মনে আছে সেলবাজার ডট কম এর কথা?
২০০৬ সালের প্রথমার্ধে এই দেশে প্রথমবারের মতো এই প্লাটফর্মটি মোবাইলের এসএমএসের মাধ্যমে সেকেন্ড হ্যান্ড দৈনন্দিন বা নিত্য ব্যবহার্য পণ্য বিক্রি করার আইডিয়া নিয়ে অনলাইনে আত্নপ্রকাশ করেছিলো।
সে সময়ের নিরিখে জনাব কামাল কাদির সাহেবের সেই সেলবাজারের আইডিয়াটা খুবই ইউনিক, ক্রিয়েটিভ এবং ইনোভেটিভ ছিলো। তিনি মূলতঃ তার সেলবাজারের মাধ্যমেই বাংলাদেশে পরিচিতি লাভ করেন।
জনাব কামাল কাদির হচ্ছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক ও বিশিষ্ট উদ্যোক্তা, তাঁর হাত ধরেই বিকাশ গড়ে উঠে এবং তিনি বর্তমানে বিকাশের সিইও, ছোটবেলা থেকেই তাঁর ইচ্ছে ছিলো বাংলাদেশে একটা অনলাইন সেবাভিত্তিক খাত গড়ে তুলবেন। এমআইটি গ্রাজুয়েট এই ভদ্রলোকের একাডেমিক এবং প্রফেশনাল ক্যারিয়ার অত্যন্ত বর্ণাঢ্য! সেলবাজারের আতুঁরঘর হচ্ছে MIT Media Lab.
একের পর এক মালিকানা বদল হবার গল্পঃ এটি বেশ কয়েক বার মালিকানা বদল করে।
লঞ্চ করার কিছুকাল পরেই কাদের সাহেবের সাথে পার্টনারশীপ গড়ে দেশের টেলকো জায়ান্ট গ্রামীনফোন লিমিটেড, এর নাম হয় Grameenphone CellBazaar, আর জিপির হাত ধরেই যাত্রা শুরুর পরবর্তী ২ বছরে, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেলবাজার জিতে নেয় দুটি আন্তজার্তিক পুরস্কার। প্রথমটি হলো, ”টেক এওয়ার্ড (ইকোনমিক ডেভলপমেন্ট ক্যাটাগরিতে)”, আর ২য়টি হলো GSM Global Mobile Awards (Barcelona, 2008) “Best Use of Mobile for Social & Economic Development” – ক্যাটাগরিতে।
পরবর্তীতে ২০১০ সালে সেলবাজারকে কিনে নেয় জিপির প্যারেন্ট, নরওয়েইজিয়ান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ”টেলিনর এএসএ”। সে বছরই জনাব কামাল কাদির সেলবাজারের সিইও পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজের আরেকটি সফল উদ্যোগ বিকাশ লিমিটেডে জয়েন করেন। সে সময় সেলবাজারের ইউজার বেইজ ছিল ৪০ লাখেরও বেশী। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি প্রাক্তন গুগল কর্মকর্তা Shylendra Nathan কে এখানেই ডট কম এর সিইও পদে নিয়োগ দেয়া হয় যিনি কিনা ২০১৭ সালে কোম্পানি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত ঐ পদে থাকেন।
যেহেতু এর মালিক ছিলো জিপি ও পরবর্তীতে টেলিনর, সেহেতু ২০১১-১৩ ইং পর্যন্ত এটি শুধুমাত্র জিপি সীম ব্যবহারকারীদের জন্য ভ্যালু এডেড সেবা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর ১ বছর পর, ২০১৪ সালের জুনে নরওয়ের কোম্পানি Schibsted এটিকে টেকওভার করে। প্রকৃতপক্ষে সে সময় টেলিনরের শেয়ার থাকে মাত্র ৩৩.৩%। কারণ টেলিনর, ন্যাসপার আর স্কিবস্টেড – এই তিনটা কোম্পানি সেলবাজারকে সমান তিনভাগে কিনে নিয়েছিলো।
পুরনোকে ঝেড়ে ফেলে নতুন ব্র্যান্ডিংঃ
Schibsted টেকওভার করার পরে একে ঢালাওভাবে রিব্র্যান্ডিং করা হয় “এখানেই ডট কম” নামে।
