বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জীবনে একটি অসমাপ্ত কাজ ছিল। তিনি তার জীবনে শেষ দীর্ঘ পঁয়ত্রিশটি বছর এই অসমাপ্ত কাজটি শেষ করার চেষ্টা করেও কোন কুল কিনারা করতে পরেননি। কি ছিল তার সেই অসমাপ্ত কাজ?
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একটি তত্ত্বের পিছনে কাজ করে গেছেন, সেই তত্ত্বটি হল- ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি বা সমন্বিত ক্ষেত্র তত্ত্ব।
তিনি এমন একটি তত্ত্ব গঠন করতে চেয়েছিলেন যা দ্বারা আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুকে ব্যাখ্যা করা যাবে, অর্থাৎ মৌলিক চারটি বল গুলোর ভিতর সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে। যাকে আমরা পরবর্তীতে “থিওরি অফ এভরিথিং” নামে চিনি।
এখন কথা হল থিওরি অফ এভরিথিং কেন জরুরী? সহজ করে বললে, একটা সময় মানুষ বিদ্যুৎ, চুম্বক এবং আলোকে আলাদা আলাদা মনে করত।
কিন্তু পরে দেখা গেল বিজ্ঞানী হেন্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেইড আবিষ্কার করলেন তড়িৎ প্রবাহের ফলে চুম্বক বলরেখা তৈরি হয়। আবার বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে আবিষ্কার করলেন পরিবর্তনশীল চুম্বক ক্ষেত্র দ্বারা তড়িৎ প্রবাহিত হয়।
এই দুজন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারে দেখা গেল চুম্বক এবং বিদ্যুৎ একে অপরের মধ্যে রূপান্তর সম্ভব অর্থাৎ তাদের ভিতর সম্পর্ক আছে। শেষমেশ বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল আবিষ্কার করলেন, তড়িৎ ক্ষেত্র এবং চুম্বক ক্ষেত্র পরস্পর সমকোণে প্রয়োগ করলে এক প্রকার তরঙ্গ উৎপন্ন হয় যাকে বলে তাড়িত-চৌম্বক তরঙ্গ। তখন ম্যাক্সওয়েল বললেন আলোই আসলে তাড়িত-চৌম্বক তরঙ্গ। প্রথমে আমরা দেখেছিলাম চৌম্বক এবং বিদ্যুতের মধ্যে সম্পর্ক। এবার আমরা দেখলাম চৌম্বক, বিদ্যুৎ এবং আলো তিনটাই একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ একে অপরের রূপান্তর সম্ভব।
এখন আমরা এদের একে অপরের ভিতর সম্পর্ক জানার পর এদের খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। একে অপরের রূপান্তরের মাধ্যমে এদের নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন কিছু করতে পারি যেমন, ঘরের ফ্যান, লাইন, ইন্টারনেট আরও কত কি!
আমরা সকলেই জানি আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মৌলিক বল হল চারটি- তাড়িত-চৌম্বক বল, মহাকর্ষ বল বা গ্র্যাভিটি, দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং সবল নিউক্লিয় বল। এই চারটি বল দ্বারাই আমাদের পুরো মহা বিশ্ব তৈরি হয়েছে। আমরা যদি এই চারটি বলকে বিশ্লেষণ করতে পারি অর্থাৎ একে অপরের সাথে সম্পর্ক বের করতে পারি তাহলে আমরা আমাদের পুরো মহাবিশ্বকেই ব্যাখ্যা করতে পারব।
এবং এই বল গুলো একে অপরের রূপান্তর দ্বারা এমন এমন সব কাজ করতে পারব যা আমরা এখনো ভাবতেও পারিনা। অর্থাৎ আমরা এই চারটি বলের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে পারব।
তবে কাজটি মোটেও সহজ নয়। ষাটের দশকে যখন তত্ত্বটি নিয়ে কাজ শুরু করা হয় তখন বাকি তিনটি বলের ভিতর সম্পর্ক স্থাপন করে একীভূত করা গেলেও গ্র্যাভিটি কে একীভূত করা সম্ভব হয়নি। বল গুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা হয় মাইক্রো লেভেলে গিয়ে অর্থাৎ প্রতিটা বলের জন্য আলাদা আলাদা কোয়ান্টাম থিওরি গঠন করে।
