার পার্মানেন্ট হলেও তার পরবর্তী সময়গুলোতেও গবেষণা দেখা হয়।

কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় khassan@du.ac.bd

কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]

কারণ ভালো গবেষণা থাকলে ফান্ড আসবে, ফান্ড আসলে পিএইচডি ও পোস্ট-ডক আসবে। শিক্ষকদের গবেষণার জন্য র জন্য সময় সময় বের করার জন্য আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরো নানারকম শিক্ষকতার পজিশন বের করেছে।

যেমন adjunct প্রফেসর, গেস্ট প্রফেসর, পার্ট-টাইম শিক্ষক, টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ইত্যাদি। adjunct প্রফেসরদের অনেকেই শ্রেণীকক্ষে খুব ভালো শিক্ষক।

একই কথা খাটে গেস্ট এবং পার্ট-টাইম শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। এদের চাকুরী পার্মানেন্ট হয় না কেবল একটি কারণে।

সেটি হলো তাদের গবেষণা প্রোফাইল ভালো না। অবশ্য অনেকের পিএইচডি ও থাকে না অথবা থাকে না পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা।

adjunct প্রফেসর, গেস্ট প্রফেসর, পার্ট-টাইম শিক্ষক, টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ইত্যাদি পদে কেন নিয়োগ দেওয়া হয়। তার কারণ দুটি।

প্রথম হলো গবেষক শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকতার সময় ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজে সময় কমানো বা বাঁচানো যাতে তারা গবেষণায় বেশি মনোযোগী হতে পারেন।

কারন গবেষণা হলে পরেই ফান্ড আসবে, পিএইচডি ছাত্র আসবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি কেউ এইসব বুঝে?

আমাদের এখানে বরং ঘটে উল্টোটা। যে যত ভালো গবেষণা করবে তারে জাইত্তা ধইরা আরো বেশি কাজ করানো যাতে সে গবেষণা করার সুযোগ না পায়। এইখানে গবেষণা না করে রাজনীতি করলে অনেক ফায়দা।

টিভির টক্ শোতে ডাক পায়, বিশেষজ্ঞ হিসাবে নামডাক ছড়ায়, দ্রুত প্রমোশন হয়।

সাত কলেজের দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সঙ্গত কারণেই আমি এর বিরোধিতা করি এবং এখনো করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমনিতেই তার নিজের ভার বহন করতে পারছিলো না তার উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও কয়েকগুন ছাত্রের দায়িত্ব কাঁদে চাপিয়ে দিয়ে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট ক্ষতি করা হয়েছে।

আমার বিভাগের শিক্ষকদের দেখেছি ৭ কলেজের খাতা দেখা ও পরীক্ষা নেওয়া নিয়ে কি পরিমান ব্যস্ত থাকে। কোথায় শিক্ষকদের এইসব কাজ কমিয়ে বেশি করে গবেষণা করার চাপ দিবে না উল্টো আরো কাজ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গড়ে প্রায় প্রতিদিন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষককে কোন না কোন কাজে ৭ কলেজের দায়িত্বে সময় ব্যয় করতে হয় এবং এইগুলো করে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। ফলে অনেকের মন থাকে বিষিয়ে যা গবেষণার জন্য আরো ক্ষতিকর।

একবার আমাকে ৭ কলেজের পরীক্ষা কমিটির সভাপতি করা হয়। আমি গবেষণা ও এমএস ছাত্র সুপারভিশনের কারণ দেখিয়ে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলাম।

উন্নত দেশের প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হলে আমার গবেষণা দেখে স্বপ্রনোদিত হয়েই এইসব দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখতো।

কিন্তু অব্যাহতির আবেদন করলে তা গ্রহণ করা হয়নি! মানে বলতে চাইছে: তুমি গবেষণা মারাও? আমরা কি তেচপাতা ভাজি? এই হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে হলে অনতিবিলম্বে ৭ কলেজের বার্ডেন মুক্ত হওয়া উচিত। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ৭ কলেজের জন্য বরং একটি স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে।

এমনকি ৭ কলেজের প্রত্যেকটিকে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বা একেকটি কলেজকে নতুন সৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি ফ্যাকাল্টি বানানো যেতে পারে। শুনছি আজ নাকি ৭ কলেজের ছাত্ররা আন্দোলনে নামবে। তারা নাকি তাদের সার্টিফিকেটে “এফিলিয়েটেড” কথা বাদ দেওয়ার জানাবে।

এইটা কি কোন দাবি হতে পারে? এইটা করা মানে ভালো খারাপের দেওয়াল উঠিয়ে দেওয়া। সেটা কি বৃহত্তরের কল্যাণ হবে?

পরিশেষে বলব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো শিক্ষক মানে ভালো গবেষক কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষে পড়ানো ছাড়াও ছাত্রদের গবেষণা করানো একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।

বিশ্বে যেইসব উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় আছে তারা যেই পথে উন্নত হয়েছে আমরা সেই পথে হাটবো না বরং উল্টো পথে হাটবো তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কেন উন্নত হবে?

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়