অনেকেই বলেছেন, নতুন নামটা কোন সেন্স মেইক করে না। তার উপর সে সময় অলরেডি ekhoni.com নামে একটা ই-কমার্স সাইট ছিলো যেটা পরে বাগডুম ডট কমে পরিণত হয়। সুতরাং, এত কনফিউজিং নামে রিব্র্যান্ডিং করাটা নিঃসন্দেহে তাদের জন্য আত্নঘাতি ছিলো।
বিজ্ঞজনদের মতে, রিব্র্যান্ডিংয়ে
এখানেই ডট কমের পতনটি বাংলাদেশের ক্লাসিফাইড মার্কেটপ্লেসের ইতিহাসে একটা ট্রাজিক একসিডেন্ট। ট্রাজিক বলছি এই কারণে যে এর পতন কখনই হবার কথা ছিলো না, কিন্তু এই কারণে একে দুর্ঘটনা বলাও হয়তো ঠিক হচ্ছে না (এর কারণ নীচে ১১ টি বুলেট পয়েন্টে বলেছি)।
এটি ট্রাজিক একসিডেন্ট তার কারণঃ
ক) সেলবাজার ডট কম ছিলো দেশের ২য় অনলাইন মার্কেটপ্লেস (প্রথম ছিলো “ক্লিক বিডি”। ক্লিক বিডি আর সেলবাজারের ডোমেইন কেনা হয় যথাক্রমে ২০০৪ আর ২০০৫ সালে।)
খ) মালিক ছিলো জিপি-টেলিনরের মত প্রচন্ড শক্তিশালি ও অভিজ্ঞ কোম্পানি, ব্যবসায় হারার রেকর্ড যাদের খুবই কম।
গ) যথেষ্ঠ সময়
ঘ) যথেষ্ঠ রিসোর্স (হিউম্যান, ফিনানসিয়াল, ইনফ্রাসট্রাকচার
ঙ) আইডিয়া ও থিংক ট্যাংক, যারা একে তুমুল গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো।
কিন্তু এত দুর্দান্ত রকমের শক্ত ব্যাকাপ থাকার পরেও কেন দিনশেষে সার্ভিসটির শেষ রক্ষা হলো না, আমার আগ্রহের জায়গাটা ছিলো ঠিক সেখানেই। এই সেবাটির পরিণতি প্রমান করে দিয়েছে, আকাশচুম্বি সুযোগ সুবিধা থাকার পরেও একটি উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে স্রেফ এক্সিকিউশনের ভুলের দোষে।
২০১৫ সালের আগষ্ট পযন্ত এলেক্সা র্যাংকিংয়ে এটি ছিলো বাংলাদেশের টপ শপিং সাইট। আর বিজনেস ও ইকোনমি সাইটে পঞ্চম।
এখানেই ডট কম এর ক্যাম্পেইন স্ট্রাটেজিঃ
কয়েকটি বিষয় ও ইউনিক সেলিং প্রপোজিশন বা ইউএসপিকে ফোকাস করে এর ক্যাম্পেইন ডিজাইন করা হয়। তাদের ভিজুয়াল, কপি, সোশ্যাল মিডিয়া, জিডিএন সব জাগার কমিউনিকেশন সে অনুযায়ীই ডিজাইন করা হতো। যেমনঃ
১) বিনামূল্যে বিজ্ঞাপনঃ বিজ্ঞাপন দিতে কোন টাকা-পয়সা লাগবে না, একেবারে শুরুর দিকে এটা প্রচার করতো তারা।
২) বিজ্ঞাপন পোষ্ট করার নিরাপদ প্লাটফর্মঃ লোকে তখন অপরিচিত মানুষজনের সাথে সরাসরি দেখা করে পন্য বেচা-কেনা করতে নিরাপত্তার ব্যাপারে কনসার্ণ ছিলো। এই কারণে তারা নিরাপদ শব্দটা যোগ করে কমিউনিকেশন দাড় করিয়েছিলো। এটাকে সাপোর্ট দেবার জন্য তারা Varified Profile, user safety, ম্যানুয়ালি নাম্বার ভেরিফাই করা, ইত্যাদি সুবিধাও কমিউনিকেট করতে শুরু করলো।
২) Fastest way to buy and sell your products: এরপর যখন বিক্রয় ডট কম আর ফেসবুক গ্রুপের সাথে প্রতিযোগীতা বাড়লো, তখন এই ইউএসপি’র মাধ্যমে তারা তাদের টিজিকে এই রকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করলো যে, অন্য জাগাতেও এড দেয়া যায় তবে তাদের প্লাটফর্মে এড দিলে জিনিসপত্র দ্রুত কেনা-বেচা হয়।
৩) তাদের একাধিক ভিডিও কর্মাসিয়াল আর ক্যাম্পেইন ট্যাগ লাইন ছিলোঃ ”অপ্রয়োজনীয় জিনিস না জমিয়ে টাকা জমান।” ” যে কোন কিছুই বিক্রি করে দিতে পারবেন”, ইত্যাদি। এসবের মূল থিম ছিলো – turn anything into money!