কিন্তু মূল সমস্যাটা হয় গ্র্যাভিটির জন্য কোন কোয়ান্টাম থিওরি বা কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা যদি এখন গ্র্যাভিটির জন্য একটি কোয়ান্টাম থিওরি গঠন করতে পারি বা কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি বের করতে পারি তাহলে আমরা চারটি বলকে একীভূত করতে পারব অর্থাৎ হাতে পেয়ে যাব আমাদের “দ্যা থিওরি অফ এভরিথিং”।
আমাদের পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের হাতে দুটি কার্যকর তত্ত্ব আছে। একটি তত্ত্ব ম্যাক্রো লেভেলের অর্থাৎ বড় জিনিস নিয়ে কাজ করে আর অপরটি হল মাইক্রো লেভেলের অর্থাৎ ছোট জিনিস নিয়ে কাজ করে।
ম্যাক্রো লেভেলের তত্ত্বটি হল আমাদের আইনস্টাইনের থিওরি অফ জেনারেল রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব। যা বড় জিনিস ব্যাখ্যা করে অর্থাৎ গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, নেবুলা, বিগ ব্যাং।
আবার মাইক্রো লেভেলের তত্ত্বটি হল কোয়ান্টাম মেকানিক্স যা ছোট জিনিসকে ব্যাখ্যা করে অর্থাৎ অতি পারমাণবিক কণা যেমন: ইলেকট্রন, লেপ্টন, কোয়ার্ক, নিউট্রিনো, মেসন ইত্যাদি।
দুটো তত্ত্বই আলাদা আলাদা ভাবে পুরো মহাবিশ্বকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু একত্রে নয়। আমাদের কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি গঠন করার ক্ষেত্রে এটাই হল আমাদের আসল সমস্যা।
কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি বা থিওরি অফ এভরিথিং গঠনের জন্য ষাটের দশকে বিজ্ঞানীরা
যুগান্তকারী একটি হাইপোথিসিস নিয়ে আসেন আর তা হল স্ট্রিং থিওরি বা তার তত্ত্ব। আমাদের সবার পরিচিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মতে এই স্ট্রিং থিওরিই হল থিওরি অফ এভরিথিং গঠনের একমাত্র উপায়।
এখন জানা দরকার কি এই স্ট্রিং থিওরি?
সহজ করে বললে আমাদের পুরো মহাবিশ্ব গড়ে উঠেছে দুই ধরনের কণা দ্বারা- ফার্মিয়ন এবং বসোন (বসোন কণার নামকরণ আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বোস এর নাম থেকে করা হয়েছে)। ফার্মিয়ন হল বস্তু কণা যা দুই প্রকার- কোয়ার্ক এবং লেপ্টন।
কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি হয় প্রোটন এবং নিউট্রন। আর লেপ্টন দিয়ে তৈরি হয় ইলেকট্রন। আর ইলেকট্রন প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়েই বিশ্বের সকল বস্তু তৈরি হয় তাই ফার্মিয়নকে বলে বস্তু কণা। আবার বসোন হল শক্তি কণা যার উদাহরণ হল ফোটন।
আরও যদি গভীরে গিয়ে প্রশ্ন করি ফার্মিয়ন এবং বোসন এই দুই প্রকার কণা আবার কি দিয়ে তৈরি? এর উত্তর হল স্ট্রিং! ফার্মিয়ন এবং বোসন কণা একমাত্রিক স্ট্রিং বা এক প্রকার তার দিয়ে তৈরি যা সর্বদা একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে কাপতে থাকে। এই স্ট্রিংয়ের পরে আর কিছু নেই। অর্থাৎ পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক হল এই স্ট্রিং।
একেক স্ট্রিংয়ের কম্পনের ফ্রিকোয়েন্সির জন্য একেক রকম কণা হয়। আর এই ফ্রিকোয়েন্সির উপর নির্ভর করে প্রতিটা কণার ভর, চার্জ ইত্যাদি নির্দিষ্ট হয়।
