ফাইনম্যান তখন মধ্য ত্রিশ। প্রিন্সটনে এক চায়ের আসরে মিসেস এইসেনহার্ট [ Mrs Eisenhart ] ফাইনম্যান কে উদ্দেশ্য করে এই কথা গুলি বলেছিলেন

Surely, are you joking, Mr Feynman !!!

আসলে ফাইনম্যান একইসঙ্গে ক্রিম এবং লেবুরস খেতে চাওয়ায় ( অনেকটা যেন রসগোল্লার সঙ্গে চানাচুর ! ) , তিনি বিস্মিত হয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন।

বিংশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ

রিচার্ড ফাইনম্যানকে বলা হয় বিংশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষা। এর কারণ শুধুমাত্র তার তীক্ষ্ণধী বিজ্ঞান প্রতিভা নয় , তার শিল্পীসত্তা , দার্শনিক সত্তা এবং গোড়ামি হীন মুক্ত চিন্তা ভাবনার জন্য।

একদিকে তিনি যেমন পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসে সমস্ত কঠিন বিষয়কে সুন্দর ভাষায় সহজ-সরল ভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন , তেমনিই bongo dram নিয়ে সুরের মূর্ছনা তৈরি করতে পারেন।

আবার সেই তিনিই চোখের নিমেষে দুরূহ কোডযুক্ত তালা (Lock) ভেঙে দিতে পারেন। এমনকি রোজার পেনরোজ , স্টিফেন হকিং এর মতো বিজ্ঞানীদেরও ফাইনম্যান এর সঙ্গে তর্কে নাস্তানাবুদ হতে হয়। আপন দক্ষতায় তিনি যুক্তিতে বাকিদের থেকে এগিয়ে যেতে পারেন।

সাধে কি আর পেনরোজ বলেন — ” He was so quick, he was usually about five steps ahead of me at any given point …The whole thing was mentally exhausting. I was completely drained at the end of the session.” এই কারণেই তিনি অনন্যসাধারণ। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে যার স্থান আলবার্ট আইনস্টাইনের পরেই।

১৯১৮ সালের আজকের দিনে ( ১১ ই মে ) , নিউইয়র্কের কুইনস শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ , আজকে তার জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে।

দূরদর্শী ফাইনম্যান

১৯৭৯ সালে আলটাডেনা অঞ্চলে দাবানলে বহু গাছ পুড়ে যায়। ফাইনম্যান বললেন, শীঘ্রই এই অঞ্চলে ভূমি-ধস ও বন্যা হবেই। একমাত্র তিনিই বন্যার ক্ষয়ক্ষতিজোনিত বীমা করিয়ে নেন। ১৯৭৯ সালের শীতকালে যে প্রবল বৃষ্টি হয় তাতে বৃক্ষহীন ওই অঞ্চলে প্রবল বন্যা হয়, ভূমি-ধ্বসও ঘটে। ফাইনম্যান এর ভবিষৎবাণী অদ্ভুতভাবে সত্যি হয়।

জাদুকর

ফাইনম্যান ছিলেন নানা গুণের অধিকারী। বিজ্ঞানের অবিস্কারগুলি বাদ দিলে অন্যান্য গুনগুলির মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিল বিজ্ঞানে তার অসাধারণ বাগ্মীতা। ফাইনম্যান কে বলা হয় পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ‘মহান ব্যাখ্যাকার’ [ Great Explainer ]। ছাত্ররা তার বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত।

তিনি বলতেন, ছাত্ররা ঠিকমত বুঝতে পারছেনা মানে হল , শিক্ষক নিজেই বিষয়টি বোঝেননি। কঠিন বিষয়কে কিভাবে ছাত্রদের সহজ করে বোধগম্য করে তোলা যায় , তা করে তুলতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ জাদুকর।

অসামান্য প্রতিভা , পদার্থবিজ্ঞানে অসাধারন পান্ডিত্য এবং সহজ করে বোঝানোর ক্ষমতা তাকে অসাধারণ শিক্ষক করে তুলেছিল।

চ্যালেঞ্জার বিস্ফোরণ

ফাইনম্যান এর প্রতিভা ও মেধার আরেকটা উদাহরণ পাওয়া যায় মার্কিন স্পেসশাটল ‘চ্যালেঞ্জার’ এর বিস্ফোরণ এর কারণ অনুসন্ধানের সময়।