৪) গাড়ির স্টিকারঃ কোন ওয়েব সাইটের বিজ্ঞাপন হিসেবে ঢাকা শহরে তারাই প্রথম গাড়ির স্টিকারে প্রবর্তন করে। এর পর থেকেই এই ট্রেন্ডটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে অন্যান্য অনলাইন সেবাদাতা ওয়েব সাইটদের মধ্যেও।
৫) কুরবানী পশুর সাথে এপ্লায়েন্স: ২০১২ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে এখানেই ডট এর প্রধান প্রতিযোগী বিক্রয় ডট কম ২০১৫ তে বাংলাদেশে ১ম বারের মত কুরবানী পশু বিক্রি করা শুরু করে। এরপর ২০১৬ তে এখানেই ডট কমও একই কাজ করা শুরু করে, তবে তারা পশুর সাথে সাথে ইলেকট্রিক হাউজ হোল্ড এপ্লায়েন্সের ক্যাম্পেইন লঞ্চ করে (কারণ, কোরবানী ঈদে ফ্রিজ/ওভেন/ বিবিকিউ গ্রিল – এসবের বিক্রি বেড়ে যায়) “কোরবানীর সবকিছু এখানেই” শিরোনামে।
৬) নীতিগত সেবাদানঃ নীতিগত চর্চার দিক থেকে বিক্রয় ডট কমের চাইতে এগিয়ে ছিলো এখানেই ডট কম। ব্যবহৃত মেডিক্যাল সরঞ্জাম, বেআইনী বস্ত, ইলেকট্রিক সিগারেট, দুর্লভ প্রানী (যা বিক্রি করা সরকারীভাবে দন্ডনীয় অপরাধ ছিলো), সেক্স টয় – এ ধরনের পন্যের বিজ্ঞাপন দেয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিলো, এবং এখানেই ডট কম এর বিশাল মডারেশন টিম এ সমস্ত অ্যাডকে কড়াকড়িভাবে মডারেট করতো। অথচ বিক্রয় ডট কমে ঐ ধরনের পন্যের বিজ্ঞাপন দেবার ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ ছিলো না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে চোরাই মোটর বাইক বিক্রি করারও অসংখ্য অভিযোগ ছিলো।
৫) টিভিসি-ওভিসির ঘনঘটাঃ
ঐ বছরই অর্থাৎ ২০১৪ সালে দেশের অন্যতম সেরা এড ফার্ম এশিয়াটিক JWT কে দিয়ে বেশ কয়েকটি টিভিসি-ওভিসি বানিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল (শুধু টিভিসি) আর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়, আর তার অডিও ভার্সন প্রচার করা হয় দেশের জনপ্রিয় রেডিও শোগুলোতেও!
