সেসব মানুষকে ধন্যবাদ যাদের আশীর্বাদের কারণে ৩৮ তম বিসিএসে সফলতা অর্জন করেছি। প্রথমেই বলে রাখা ভালো আমি ভালো ভালো পরামর্শদাতা নই এবং আমার পরামর্শে আপনাদের কতটুকু উপকার হবে তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দীহান। তবু যখন লিখতে বসেছি শুরু করি।
বিসিএস একটি দীর্ঘসময়ব্যাপী পরীক্ষা। আজ ফলাফল পাওয়ার পর যখন আমি পিছনে ফিরে তাকাচ্ছি তখন এই দীর্ঘ ৩ বছরের কথাগুলো গুছিয়ে লিখা অনেক কঠিন মনে হচ্ছে।
প্রস্তুতির শুরুতে আমি ভাবতে পারি নি যে বিসিএস নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার মত পরিস্থিতি কোনদিন আসবে।
৩য় বর্ষ (অনার্স) শেষ হবার পর সবার এই মনঃস্থির করা উচিত যে সে কি হতে চায়। সবার লক্ষ্য একই হবে না- কেউ বিসিএস,কেউ অন্যান্য সরকারি চাকরি,কেউ বেসরকারি চাকরি,কেউ M.Sc./MBA, কেউবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা-যে যেটাই করতে চাইবে সে ব্যাপারে শতভাগ একাগ্রতা নিয়ে লেগে থাকতে হবে এবং বাকীসব ভুলে যেতে হবে।
একসাথে সব নৌকায় পা দেওয়া যায় না। যেহেতু আমি বিসিএস এবং অন্যান্য সরকারি চাকরি (নন-টেকনিক্যাল) কে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম তাই এটা ছাড়া অন্য বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার ধৃষ্টতা আমি করবো না।
প্রিলিমিনারী প্রস্তুতি বিসিএস পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপ প্রিলিমিনারী পরীক্ষা। ২০০ নম্বরের একটি এমসিকিউ পরীক্ষা যেটা মূলত লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা নিরূপণ করে। বিসিএসের তুলনামূলক সহজ ধাপ এটি।
যদিও সঠিক পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের অভাবে এই ধাপটি পার হতে অনেকেই ব্যর্থ হয়। প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় যতগুলো বিষয় রয়েছে তার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে প্রথমেই বিগত বছরের প্রশ্নগুলো ভালোভাবে দেখতে হবে।
বোঝার চেষ্টা করতে হবে আমি কোন বিষয়ে ভালো আর কোন বিষয়ে ভালো না। যে বিষয়ে আমরা দুর্বল সে বিষয়গুলো মূলত দু’রকম।
প্রথমত, যেগুলোতে পড়লে ভালো করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, যেগুলো কোনো ভাবেই আমার আয়ত্তে আসার মত নয়। এটা ব্যক্তিভেদে ভ্যারি করে। দুইজন বন্ধু প্রকৌশল হলেই যে তারা এই বিষয়গুলোতেই ভালো বা খারাপ হবে এমন কোন কথা নেই।
তাই এই বিষয়টি ল্যাব রিপোর্টের মত কপি না করে নিজের মত করে ভাবতে অনুরোধ করছি। নিজের সবলতা ও দুর্বলতা বোঝা হলে এবার কাজ হলো যে বিষয়গুলোতে আমি ভালো সে বিষয়গুলোতে আমাকে সর্বোচ্চ ভালোতে পরিণত করা। আর আয়ত্তে আনা যাবে এমন দুর্বল বিষয়গুলোকে ভালোভাবে সময় দেওয়া।
আর যেগুলোকে আয়ত্তে আনা যাবেই না সেগুলো না হয় বাদই দিলাম। প্রিলিতে আমাদের ১২০+ পেতে হবে।
আরো বেশি পাওয়া যায় তবে ১২০+ কে নিরাপদ বিবেচনা করা হয়। এই ১২০+ পেতে কোন অংশে কত পাওয়া দরকার তাও ভেবে নিতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা প্রিলি পাসের অন্যতম হাতিয়ার। প্রিলির জন্য নূন্যতম এক সেট গাইড বই পড়া ভালো।
যেহেতু কোনো গাইড কোম্পানি আমাকে এখনো স্পন্সর করে নি সেহেতু কোনো গাইডের নাম উল্লেখ করলাম না। রেফারেন্স বই হিসেবে নবম- দশম এবং একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণীর বাংলা বই (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র), সামাজিক বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান, সাধারণ গণিত বই পড়া ভালো।
মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান সম্পর্কে জানতে একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণীর পৌরণীতি ১ম ও ২য় পত্র বই পড়া ভালো। বিসিএস না দিলেও বাংলাদেশের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানা উচিত।
লিখিত প্রস্তুতি এবার লিখিত পরীক্ষায় আসা যাক। এটাই মূল বিসিএস পরীক্ষা। ৯০০ নম্বরের একটি পরীক্ষা যাতে ৬০০ এর কাছাকাছি নম্বরকে জেনারেল ক্যাডার পাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ বলে বিবেচনা করা হয়।