১৯৮৬ সালের ২৮শে জানুয়ারি NASA-র মহাকাশযান ‘চ্যালেঞ্জার’ উৎক্ষেপণের মাত্র ৭৩ সেকেন্ড পরেই বিস্ফোরণ সহ ধ্বংস হয়ে যায়। মারা যান মহাকাশযানে থাকা পাঁচজন মহাকাশচারীর প্রত্যেকেই।

এই ঘটনা আমেরিকা তথা বিশ্বজুড়ে প্রবল আলোড়ন তৈরি করে। আসলে সমগ্র উৎক্ষেপণ লাইভ দেখানো হওয়ায় এই ঘটনার প্রভাব ছিল আরো বেশি।

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগণ স্বয়ং এই ভয়াবহ ঘটনার কারণ খুঁজে বের করার জন্য ‘রজার্স কমিশন’ গঠন করেন। কমিশনের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয় নীল আর্মস্ট্রং, রিচার্ড ফাইনম্যান সহ আরও বিশিষ্টজনকে।

এত গন্যমান্য, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ থাকা সত্ত্বেও একমাত্র ফাইনম্যান দুর্ঘটনার সঠিক কারণ অনুসন্ধান করতে পেরেছিলেন।

চিরসন্ধিৎসু ফাইনম্যান বুঝেছিলেন , চ্যালেঞ্জার বানানোর বরাত যারা নিয়েছিল , সেই কোম্পানির কাছ থেকে এর নির্মাণশৈলীর খামতির কথা কিছুতেই জানা যাবে না।

তিনি সরাসরি সেইসব কর্মীদের কাছে অনুসন্ধানের জন্য গেলেন যাঁদের হাত দিয়েই ওই মহাকাশযানটির অংশগুলি জোড়া লাগানো হয়েছিল। তিনি ধরতে পেরেছিলেন ‘solid rocket booster’ এর জোড়গুলি যে O-ring দিয়ে যুক্ত করা হয়, সেটিই 0℃ উষ্ণতায় তার স্থিতিস্থাপকতা ধর্ম বজায় রাখতে পারে না।

রজার্স কমিশনের তাবড় তাবড় সদস্যরা যখন প্রায় এই সিদ্ধান্তে আসছিলেন যে, দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়, তখন ফাইনম্যান সকলের সামনে বিখ্যাত C-clamp পরীক্ষা করে দেখালেন যে চলেঞ্জারের দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এটাই।

আবিষ্কার ও সম্মান

রিচার্ড ফাইনম্যানকে বলা হয় Quantum Electrodynamics – এর পথিকৃৎ। ডিরাক সমীকরণে ইলেকট্রনের spin নিয়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল ফাইনম্যান আপন প্রতিভাবলে অদ্ভুতভাবে সেই সমস্যার সমাধান করলেন।

যার ফলস্বরূপ ১৯৬৫ সালে জাপানের শিন-ইকিরও-তোমানাগা ( Shin-Ichiro-Tomonaga ) এবং আমেরিকার জুলিয়ান সেইমর সুইঙ্গার ( Julian Seymour Schwinger ) এর সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

এছাড়াও তার অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ফাইনম্যান নকশা’ বানানো, অতি শীতল তরল হিলিয়ামের Superfluidity -র কারণ নির্ণয় এবং weak interaction সংক্রান্ত।

বোঝাই যাচ্ছে , এই মানুষটিকে নিয়ে লিখতে বসলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাবে , তবু তার সামগ্রিক কর্মকান্ড, অসাধারণ প্রতিভার কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যাবে না। দিন থেকে রাত হবে , আবার রাত থেকে দিন …

কিন্তু মনে হবে তাকে জানার জন্য আরও সময় চাই। এমন ব্যক্তিত্ব আছেন বলেই পদার্থবিদ্যা তার নিজস্ব কৌলিন্য এ কুলীন, সমস্ত বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ ( king of science )।

১৯৮৭ সালে ফাইনম্যান এর তলপেটে cancer ধরা পড়ে। তার দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে যায়। প্রথমদিকে ডায়ালাইসিস করা হলেও, একটা সময় পর ফাইনম্যান নিজেই জানিয়ে দেন তিনি ডায়ালাইসিস করতে ইচ্ছুক নন।

অবশেষে ১৯৮৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ফাইনম্যান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মানুষ ফাইনম্যান আর জীবিত না থাকলেও ব্যক্তি ফাইনম্যান আজও অমর পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসে নতুন ভর্তি হওয়া ছেলেটার বিস্ময়কর অভিব্যক্তির মধ্যে … “এও কি সম্ভব !!!”

🖋চিন্ময় বিশ্বাস

আমাদের বিজ্ঞান গ্রুপে যোদ দিন