এশিয়াটিক যতগুলো ভিডিও কর্মাসিয়াল বানায় এখানেই ডট কম এর জন্য, তার ভেতর সবচাইতে জনপ্রিয় হয় প্রতীক-ইয়াশনার টিভিসিগুলো। টিভিসিগুলোতে ডিরেকশন দেন মোস্তফা সারোয়ার ফারুকি, আর এতে অভিনয় করেন জনপ্রিয় অভিনেতা ও এশিয়াটিকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইরেশ জাকের, এবং মডেল মারিয়া নূর।
সে সময় টিভি বিনোদনের জগতে রীতিমতো একটা হাইপ তৈরী করেছিলো তাদের টিভিসি সিকুয়েলটা। আলাদা জিংগেল, আলাদা গান, আলাদা থিম, সবকিছু এখানেই ডট কমের জন্য আলাদা করে বানানো হয়েছিলো। খুব সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোন ক্লাসিফাইড এড-প্লাটফর্মের টিভিসি এত তুমুল জনপ্রিয়তা পায়নি।
এখানেই ডট কম এর সমস্ত টিভিসি-ওভিসিঃ
– এবার তোর কি হবে রে প্রতীক? (টিভিসি)
– কছ কি মমিন (টিভিসি)
– লিফট লাগবে (টিভিসি)
– Prodigal Son (টিভিসি)
– Looking for Real Bikes? (ওভিসি)
– হাতের কাছে টাকা, কেন ফেলে রাখা? (ওভিসি)
– বেচে দাও ভালো দামে, এখানেই ডট কমে (ওভিসি, পুরোটা ছড়ার মতো ছন্দে ছন্দে জিংগেল)
– একুশে ফেব্রুয়ারি (ওভিসি)
[এই টিভিসি-ওভিসি গুলোর একটা কম্পাইলেশন দরকার, কেউ করে দিতে পারবেন প্লিজ? আমার সময় নেই, তাছাড়া ভিডিও এডিটিং করিনা বেশ কয়েক বছর হলো!]
একই বছরে তৎকালীন আরেক প্রতিদ্বন্দি OLX.com এর সাথে এটিকে মার্জ করা হয়, যার প্যারেন্ট কোম্পানি NASPERS এর এক তৃতীয়াংশ শেয়ার ছিলো Ekhanei.com এ। এই কারণে ওএলএক্স এর সাউথ আফ্রিকান টিভিসিকে লোকালি এডপ্ট করেও এশিয়াটিক দুটি ওভিসি বানায়। এর একটার ক্যাম্পেইনের নাম ছিলোঃ “হাতের কাছে টাকা, কেন ফেলে রাখা?” (ওভিসি লিংক কমেন্টে)। অন এয়ার হয় ২০১৭ সালে।
কিন্তু টিভিসি জনপ্রিয়তা পেলে কি হবে, সাইটে বেচাবিক্রি খুব একটা বাড়লো না। এমনকি সাইটের রেজিঃ ইউজার অথবা ট্রাফিকও যে খুব বেশী বাড়লো, তাও না। ৫ বছর আগেকার কথা বলছি, সে সময় টিভিসি যত লোকে দেখতো, তার চাইতে অনেক কম লোক নেট ব্রাউজ করতো।
তো এত বড় একটা কোম্পানি একটা ব্যাক্তিমালিকান
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কয়েক কোটি টাকা দিয়ে রিব্রান্ডিং করা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের মে মাসে মাত্র এক দিনের নোটিশে – আই রিপিট – মাত্র ১ দিনের নোটিশে; লিটারেলি রাতারাতি “এখানেই ডট কমকে” একটি অনলাইন প্রজ্ঞাপন জারি করে অফিসিয়ালি বন্ধ ঘোষণা করে টেলিনর। প্রজ্ঞাপনের বক্তব্যও ছিলো ধোয়াঁশায় মোড়ানো।
বন্ধ করার ঠিক আগে আগে তাদের আরেকটা ভেঞ্চার বাইকবাজার ডট কম লঞ্চ করা হয়েছিলো, বাইক নিয়ে তারা একটা ছোটখাট শোও করেছিলো চীন মৈত্রী সম্মেলনে ২০১৫ তে যতদূর মনে পড়ে। এসব প্রমান করে যে তাদের বিজনেস এক্সটেন্ড করার প্ল্যান ছিলো। তাহলে হঠাৎ কি হলো যে রাতারাতি বন্ধ করে দিতে হলো?
বন্ধ করার ঘোষণাপত্রে টেলিনর বলেছিলো, ’বাংলাদেশের বাজার এখনো ক্লাসিফাইড মার্কেট প্লেসের জন্য তৈরী নয়।’ অপরদিকে দ্য ডেইলি স্টারকে বলা হয়, “আমরা Ekhanei কে যথেষ্ঠ লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয়েছি!”
