রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যাট নিয়ে কয়েকদিন আগে ফেইসবুকে একটি লেখা চোখে পড়ে।
ফসিল ফুয়েল প্ল্যান্টের বিদ্যুতের দামের সাথে তুলনা করে সেখানে দেখানো হয় রুপপুর নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট করার পেছনে চুরি ছাড়া যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
ওয়াইল বাংলাদেশের মতো দেশে প্রতিটি সরকারী প্রজেক্টে পুকুর চুরি হয়, তাই বলে বিদ্যুতের দাম হেড টু হেড তুলনা করে একটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের প্রয়োজনীয়তা বা যৌক্তিকতার পক্ষে-বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়া মিসলিডিং।
একটা কমার্শিয়াল স্কেল (১২০০ মেগাওয়াট এলেক্ট্রিক) নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যানানোর ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় আপফ্রন্ট কস্ট ও লং কন্সট্রাকশান পিরিয়ড, উইচ লিডস টু কস্ট ও স্কেজুল ওভাররান।
ফলশ্রুতিতে, একটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বানানোর খরচ অনেক, যা দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। দাঁতমুখ খিঁচে ৪-৫ বছর সময় ও ৫-৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে একটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানোর পর সেই খরচ উঠে আসতে লেগে যায় কয়েক যুগ।
এসব কারণে, সরকারী প্রকল্প না হলে, নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসানো অসম্ভব একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের আসল জাদু শুরু হয় প্ল্যান্ট বানানোর অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারার পর। সেটা করা গেলে একটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট একটা দেশকে ও কমিউনিটিকে কতোভাবে বেনেফিট করে সেটা কেবলমাত্র বিদ্যুতের দামের দিকে তাকিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
নিউক্লিয়ার পাওয়ার নিয়ে যখন কথা বলা হয়, লক্ষ্য করলে দেখবেন, কিছু টার্ম বহুল ব্যবহৃত হয়- এনার্জি সিকিউরিটি, এনার্জি রেজিলিয়েন্স, এনার্জি ইন্ডিপেন্ডেন্স, রিলায়েবল স্টেইবল পাওয়ার।
এই প্রত্যেকটি কথার ওজনদার ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে এনার্জি সিকিউরিটি হিউজ ডিল। এনার্জি ছাড়া আপনি একদিন, এক মূহুর্ত চলতে পারবেন না। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সাপ্লাই নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই।
এই নিশ্চয়তা দিতে পারে কেবল নিউক্লিয়ার পাওয়ার। বছর কয়েক আগে টেক্সাসে সাইক্লোন আঘাত হানলে কয়েকদিনের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এক মানবেতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন টেক্সানরা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের প্রয়োজনীয়তা খুব ভালোভাবে অনুভব করে।
বর্তমান সময়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর ৯৪% এর কাছাকাছি। সেখানে ন্যাচারাল গ্যাস প্ল্যান্ট ও কোল প্ল্যান্টের ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর ৫০% এর কাছাকাছি।
ক্যাপিসিটি ফ্যাক্টর হচ্ছে, একটা প্ল্যান্ট তার জীবদ্দশার কত সময় অপারেট করেছে (বনাম কতো সময় বন্ধ ছিল)।
নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের আরেকটা বড় সুবিধা হচ্ছে, এটা ইমিউজন টু প্রাইস ফ্ল্যাকচুয়েশান। পৃথিবীতে যেকোনো ধরণের অস্থিরতা দেখা দিলেই যেখানে জ্বালানির দাম আকাশে উঠে যায় ও সবকিছু বেশ আনসার্টেইন হয়ে পড়ে, সেখানে নিউক্লিয়ার জ্বালানি/ফুয়েলের দাম (১৫০০ ডলার/কেজির মতো) মোট খরচের খুবই সামান্য একটি অংশ।
