উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমনে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তীব্র স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি থাকায় আমাদের দেশে চাকরিক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং খুব একটা ম্যাটার করে না।
তার ওপর দেশের উচ্চশিক্ষার যে বেহাল দশা, তাতে র্যাংকিং এ বেশি কিছু আসে যায় না। তবে বিদেশে চাকরিক্ষেত্রে ইন্ডিভিজুয়াল এচিভমেন্ট এর পাশাপাশি ইউনিভার্সিটির রেপুটেশন তথা র্যাংকিংও অনেক গুরুত্বপূর্ণ৷
বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ালিটি যাচাইয়ে সবচেয়ে রিলায়েবল দুই র্যাংকিং সিস্টেম হচ্ছে Times Higher Education (THE) ও Quacquarelli Symonds (QS)। এগুলো ছাড়াও আরো দুই-একটা র্যাংকিং মোটামুটি ভালো। বাকীসব গার্বেজ।
এরকম একটা গার্বেজ হচ্ছে Worldometrics। তবে বাংলাদেশীদের কাছে এটা খুব প্রিয়। কারণ সবাই তার নিজ ভার্সিটিকে এই লিস্টে দেখতে চায়।
যাইহোক, প্রতিবার THE বা QS নতুন তালিকা প্রকাশ করলে দেশে এ নিয়ে কিছুটা সোরগোল শুরু হয়, পক্ষে ও বিপক্ষে দুইটা গ্রুপ তৈরি হয়। এই মতপার্থক্য যতোটা বুদ্ধিবৃত্তিক, তার চেয়ে বেশি ইগোইস্টিক।
তবে কী কী ক্রাইটেরিয়ার ওপর ভিত্তি করে র্যাংকিং দুইটি করা হয় তা জানলে এই অহেতুক মতপার্থক্য কিছুটা কমবে বলে আশা করি। একইসাথে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গমনে বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশনেও তা অনেকটা সহায়ক হবে।
প্রথমে দেখি THE এর র্যাংকিং ক্রাইটেরিয়াগুলো কী কী ও এগুলোর কোনটি কতোটা গুরুত্ব বহন করে।
THE মূলত পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাবিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং করে৷ এগুলো হচ্ছে:
১. টিচিং (৩০%) – এর মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেপুটেশন, শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা, আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থীর অনুপাতে ডক্টোরাল প্রোগ্রামে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, প্রতি শিক্ষকের বিপরীতে ডক্টোরাল প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আয়ের পরিমাণ।
২. রিসার্চ (৩০%) – রিসার্চে ইউনিভার্সিটির রেপুটেশন, রিসার্চ প্রজেক্ট গ্র্যান্ট এর পরিমাণ ও রিসার্চ আউটপুট তথা পিয়ার রিভিউড জার্নালে পাবলিলেশনের সংখ্যা, ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে এই নম্নর প্রদান করা হয়।
৩. সাইটেশন (৩০%) – গবেষণার কোয়ালিটি যাচাইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হচ্ছে সাইটেশন। একটা রিসার্চ পেপার কতোবার অন্যের পেপারে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ হয়েছে, তা হচ্ছে ওই পেপারের সাইটেশন নাম্বার। সাইটেশন পার ফ্যাকাল্টি ও সাইটেশন পার পেপার এর ভিত্তি করে ৩০% মার্কস দেয়া হয়।
৪. ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক (৭.৫%) – লোকাল স্টুডেন্ট ও ফ্যাকাল্টির বিপরীতে ফরেইন স্টুডেন্ট ও ফ্যাকাল্টির অনুপাত এবং ইন্টারন্যাশনাল কোলাবোরেশান এর ওপর এই সাড়ে সাত পারসেন্ট নম্বর বরাদ্দ।
৫. ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম (২.৫%) – এটাকে নলেজ ট্রান্সফার বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট জ্ঞান ইন্ডাস্ট্রিতে পৌঁছে দেয়া। এর ওপর আড়াই পারসেন্ট নম্বর।
এবার দেখি QS র্যাংকিং এ ক্রাইটেরিয়াগুলো কী কী।
১. একাডেমিক রেপুটেশন (৪০%) – একাডেমিশিয়ানদের দ্বারা ইউনিভার্সিটি বা কোন সাবজেক্ট বেইজড টিচিং ও রিসার্চ সার্ভে করিয়ে এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি এই নম্বর প্রদান করা হয়।
২. এমপ্লয়ার রেপুটেশন (১০%) – জব সেক্টরে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে ভালো করছে, কোন বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে স্কিলড ও ইনোভেটিভ শিক্ষার্থী প্রডিউস করতে পারছে এসবের ওপর থাকে ১০% মার্কস।
৩. ফ্যাকাল্টি/স্টুডেন্ট রেশিও (২০%) – একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, এর ওপর ২০%।
৪. সাইটেশন পার ফ্যাকাল্টি (২০%) – সাইটেশন নিয়ে ওপরে সংক্ষেপে বলেছি। এর ভিত্তিতে ২০% মার্কস দেয়া হয়।
৫. ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাকাল্টি ও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট (৫% + ৫%) – লোকাল ফ্যাকাল্টি ও স্টুডেন্টদের সংখ্যার বিপরীতে ফরেইনারদের সংখ্যার ওপর ৫ ও ৫ করে মোট ১০%।
THE ও QS র্যাংকিং এর ক্রাইটেরিয়া ও এগুলোর ওয়েট পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে THE রিসার্চকে ও QS ইউনিভার্সিটির রেপুটেশনকে অন্য সব ক্রাইটেরিয়া থেকে কিছুটা বেশি গুরুত্ব দেয়।
সেক্ষেত্রে STEM এর সাবজেক্টের ক্ষেত্রে THE এবং Non-STEM সাবজেক্টের ক্ষেত্রে QS র্যাংকিং মোর রিলায়েবল বলে আমার কাছে মনে হয়।
আবার যেসব দেশ সহজে পিআর/নাগরিকত্ব প্রদান করে, সেসব দেশের ইউনিভার্সিটিগুলো র্যাংকিং এ কিছুটা এগিয়ে থাকে।ভার্সিটির কোয়ালিটি বিবেচনায় এটাও বিবেচ্য হতে পারে।
সর্বোপরি, THE ও QS উভয়ই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সবচেয়ে রিলায়েবল দুটি র্যাংকিং সিস্টেম। সুতরাং এই দুইটি কিংবা এর যেকোনো একটিতে যদি কোন ভার্সিটি এগিয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সে ভার্সিটি একাডেমিক্যালি ও রিসার্চে ভালো করছে।
তারা স্কিলড ও ইনোভেটিভ স্টুডেন্ট প্রডিউস করছে এবং তাদের স্টুডেন্টরা জব সেক্টরে ভালো সার্ভিস দিয়ে এম্পলয়ারদের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছে।
যেসব ভার্সিটি এই লিস্টে নেই বা পেছনের দিকে, তারা ওপরে উল্লেখিত সব প্যারামিটারে পিছিয়ে আছে। এখানে প্রাইভেট-পাবলিক বা নতুন-পুরাতন বিবেচনায় আত্মতুষ্টি বা হীনমন্যতায় ভোগার কিছু নেই।
Mahbubul Alam
পিএইচডি স্টুডেন্ট
স্কুল অব এনার্জি এন্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং,
উলসান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সাইয়েন্স এন্ড টেকনোলজি (ইউনিস্ট), উলসান, সাউথ কোরিয়া।