তার মানে কি টেলিনরের মত দুনিয়ার ওয়ান অব দ্য বিগেষ্ট টেলিকম জায়ান্ট কোন রকম বাজার যাচাই করা ছাড়াই একুইজেশন করেছিলো এখানেই ডট কম কে? সেটা হবার কথা নয়। আর যদি বাংলাদেশের মার্কেটপ্লেস তৈরী না-ই থাকতো তাহলে তো কামাল কাদির সফলতার সাথে প্রথম কয়েক বছর সেবাটাকে চালু রাখতে পারতেন না। তাছাড়া, লাভের কোন প্ল্যান তাদের কোন পার্টনারের ছিলো না, কারণ প্রথম কয়েক বছর ছিলো তাদের জন্য ইনভেস্টমেষ্ট ফেইজ। তাহলে লাভের কথা বলে বন্ধ করে দেবার মানে কি?
তার মানে হলো, টেলিনরের এই বক্তব্য ছিলো অনেকটা গোঁজামিল দেয়া বক্তব্য।
(আপডেটঃ কিছুক্ষন আগে তাদের একজন এক্স-এমপ্লয়ীর নিজমুখে শুনলাম, বন্ধ হবার ঘোষণটা এতটাই অতর্কিতে হয়েছে যে, তারাও ভীষনরকম হতভম্ব ও অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো, তাদেরকেও আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি।
সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা তাদের শত শত BP (বিজনেস প্রমোটাররা) ঢাকার গুলশানস্থ ১ এর হেড অফিসে এসে ভীড় জমাতে শুরু করেছিলো তারপরের দিন থেকে। এক্সিকিউটিভ লেভেলের অনেককেই পরবর্তীতে টেলিনর হেলথ আর জিপিতে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়, অনেকে অন্য কোম্পানিতে সুইচ করে। এবং তারাও টিভিসি ক্যাম্পেইনের সমালোচনা করেছিলো, এবং প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া টেলিনরের অফিসিয়াল বক্তব্য নিজেরাও বিশ্বাস করেনি।)
এই রাতারাতি বন্ধ করার বিষয়টাতে আমার কাছে বেশ খটকা লাগে। তো আমি নিজের ব্যাক্তিগত আগ্রহে মাঠে নামলাম। কিন্তু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখি কেউ এর ব্যাপারে খুব বেশী কিছু জানে না। এই রহস্যজনক বিষয়টা নিয়ে কেন যেন কারোই কোন মাথা ব্যথা ছিলো না, অনলাইন-অফলাইনের
কেন এখানেই ডট কম মুখ থুবড়ে পড়লো; এত বড় একটা কোম্পানীর অধীনে থাকার পরেও, এই প্রশ্ন আমার মনে খচ খচ করতেই থাকলো। একটু একটু করে এ নিয়ে ঘাটাঘাটি ও পড়াশোনা করতে শুরু করে মুটামুটি এখানেই ডট কমের বিফলতার মূল কারণগুলো পয়েন্ট আউট করতে শুরু করলাম!
Ekhanei ডট কম – হারিয়ে যাবার সম্ভাব্য কার্যকারণসমূহঃ
১) ভুল জায়গায় বিজ্ঞাপনঃ আপনার ব্যবসার টিজি এক জাগায়, কিন্তু আপনার বিজ্ঞাপন চলে আরেক জাগায়, তাইলে ব্যবসা কিভাবে বাড়বে? আমার ধারনা, এখানেই ডট কম যত টাকা দিয়ে টিভিসি বানিয়েছে, তার তিন ভাগের ১ ভাগ টাকা ডিজিটাল মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং, গুগল এড ক্যাম্পেইন – এইসবে খরচ করলে কমপক্ষে তিনগুন বেশী ROI পেতো। তারা একেবারেই যে করেনি তা নয়, কিন্তু আরো অনেক বড় পরিসরে করা করা যেতো। পুরো ডিজিটালে একের পর এক ব্লাংকেইট ক্যাম্পেইন চালানো পসিবল ছিলো।
২) রিব্র্যান্ডিংয়ে
”Cellbazaar এখন Ekhanei। ভিজিট করুন এবং ফ্রি বিজ্ঞাপন দিন!” (কমেন্টে স্ত্রিনশট)]