স্ট্রিং আবার দুই ধরনের হয়- উন্মুক্ত স্ট্রিং এবং বদ্ধ স্ট্রিং যার দুই প্রান্ত জোড়া লাগানো থাকে। উন্মুক্ত স্ট্রিং আবার বদ্ধ স্ট্রিংয়ে রূপান্তর হতে পারে। এই বদ্ধ স্ট্রিংয়ের কম্পনের জন্য স্পিন-২ নামে এক ধরনের ভরহীন কণার সৃষ্টি হয়।
স্পিন-২ এর একটি উদাহরণ হল গ্র্যাভিটন (গ্র্যাভিটন কণা এখনো একটি হাইপোথিসিস যা বোসন কণা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত)। এই গ্র্যাভিটনের মিথস্ক্রিয়ার ফলেই মহাকর্ষ বল বা গ্র্যাভিটির সৃষ্টি হয়। যেহেতু এই স্ট্রিং থিওরি গাণিতিক ভাবে প্রমাণিত তাই এটাই হল কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি বা গ্র্যাভিটির কোয়ান্টাম তত্ত্ব।
স্ট্রিং থিওরির আবার ১৯৯৫ সালের আগ পর্যন্ত পাঁচটি ভার্সন ছিল। পাঁচটি ভার্সন হল: type-I, type-IIA, type-IIB, SO(32), E8×E8. স্ট্রিং থিওরির প্রথম ভার্সন ছিল বোসনিক স্ট্রিং থিওরি যা শুধুমাত্র বোসন কণার ব্যাখ্যা করতে পারত।
সব থেকে মজার ব্যাপার হল বোসনিক স্ট্রিং থিওরির গাণিতিক সমীকরণ বের করে দেখা যায় এই স্ট্রিং আমাদের পরিচিত শুধু চারটি মাত্রা (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এবং সময়) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা ছিল ওই চার মাত্রা সহ মোট ছাব্বিশ মাত্রা যুক্ত স্ট্রিং থিওরি!
এই স্ট্রিং থিওরি শুধু বোসনকে ব্যাখ্যা করে তাই ফার্মিয়নের জন্যও একটি স্ট্রিং থিওরি দরকার। পরে বিজ্ঞানীরা আলাদা ভাবে দশ মাত্রার সুপার স্ট্রিং থিওরি গঠন করে ফার্মিয়ন কণাকে ব্যাখ্যার জন্য। কিন্তু এভাবে দেখা যায় স্ট্রিং থিওরি একটি সাধারণ তত্ত্বের দিকে না গিয়ে অনেক গুলো গুচ্ছ তত্ত্বের জন্ম দিচ্ছে।
এরপর ১৯৯৫ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ায় আয়োজিত স্ট্রিং থিওরি কনফারেন্সে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ফর এডভান্স স্টাডির বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইটেন স্ট্রিং থিওরির পাঁচটি ভার্সনকে একত্র করে এগারো মাত্রার এম-তত্ত্ব (M-Theory) প্রদান করেন।
এই এম-তত্ত্ব যেহেতু একটি থিওরির মধ্যে গ্র্যাভিটি সহ মহাবিশ্বের প্রতিটা কণা এবং মৌলিক বলকে ব্যাখ্যা করতে পারে তাহলে এই এম-তত্ত্ব (সমন্বিত স্ট্রিং তত্ত্ব) ই হবে আমাদের বহুল প্রতীক্ষিত “দ্যা থিওরি অফ এভরিথিং”।
কিন্তু এই স্ট্রিং এতই ক্ষুদ্র (10^-35cm) যে একে পর্যবেক্ষণ করা বর্তমান প্রযুক্তি দ্বারা অসম্ভব। এই স্ট্রিং থিওরি গাণিতিক ভাবে প্রমাণিত কিন্তু প্র্যাকটিক্যালি যেহেতু প্রমাণ করা এখনো সম্ভব হয়নি এবং এখনো আরও কিছু সীমাবদ্ধতার আছে তাই আমরা এখনো আমাদের থিওরি অফ এভরিথিংকে পুরোপুরি হাতে পাইনি।
স্ট্রিং থিওরির বর্তমান গবেষণার লক্ষ্য হল, ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করা, বিগ ব্যাংয়ের পরে ঘটা মহাবিশ্বের প্রসারণের গ্রহণযোগ্য সমাধান সহ ছোট একটি মহাকর্ষীয় ধ্রুবক খুঁজে বের করা। তবে এটা এখনো জানা যায়নি স্ট্রিং থিওরির মধ্যে এসবের সমাধান আছে কিনা বা এসবের জন্য কতটুকু স্বাধীনতা আছে।
রবিউল হাসান, রুয়েট
তথ্যসূত্রঃ স্পেস ডট কম, লাইভসায়েন্স ডট কম, উইকিপিডিয়া।
ছবিসূত্রঃ আমার নিজের বানানো।