অক্সফোর্ডে পিএইচডি শেষ করার পর প্রায়ই একটি গল্প বলতে ইচ্ছা করে। তবে গল্পটি কীভাবে বলব, কাদের উদ্দেশ্যে বলব, তা কোন ভাবেই স্থির করতে পারছি না।
তাই অনেকটা ডাইরী লিখার মত নিজের কাছেই নিজের গল্পটি লিখে নিচ্ছি। দুঃখ এবং আনন্দের সংমিস্রণে গল্পটি তৈরি। আপনাদের কাছে ভাল লাগলে পড়তে পারেন।
দু’হাতে দুটি তার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটি লাল, অন্যটি নীল। সামনে একটি Oscilloscope. আরও আছে কয়েকটি LED লাইট (Light-emitting diode).
উড়ন প্রকৌশলের (Aerospace Engineering) ১ম বর্ষের প্রথম পদার্থ বিজ্ঞানে ব্যবহারিক পরীক্ষা।
আমাদের বেশ কয়েকটি জটিল তড়িৎ বর্তনী তৈরি করতে হবে, সাথে বিভিন্ন রঙের LED লাইটের শক্তি পরীক্ষামূলকভাবে নির্ণয় করতে হবে।
এরকম বর্তনীর অংক হাজারবার কষেছি বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার জন্য (তখন আমাদের কয়েক মিনিটে বেশ জটিল বর্তনীর গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে হত)।
সেই সাথে লাল, নীল সব রঙের শক্তি eV এককে আমার জানা। আর জেনার ভোল্টেজের (Zener voltage) সীমাবদ্ধতা তো এখনও ভুলতে পারি নি। তবে ওই লাল-নীল তারগুলে যে আমি কখনও দেখিনি।
Oscilloscope এর কথা তো বাদই দিলাম। এই দৃশ্যটি হয়ত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১ম বর্ষে খুব একটা নতুন কিছু নয়।
আমরা বাংলা মাধ্যমের যারা পড়ে এসেছি তাদের সেই সময় ব্যবহারিক করার সুযোগ তেমন ছিল না (ঢাকার কথা আলাদা, ঢাকা আর বাংলাদেশ এক না)।
তবে জার্মানির মত দেশে ভাল-খারাপ সব স্কুলের শিক্ষার্থীরাই ব্যবহারিক শিক্ষা পেয়ে থাকে। আমার চারপাশে তাই সবাই দ্রুত বর্তনীগুলো মিলিয়ে ফেলল।
তার কিছুক্ষণ পরই রুমে LED গুলো জ্বলতে শুরু করল। অনেকটা অসহায় অবস্থায় সেদিন বাস্তব চিত্রটি মেনে নিতে বাধ্য হই।
ময়মনসিংহের কেবি কলেজ থেকে আমি এইচএসসি দিই। সে বছর আমাদের কলেজটি ঢাকা বোর্ডে ১০ম হয়। আমরা অনেকেই গোল্ডেন এ প্লাস পাই, যা রেকর্ড ভাঙা ছিল (তখন এমন ফলাফল খুব কম হত)।
তবে আমরা কখনও প্রকৃত অর্থে ব্যবহারিক করিনি। এইচএসসির পূর্বে আমাদের ম্যাডাম বা স্যাররা ৫০-১০০ জনের সামনে ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো করিয়ে দেখাতেন।
নিজ হাতে কিছু করার সুযোগ ছিল না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। আমার এখনও মনে আছে, একদিন আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, সাখাওয়াত হোসেন স্যার, অনেক আন্তরিকতার সাথে আমাদের একটি পুরনো তড়িৎ বর্তনী মিলিয়ে দেখান। তা না দেখালে হয়ত এতটুকুও দেখা হত না।
এইচএসসির দুটি বছর আমি নিজ কলেজসহ ময়মনসিংহের সবকটি উল্লেখযোগ্য কোচিং সেন্টারে প্রতিটি পরীক্ষায় প্রতিবারই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম – একবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি (এখন বেশ অবাক লাগে বিষয়টি)।
বাসায় প্রায়ই বিভিন্ন কোচিং এর ভাইয়ারা আসতেন তাদের সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসার অনুরোধ করতে। ফলাফের দেয়ালে আমার নামটিই প্রথমে থাকত।
অভিভাবকদের অনেককেই বলতে শুনতাম, “এই হাসান সাদ ইফতি টা কে?” আমি চুপচাপ চলে আসতাম। অথচ, আমার পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের তেমন কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না।
পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন আগ্রহী ছাত্র কিংবা ছাত্রীকে কাছের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলক কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে।
আমি নিজেও এমন অনেক স্কুলের বাচ্চাদের আমার এক্সপেরিমেন্টের কাজে নিযুক্ত করেছি আমার পিএইচডির সময়।
বিজ্ঞানের ব্যবহারিক অংশটি পরীক্ষামূলক গবেষণার জন্য আবশ্যক। আর তাত্ত্বিক গবেষণা কখনও পরীক্ষামূলক গবেষণা ছাড়া পূর্ণতা পায় না।
আমি যে পিএইচডির জন্য পরীক্ষামূলক গবেষণা করব, তা অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য হিসেবে স্থির করি। আর সেই সুযোগ হয় অক্সফোর্ডে।
আমাদের গবেষণাপ্রকল্পের মোট মূল্য ছিল ৮১ কোটি টাকা, যা ব্রিটিশ সরকারের দেয়া। আমার বৃত্তি হিসেবে আরও ২ কোটি টাকা দেয় অক্সফোর্ডের প্রকৌশল ডিপার্টমেন্ট।
আমাদের পরীক্ষার জন্য Hypersonic Wind Tunnel চালাতে (ছবিতে দৃশ্যমান) প্রতিদিন ২.৫-৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়।
আমাদের অনেক ছোট ছোট যন্ত্র ১-২ লক্ষ টাকা করে, যা একবার ব্যবহার করা যায়। তবুও টাকার চেয়ে আমাদের গবেষণার মান নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হয়।
আমার পিএইচডিতে পরীক্ষামূলক জ্ঞানের আলোকে একটি তাত্ত্বিক সমাধান পেশ করেছি, যা প্রবাহী বলবিজ্ঞানে (Fluid Mechanics, পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক শাখা) বিশ্বের অন্যতম সেরা জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে।
আমার ভুল না হলে Experimental Hypersonics বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করা বিশ্বের সর্বপ্রথম বাংলাদেশি আমি।
অথচ, সেখানে বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাজ্য কিংবা জার্মানির সরাসরি অবদান বেশি। বিষয়টি বেশ দুঃখের।
একইভাবে আমার অক্সফোর্ডের পোস্টডক আর বর্তমানে আমেরিকার পোস্টডক আমেরিকার সরকারের প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রকল্পের অংশ। Hypersonics এর জন্য এ দুটি ল্যাবই বিশ্বসেরা পরীক্ষামূলক গবেষণাকেন্দ্র।
সেই দুটি তার হাতে নিয়ে থাকা মানুষটি আজ পরীক্ষামূলক গবেষণায় বিশেষজ্ঞ। আজ আমার বিজ্ঞানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই। গল্পটি হয়ত এখানেই শেষ করা যায়।
তবে এখানে শেষ করলে গল্পটি ঠিক পত্রিকায় বাংলাদেশিদের বিদেশে সাফল্য নিয়ে লিখা আর দশটা ফিচার পাতার মত হবে।
১৬-১৮ কোটি মানুষের দেশে এই কয়েকজন বিদেশে এসে ২-৩ টা ডিগ্রী নিলে বাংলাদেশের বিজ্ঞান এগিয়ে যায় না। এটা বাংলাদেশের সফলতা নয়, বরং বিফলতা।
আমাদের সময় পুরনো কয়েকটি দেয়াল, শিক্ষক-শিক্ষিতাদের আন্তরিকতা আর ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
আজ স্কুলগুলোর বেশ অর্থ হয়েছে। ডিজিটাল সাইনবোর্ড রয়েছে। আছে অনেকগুলো কম্পিউটারের ICT রুম। কিন্তু এসবের চেয়ে বেশি প্রয়োজন মৌলিক বিজ্ঞান শিক্ষা।
প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক ব্যবহারিক যন্ত্র, যা দিয়ে বাচ্চারা চাইলেই খেলতে পারবে। খেলতে খেলতে ভেঙে ফেলবে, শিখবে।
আমাদের ভাবতে হবে আমাদের বাংলা মাধ্যমের বাচ্চাদের জন্য। ঢাকার বাহিরে, মফস্বল শহরে, গ্রামে।
আমার দেশের মারী কুরী, গাউস, আইনস্টাইন, নিউটন, রামানুজানকে বিজ্ঞান নিয়ে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে।
প্রতিটি স্কুল যেন হয়ে ওঠে এক একটি শান্তিনিকেতন, বিজ্ঞানের শান্তিনিকেতন।
লেখক: হাসান সাদ ইফতি
উড়ন কৌশলী
অক্সফোর্ড