ফলে একদিকে যেমন পুরনো ব্র্যান্ড ভ্যালু আর কাস্টমার বেইজ উভয়ই হারাতে হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে নতুন ব্র্যান্ড এরও ইমেজ সেভাবে গড়ে উঠেনি।
তবে রিব্র্যান্ডিংয়ে
ক. রিব্র্যান্ডিংয়ে
খ. শুরু থেকেই সেলবাজারের টার্গেট অডিয়েন্স ছিলো সেল বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করা ইউজাররা, এ কারণেই এর নাম ছিলো সেলবাজার। কিন্তু পরবর্তীতে তারা চেয়েছিলো এ ধারনা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের টিজির পরিসর আরোও বড় করতে, যারা শুধু মোবাইলই নয়, বরং কম্পিউটারও ব্যবহার করে। কিন্তু ”সেলবাজার” পাল্টিয় তো আর ”ডেস্কটপ বাজার” নাম দেয়া যায় না! তাই নতুন একটা নামের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো যেটা কোন স্পেসিফিক ডিভাইস ব্যবহারকারীদের এ্যাড্রেস করবে না।
মূলত এই দুটি কারণেই তারা সেলবাজারকে রিব্র্যান্ডিং করে ”এখানেই ডট কম” নামে বাজারে আত্নপ্রকাশ করে।
৩) প্রফিট রিস্কঃ অলরেডি বিপুল পরিমান ইনভেস্ট হয়ে গেছে, যেগুলো থেকে ROI কত পাওয়া যাবে কিংবা আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, সেটা নিয়েই যেখানে কোম্পানি অনিশ্চয়তার ভেতর ছিলো, সেখানে নতুন করে আর একটা পয়সাও ইনভেস্ট না করার সিন্ধান্ত নেবার কারণেই রাতারাতি বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো। এছাড়াও, প্রডাক্ট ও সেবার নকশা প্রণয়নে টিভিসির বাকী ২ ভাগ টাকা এই খাতে বিনিয়োগ করলে অভূতপূর্ব ফল পাওয়া যেতো। কিন্তু তা না করে তারা খামাখাই বিপুল পরিমান টাকা বিনোয়োগ করে টিভিসি বানিয়েছে যেটা থেকে দারুন ব্র্যান্ড এওয়ারনেস এসেছে বটে, কিন্তু রেভেনিউ অপেক্ষাকৃত বাড়েনি।
যদিও টেলিনর ও তাদের সাথে থাকা বাকী দুইটা পার্টনারের তখন পর্যন্ত কোন প্রফিট প্ল্যানিং ছিলো না। তারা শুধু টাকা ইনভেষ্ট করেই যাচ্ছিলো। সুতরাং, সেবাখাতের সম্ভাবনার অনিশ্চয়তার অজুহাত তুলে ”হঠাৎ করেই” ব্যবসা বন্ধ করে দেয়াটা অনেকের কাছেই অবান্তর লেগেছে।
৪) ফেসবুকে সহজলভ্য বিকল্পঃ ২০১৫ সালে ফেসবুক তাদের গ্রুপগুলোতে প্রডাক্ট সেলিং ফিচার নিয়ে আসে। বাকীটা আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না? তবে সে সময়ও তারা হাল না ছেড়ে বিভিন্ন ফেসবুকে গ্রুপে তাদের কনটেন্ট প্রমোট করা শুরু করে। হয়তো অনেকেরই মনে আছে, সে সময় অনেক সেলিং গ্রুপে ঢুকলেই গ্রুপের কভার ফটোতে এখানেই ডট কম এর বিজ্ঞাপন চোখে পড়তো।
৫) নতুনত্বের অভাবঃ একুইজেশনের ৫ বছর পরেও তেমন কোন সার্ভিস ইনোভেশন আনতে পারেনি ”এখানেই ডট কম।” অথচ বিক্রয় ডট কম এই কাজটা চমৎকারিত্বের সাথে করেছে। কয়েক মাস পর পরেই তাদের সাইটে ঢুকলেই নিত্য নতুন সব প্রয়োজনীয় ফিচার পাওয়া যেতো। এখানেই ডট কম এর একজন প্র কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, তারা এক্ষেত্রে বিক্রয় ডট কমকে নিয়মিত নজরদারি করতো, অর্থাৎ, বিক্রয় ডট কম কি কি নতুন ফিচার এনেছে, এটা তারা নিয়মিতই মনিটর করতো ও সে অনুযায়ী সিন্ধান্ত নিতো। এতেই প্রমান হয় যে তারা আসলে নিজেরাও জানতো যে তাদের তুলনায় বিক্রয় ডট কম এগিয়ে আছে।