বলা বাহুল্য এ যাবতকালে লিখিত পরীক্ষার সর্বোচ্চ নম্বর ৬৪৪। লিখিত পরীক্ষায় মোট বিষয় ৬টি। বাংলা(২০০), English (200), গণিত ও মানসিক দক্ষতা (৫০+৫০), বিজ্ঞান(১০০), বাংলাদেশ বিষয়াবলী(২০০), আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী (১০০)। লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস বেশ বড় এআং অল্প কথায় এটি তুলে ধরা কঠিন বিষয়।
লিখিত পরীক্ষা কোন গাইড সর্বস্ব পরীক্ষা নয়।এর জন্য বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত জ্ঞান দরকার।এক্ষেত্রে wikipedia, BBC, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য সংবাদপত্রের কলাম, বিভিন্ন রেফারেন্স বই, বিভিন্ন কোচিং এর শিট, স্যারদের নোটস অনুসরণ করা যেতে পারে।
বাংলা : লেখার হাত উন্নত হতে হবে। রেফারেন্স বই হিসেবে হায়াত মাহমুদের বাংলা ২য় পত্র বই এবং সৌমিত্র শিখরের বইটি অনুসরণ করা ভালো।সাহিত্য সমালোচনার জন্য অনেক বই পড়তে হবে।
English: নিয়মিত Translation করতে হবে। সম্পাদকীয় translation করা ভালো। এতে সাম্প্রতিক বিষয়ে জ্ঞান বাড়ে এবল চটজলদি লিখা যায়।
Math: বাজারের কোনো একটা বই সম্পূর্ণ শেষ করা। Mental Ability: বাজারের কোনো একটা বই সম্পূর্ণ শেষ করা।
সাধারণ বিজ্ঞান: HSC এর পাঠ্যবই থেকে chapter অনুসারে পড়তে হবে। সাথে ৯ম-১০ম শ্রেণীর সাধারণ বিজ্ঞান বই।
বাংলাদেশ বিষয়াবলী : সংবিধান ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পৌরণীতির বই এবং অন্যান্য রেফারেন্স থেকে ভালোভাবে পড়তে হবে।
অন্যান্য বিষয়গুলোর জন্য ইন্টারনেট,বাজেট বক্তব্য,অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বিভিন্ন স্যারদের নোটস অনুসরণ করা যায়।
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি : মোহাম্মদ আবদুল হাই এর “আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” বইটি অনুসরণ করা ভালো।
বিভিন্ন কোচিং, ফেসবুক গ্রুপ এবং অন্যান্য মাধ্যমে আমি ২০০+ বইয়ের নাম পেয়েছি। যা কেনার মত টাকা এবং পড়ার মত ধৈর্য্য কোনটাই আমার ছিলো না। তবে যে কেউ সে ধরণের বই পড়তে পারেন।
বেশি পড়লে কারো কোনো ক্ষতি হয় না। তবে বেশি পড়তে গিয়ে রিভিশনকে ক্ষতিগ্রস্থ করাও ঠিক না।
ভাইভা প্রস্তুতি এবার ভাইভা নিয়ে আলোচনা করা যাক। অত্যন্ত unpredictable। বিভিন্ন ভাইভা কোচিং এ mock-viva দিতে পারেন।
তবে পৃথিবীর কোনো কোচিং কাউকে ভাইভা দেওয়া শিখাতে পেরেছে বলে আমার জানা নাই। আপনার ভাইভা নির্ভর করবে আপনার নিজস্বতার উপর।
ভাইভার জন্য যা একেবারেই না জানলে নয় – নিজ এলাকা সম্পর্কে ক্যাডার চয়েস সম্পর্কে নিজের অনার্সের বিষয় সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান সম্পর্কে সাম্প্রতিক বিশ্ব সম্পর্কে বিসিএস নিয়ে আমার আগে অনেকেই লিখেছেন এবং অনেক ভালো লিখেছেন।
আমি লেখালিখির ব্যাপারে নিতান্ত অপটু এবং অনভিজ্ঞ। অতএব বিস্তারিত
জানতে তাদের পরামর্শ অনুসরণ করুন। আপনি যত পরামর্শ নিন আর যত উপদেশই শুনুন দিনশেষে পরীক্ষাটা আপনাকেই দিতে হবে।
পরামর্শ দাতা পরীক্ষা দিতে যাবে না। তাই পরামর্শ নিন। কিন্তু শুধু পরামর্শের পিছনে সময় নষ্ট না করে পড়াশুনা করুন। কথা শেষ করার আগে একটা কথা না বললেই নয় জোর করে কখনোই কোনো কাজ হয় না। যাদের বিসিএস দেবার ইচ্ছা তারাই কেবল বিসিএস দিন।
অন্যকে দেখে অথবা পরিবারের দ্বারা তাড়িত হয়ে বিসিএস না দেওয়াই ভালো। তাতে আপনার চাকরি জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ আর দেশেরও তাতে কোনো উপকার হবে না। আর সর্বাবস্থায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা রাখতে হবে।
আমার এই পরামর্শ যদি আপনাদের উপকারে আসে তবেই আমি আনন্দিত হব। আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন। ধন্যবাদ।
সৌম্য চৌধুরী, প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশকৃত (মেধাক্রম-২য়) ৩৮তম বিসিএস তড়িৎকৌশল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)