১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই জন্ম নেওয়া দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ৬৪ পেরিয়ে ৬৫তম বছরে পদার্পণ করছে বৃহস্পতিবার। অন্যতম বৃহৎ উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র ও উত্তরাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যেমন রয়েছে সাফল্য, তেমনি রয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাসও। যে ইতিহাস আজও দেশের মানুষকে সংগ্রামী করে তোলে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে দেশে উচ্চশিক্ষার পথ উন্মোচিত হয়। তবে তৎকালীন বাংলায় একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে মোটেও সক্ষম ছিল না। তাই বাংলা নামক এ ভূ-খন্ডে আরও একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন জরুরি হয়ে পড়ে। যা তীব্রভাবে অনুভূত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ বিভাগীয় শহর রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের মনে। ৪৭-এ দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সরকার দেশের সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এসময় রাজশাহীতে স্যাডলার কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করে।
মূলত সেখান থেকেই শুরু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। পরে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৫৩’ পাশ হয়। ওই বছরের ৬ জুলাই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ানি টমাসের স্থাপত্য পরিকল্পনায় ১৯৬৪ সালে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে মনোরম বৃক্ষশোভিত মতিহারের সবুজ চত্ত্বরের ৩শ’ হেক্টর জমিতে ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। নয়টি অনুষদের আওতায় ৫৭টি বিভাগ ও দু’টি ইনিস্টিটিউটে চার বছর মেয়াদী স্মাতক (সম্মান) এবং এক বছর মেয়াদী স্মাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করছে প্রতিষ্ঠানটি। এমফিল ও পিএইচডিসহ উচ্চতর গবেষণার জন্য এখানে রয়েছে পাঁচটি ইনিস্টিটিউট। আর এসব শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও গবেষণা কাজে সার্বক্ষণিক দিক নির্দেশনার মহান দায়িত্বে রয়েছেন প্রায় সাড়ে ১৪’শ শিক্ষক।
দেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রামেও অসামান্য অবদান রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। ৬২’র বিতর্কিত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল, ‘৬৯-এর গণভ্যুত্থান, ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের যেকোনো অন্তিম ক্রান্তিলগ্নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মাদ শামসুজ্জোহা।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবিবুর রহমান, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইয়ুমসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী। পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। এখানে শায়িত রয়েছেন নাম না জানা অসংখ্য শহীদ। তাদের ত্যাগের স্মৃতিকে এখনো ধারণ করে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
চাওয়া-পাওয়ার ৬৪ বছর : প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে গবেষণা ও জাতীয় ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এখানে রয়েছে বিশ্বমানের গবেষক-বিজ্ঞানী। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতো ভাষাবিদ থেকে শুরু করে অর্ধশতধিক বিজ্ঞানী ও গবেষকের কর্মস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ইতোমধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের জন্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টি কার্ড (আরএফআইসি) চালু করা হয়েছে। যার মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যাবতীয় তথ্য নিমিষেই জানা যাবে। কার্ড ব্যবহার করে সার্টিফিকেট, অনলাইন ব্যাংকিংসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে। গ্রন্থাগার, চিকিৎসাকেন্দ্র আধুনিকায়ন, আবাসিক সংকট নিরসনে ১৭টি হল, সিনেট অধিবেশন নিয়মিত হওয়া, জোহা চত্ত্বর, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, টিএসসিসি চালু, ক্যাম্পাসজুড়ে ওয়াইফাই চালু, স্বতন্ত্র আইবিএ ভবন নির্মাণসহ নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
এছাড়া গত বছর একনেকে পাশ হওয়া প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি টাকার বাজেটে নতুন দু’টি আবাসিক হল, শিক্ষকদের কোয়ার্টার নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের পথে। দ্বিতীয়বার ভিসি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব নিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সোবহান দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অপ্রাপ্তির পাল্লাও কম নয়। বিগত প্রায় ৩৩ বছর ধরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন হয়নি। শিক্ষকদের বিদ্বেষমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভুক্তভোগী হয় শিক্ষার্থীদের। যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়নে অনীহা শিক্ষার মানকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ। ছাত্র সংগঠনগুলোর সংঘতময় রাজনীতিতে বছরের প্রায় দিনই অস্থিরতা লেগে থাকে মতিহারের সবুজ চত্ত্বরে। সংঘাতে ঝরে পড়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রাণ। তবুও আশাবাদী অভিভাবকরা প্রতিবছরই এ বিদ্যাপিঠে পাঠায় তাদের স্নেহের নয়নের মণিদের। আকাঙ্খা শুধু এতটুকুই, স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে দেশ ও জাতির হাল ধরবে তাদের সন্তানেরা।