৬) মোবাইল অ্যাপ লঞ্চে পিছিয়ে থাকাঃ বিক্রয় ডট কমই প্রথম মোবাইল অ্যাপ লঞ্চ করে। সে সময় এখানেই ডট কম এর নতুন ওয়েব সাইট লঞ্চ হবার কথা ছিলো, তারা সে লঞ্চ করার মাত্র দুয়েক দিন আগে বিক্রয় ডট কমের অ্যাপ লঞ্চ করা হয়। তখন এখানেই ডট কমের সাইট লঞ্চিং স্থগিত করে তারা এখানেই ডট কম এর জন্য মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের কাজ শুরু করে। এতে করে আরো পিছিয়ে যায় এখানেই ডট কম, আর অনেক এগিয়ে যায় বিক্রয় ডট কম।
এরপর চ্যাট ফিচারও আগে নিয়ে আসে বিক্রয় ডট কম। এই কারণে আরো জনপ্রিয়তা পায় তারা। কারণ ফোন নাম্বার শেয়ার করা ছাড়াই তখন ক্রেতা-বিক্রেতা
এরপর এখানেই ডট কম একটু হোল্ড করে চ্যাট ফিচার এড করে এ্যাপ স্টোরে আত্নপ্রকাশ করে। এখানেই ডট কম তাদের এন্ড্রয়েড অ্যাপ এবং ওয়েব সাইটের চ্যাট ও উন্নত সার্চ সুবিধাকে ফিচার করে পিআর করতে শুরু করে।
৭) ইউজার ভলিউমকে লেভারেজ করতে ব্যর্থ হওয়া এবং বিপিদের দৌরাত্ন্যঃ তৎকালীন দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মোবাইল ইন্টারনেট ইউজার ছিলো জিপির। এই বিপুল পরিমান ইউজারকে এখানেই ডট কমের ট্রাফিক/
এছাড়াও, তাদের বিজনেস প্রমোটারদের বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগ ছিলো। যেমনঃ তারা ভূয়া একাউন্ট থেকে ভূয়া বিজ্ঞাপন পোষ্ট করতো, একই পন্যের বিজ্ঞাপন একাধিকবার দিতো বিভিন্ন আংগিক থেকে ছবি তুলে।
৮) কারিগরি বিভ্রাট ও গ্রাহক হয়রানিঃ রিব্র্যান্ডিংয়ে
এছাড়া, রিব্র্যান্ডিংয়ে
৯) কাস্টমারদের সাথে লিয়াঁজো রাখতে ব্যর্থ হওয়াঃ তারা কাস্টমার ফিডব্যাক বা কাস্টমার কমপ্লেইন গুরুত্বের সাথে দেখতো বলে মনে হয় না। ২০১৬ তে আমি নিজে UI & UX রিলেটেড ইস্যুতে একাধিক কমপ্লেইন করেও কার্যকর কোন সুরাহা পাইনি। আমাকে কোনমতে একটা সমাধান দেয়া হয়েছিলো যেটা দিয়ে ঠেকার কাজ চলে, কিন্তু স্থায়ী কোন সমাধান তারা করেনি পরবর্তী এক বছরেও। অথচ প্রায় একই কমপ্লেইনের ক্ষেত্রে আমি বিক্রয় ডট কমের কাছ থেকে সঠিক ও দ্রুততর সুরাহা পেয়েছিলাম। (এ নিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট লিখেছিলাম)
১০) অদক্ষ ম্যানেজমেন্ট টিমঃ মাদার কোম্পানি ডাকসাইটে হলেও সিস্টার কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট অতটা দক্ষ ছিলো না। আমার ধারনা, সেলবাজারকে যে টিম দেখভাল করতো, অধিগ্রহণের পর তাদেরকে স্যাক করে নতুন টিম নেবার ফলে ম্যানেজমেন্ট হুমকির মুখে পড়ে। অধিকন্তু, শাট ডাউনের আগে এত এত বার কোম্পানিটি বিভিন্ন রকম বদলের ভেতর দিয়ে গেছে যে, অভ্যন্তরীন কর্মীদের পক্ষে ফোকাস ঠিকঠাকমতো ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিলো।