অর্থাৎ, পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেলেও নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট “রেজিলিয়েন্ট” থাকে ও এখান থেকে স্টেইবল, রিলায়েবল এনার্জি সাপ্লাই পাওয়া গ্যারান্টিড। এমনকি কোভিডের মতো গ্লোবাল প্যান্ডেমিক বা যেকোনো মাত্রার গ্লোবাল ইকোনমিক কন্ডিশান, ইনফ্লেশানের প্রতিও নিউক্লিয়ার এনার্জি মার্কেট একি রেকম রেজিলিয়েন্ট।
বর্তমান বিশ্বে শক্তিশালী দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে সর্বইপ্রথম যেটা করা হবে, শত্রুপক্ষের এনার্জি গ্রিডে আক্রমণ চালানো হবে, ফিজিক্যাল অথবা সাইবার। এক্ষেত্রেও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যানট অতুলনীয় রেজিলিয়েন্স প্রদর্শন করবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কালে রাশার গ্যাস পাইপলাইনকে সাগরের নিচে আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছিলো, যা মানব ইতিহাসে সবচাইতে বড় গ্রিন হাউস গ্যাস এমিশানের ঘটনা। যেকোনো গ্যাস বা কোল প্ল্যান্ট মানেই কমোডিটি রিস্ক, সাপ্লাই রিস্ক, অনেক লম্বা পাইপিং ইনভলড, যা অতি অবশ্যই সিকিউরিটিকে কম্প্রোমাইজ করে। এসব ক্ষেত্রে নিউক্লিয়ার পাওয়ার এনার্জি সিকিউরিটি ও রেজিলিয়েন্স ও ইন্ডিপেন্ডেন্স নিশ্চিত করে।
নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের লাইফসাইকেলও একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। একবার একটা প্ল্যান্ট করা গেলে সেটি কমবেশি ৮০-১০০ বছর সার্ভিস দেবে, যা অন্য যেকোনো প্ল্যান্টের আয়ুষ্কালের কয়েকগুণ। এতে করে শুধু ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টরই বাড়ে না, আনুষাঙ্গিক খরচ, কনস্ট্রাকশান যজ্ঞ সব দিক থেকেই ফেভার হয়।
লাস্ট বা নট লিস্ট, ক্লিন এনার্জি। কোল প্ল্যান্ট বা ফসিল ফুয়েল প্ল্যান্টের দূষণের কারণে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায় ও নিশ্বাসজনিত রোগের কারণে কোটি কোটি মানুষ নানাবিধ অসুখে ভোগে ও হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। গ্রিনহাউজ এফেক্ট ও ক্লাইমেন্ট চেইঞ্জের কথা তো বাদই দিলাম।
এখানে যা বললাম তা নিউক্লিয়ার পাওয়ারের পক্ষে অ্যাক্টিভিজম বা অ্যাডভোকেসি করতে বলিনি। এই ব্যারাম নিউক্লিয়ার ফিল্ডের লোকেদের রয়েছে বাট নট মি। এখানে যা বলেছি তা হচ্ছে ফ্যাক্ট অব দ্যা ম্যাটার। এই সবকিছু কনসিডারেশানে নিলে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে পাওয়া রিটার্ন মাল্টিফ্যাসিটেড। সবচেয়ে বড় কথা, অনেক ক্ষেত্রে এর সাথে রাষ্ট্রের সিকিউরিটি জড়িত (ইউক্রেন যুদ্ধের কালে রাশা য়োরোপের বিদ্যুৎ/গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়ায় নতুন করে যোরোপে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসানোর আলোচনা শুরু হয়েছে দেখেছেন হয়তো)। এ সবকিছু কনসিডারেশানে না নিয়ে শুধুমাত্র হেড টু হেড এলেক্ট্রিসিটি প্রাইস তুলনা করে উপসংহার টানা বোকামি। শেখ হাসিনা এই সবকিছু বিবেচনা করে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র বসিয়েছেন, নাকি চোরগুলোকে চুরি করার রাস্তা করে দেয়ার জন্য রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র বসিয়েছেন, নাকি আব্বুর স্বপ্ন পূরণ করার জন্য (স্বাধীনতার পর এই উদ্যোগ নেন শেখ মুজিবুর রহমান) রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র বসিয়েছেন, নাকি ইউনাইটেড নেইশানসে রাশার ভিটো পাওয়ার কাজে লাগিয়ে চুরির ভোটে যুগের পর যুগ ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখার ধান্দায় রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র বসিয়েছেন তা আমি জানি না। আমি শুধু টেকনিক্যাল ও ইকোনমিক দিকটা আলোচনা করলাম।
Writer: ASM Fakhrul Islam