১১) সেবাকে লাভজনক করতে ব্যর্থ হওয়াঃ বিক্রয় ডট কম আন্তজার্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সুইডিশ কোম্পানি Saltside এর অধীনে এ দেশে তাদের সেবাকে চালু করে [অর্থাৎ, বলতে গেলে দেশের সমগ্র ক্লাসিফাইড মার্কেটপ্লেস দখল করে নেয় দুটি ইউরোপীয় কোম্পানি!] এবং বিক্রয় ডট কম তাদের সেবার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করে।
২০১৩-১৪ সালে, যাত্রা শুরুর মাত্র ১ বছর পরেই তারা তাদের সেবাকে মানিটাইজ করা শুরু করে। তাদের ইউজারদের জন্য বাড়তি কিছু সুবিধাজনক ফিচার সাইটে যুক্ত করে, যেটার বিনিময়ে ইউজারদের বাড়তি কিছু টাকা দিতে হতো। যেমনঃ মাত্র ৩০০-৫০০ টাকার বিনিময়ে বিক্রেতার পোষ্ট সার্চ রেজাল্টের সবার উপর দিকে দেখাতো, এমনকি পোষ্ট স্টিকি করে রাখারও ব্যবস্থা ছিলো।
অথচ সেই সময়েও এখানেই ডট কম শক্ত কোন বিজনেস বা মানিটাইজেশন মডেল দাঁড় করাতে পারেনি।
পরিশিষ্ঠঃ একটা ই-কমার্সের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য থাকে, বাজারে একক ও অদ্বিতীয় হওয়া। এখানেই ডট কম যখনই বুঝতে পেরেছে যে বাজারে নাম্বার ওয়ান আর হওয়া আর সম্ভব নয়, অর্থাৎ বিক্রয় ডট কম ই তাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে – তৎক্ষনাৎ তারা কোম্পানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফ্রি মডেলে তারা ভেবেছিলো ব্যবসা করবে, কিন্তু এটাই বাজার গবেষকরা মনে করেন যে, এখানেই ডট কম আদতে তৎকালীন কম্পিটিশনের কাছে হেরেই রাতারাতি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলো। তবে তারা চাইলে রাতারাতি বন্ধ না করে অন্তত ঐ মাসের শেষ পর্যন্ত অপারেশন চালিয়ে যেতে পারতো।
লোকমুখে শোনা যায়, তারা এটাকে বিক্রি করে দিয়েছে ভারতের কোন এক ক্লাসিফাইড ই-প্লাটফর্মের কাছে, যদিও এর পক্ষে কোন তথ্য প্রমান পাওয়া যায়নি। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিক্রয় ডট কম শিক্ষা নিয়েছে এখানেই ডট কমের ভুলগুলো থেকে, যেটা তাদেরকে পরবর্তীতে টিকে থাকতে হেল্প করেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই সেলবাজার ডট কম বছর দুয়েক আগে আবার পুরোদমে চালু হয়েছে। খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, কামাল কাদির সাহেব বা সেল বাজারের পুরনো টিম এর সাথে জড়িত নেই। তবে সেই পুরনো সাদামাটা লোগো, পুরনো ব্রান্ডিং, পুরনো ওয়েব ইন্টারফেস।
সেলবাজার ডট কমের ইতিহাস আমাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছে। মালিক যে-ই হোক না কেন, আমি কায়মনোবাক্যে চাই, এটি আবারো ঘুরে দাঁড়াক।
এই দেশের ই-কমার্স বা ক্লাসিফায়েড পোর্টাল নিয়ে যদি ইতিহাস লেখা হয়, তবে হয়তো সেখানে সেলবাজার ডট কমের এই ইন্টারেষ্টিং ও শিক্ষামূলক ইতিহাসটি সেখানে লেখা থাকবে, এই দেশের ভবিষৎ প্রজন্ম ও তরুন টেকি উদ্যোক্তারা এর ইতিহাস পাঠ্য বইয়ে পড়বে।
(ইষৎ সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত; প্রথম প্রকাশঃ জুলাই, ২০১৮ ইং। বৃহৎ আপডেটঃ ২৫ শে জুলাই ২০২০ ইং)
তথ্যসূত্রঃ
1) https://
2) https://
3) https://
4) https://
5) http://
6) https://
7) https://
8) https://
9) https://
10) https://