ডাটা সেন্টার কি? কিভাবে এটি কাজ করে?
ইন্সটাগ্রাম অথবা ইউটিউব চ্যানেলটিতে প্রতিনিয়ত যে সকল ছবি কিংবা ভিডিও আপলোড করে থাকেন তা কোথায় সংরক্ষিত থাকে।
আপনি যখন আপনার মোবাইল থেকে গান শোনেন তখন সেই গানটি আপনার মোবাইলের মেমোরিতে আগে থেকেই সেভ করা থাকে।
ঠিক তেমনি ভাবে আমরা যখন ইন্টারনেটে কোন ছবি কিংবা ভিডিও প্রচার করি সেটিও একটি নির্দিষ্ট যায়গাতে লিপিবদ্ধ থাকে।
ডাটা সেন্টার
অনলাইনের সকল ফাইল সংরক্ষন কারি কম্পিউটারকে বলা হয় সার্ভার। মুলত এই সকল সার্ভার এক সাথে যে যায়গায় সম্মিলিত ভাবে রাখা হয় তাকেই ডাটা সেন্টার বলা হয়।
ডাটা সেন্টারের কাজ
অনলাইনে প্রতিটি বড় বড় সাইটের নিজেস্ব সার্ভার রয়েছে যার মাধ্যমে তারা সকলের কাছে তাদের তথ্য প্রচার করেন।
যেমন ধরুন গুগলের নিজেস্ব ডাটা সেন্টার রয়েছে, যেখানে আপনার গুগলের ইমেইল, পাসোয়ার্ড এছাড়াও যদি আপনি গুগল ড্রাইভে কিছু রাখেন তাহলে তা সেভ হয়ে থাকে।
এ ক্ষেত্রে কম্পিটার সার্ভার থেকে লোকাল কম্পানি গুল স্পেস ক্রয় করে তারা ছোট খাট অনলাইন সাইটের কাছে সেগুল ব্রিক্রি করে থাকে যাকে বলা হয় হোস্টিং।
যেমন ধরুন আমাদের ওয়েবসাইট “engineersdiarybd.com” এই সাইটের জন্য কিন্তু নিজেস্ব কোন সার্ভার বা ডাটা সেন্টার ক্রয় করার প্রয়োজন হয়নি।
যেকনো লোকাল কম্পানির কাছ থেকে হোস্টিং ক্রয়ের মাধ্যমে এই সাইটের সকল কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।
এমনকি আপনি এখন যেই লেখাটি পরছেন সেটিও ডাটা সেন্টারের কোন এক সার্ভারে লোকাল হোস্টিং এর মাধ্যমে সংরক্ষিত।
ডাটা সেন্টার নিয়ন্ত্রণ
বিশ্বের প্রতিটি ডাটা সেন্টারগুল পরিচালিত হয় সুপার কম্পিটারের সাহায্যে।যেখানে অনেকটা ঠান্ডা পরিবেশে এই ডাটা গুল রাখা হয়।
ডাটা সেন্টার চালু করার পর থেকে সেই কম্পিটার গুলকে চব্বিশ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে অন রাখা হয়।
যে কারনে সেই কম্পিউটারকে কৃত্তিম ভাবে শীতল রাখার জন্য এমন ব্যাবস্থা।
প্রতিটি ডাটা সেন্টারের নিজেস্ব পাওয়ার প্লান্ট এবং কোটি কোটি তথ্য সংরক্ষিত থাকে। এমনকি ভুলেও যেন মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য সেই কম্পিউটারটি বন্ধ হয়ে যাওয়া বা তাতে ঝামেলা দেখা না যায় সে বিষয় সর্বদা সতর্ক থাকেন সেখানকার নিয়োজিত কর্মকর্তারা।
ডাটা সেন্টারকে কি নিজেস্ব ভাবে বানানো সম্ভব –
ডাটা সেন্টারের যে কয়েকটি বিষয় রয়েছে সে গুলো হচ্ছে
- আধুনিক সুপার কম্পিউটার,
- ২৪ ঘন্টায় সিকিউরিটি প্রদান,
- এর সব কিছু রক্ষনাবেক্ষন।
আর এই সব কিছুর বিবেচনায় দেখা যায় নিজেস্ব ভাবে ডাটা সেন্টার বানানো অনেকটাই ব্যায়বহুল ব্যাপার।
এ ক্ষেত্রে আপনি হয়তো দেখেছেন আমাদের দেশের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের আলাদা কিছু সাইট থাকে।
যেখান থেকে মানুষ মুভি বা টিভি সিরিজ খুব সহজেই ডাউনলোড কিংবা দেখতে পারে। তবে আপনি কিন্তু তাদের ইন্টারনেট ছাড়া সেই সাইটে অন্য ইন্টারনেট লাইন দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেননা।
যার মানে হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে লোকাল সার্ভার এমনকি এটি একটি নির্দিষ্ট লাইনেই সিমাবদ্ধ যেখানে বিশ্বের অন্য কোন স্থান থেকে প্রবেশ করা যাবেনা।
তাই বলা যায় নিজেস্ব ভাবে হইয়তো আপনি চাইলে সার্ভার বানাতে পারবেন তবে ডাটা সেন্টার অনেকটাই ব্যায়বহুল।
মজার বিষয় হচ্ছে খোদ ফেসবুক তাদের ডাটা সেন্টাররের চাপ কমানোর জন্য অ্যামাজোন সাইট থেকে সার্ভার ভাড়া নিয়ে চলে। সে ক্ষেত্রে আপনি যদি ভাবেন নিজেস্ব ডাটা সেন্টারের কথা তাহলে সেটি নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশের ডাটা সেন্টার
কয়েক বছর পূর্বে গাজীপুরের সাত একর যায়গার উপরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ব্যায় নির্মান করা হয়েছিল ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার। যা নির্মানের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন চীন সরকার।
বলা হয় বাংলাদেশের বেশির ভাগ সরকারীর এবং ব্যাসরকারী অফিসের ডাটা এখানে সংরক্ষিত করা রয়েছে।
এটি বিশ্বের ৭ম টায়ার -৪ ডাটা সেন্টার।
টায়ার ৪ ডাটা সেন্টার হল সবথেকে নিরাপদ মিশন ক্রিটিকাল কম্পিউটার সিস্টেম এবং রিডান্ডেন্ট সাবসিস্টেম যার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ন তথ্য গুলি সংরক্ষন করা হয়।
ডাটা সেন্টারটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংরক্ষণ, ব্যাকআপ, রিকভারি, ডাটা সিকিউরিটি, ডাটা শেয়ারিং, ই-গভর্নেন্স, ই-সার্ভিস, কোলোকেশন সার্ভিস ও ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কাজে ব্যবহার করা যাবে।
কোন বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটার মাধ্যমে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হারিয়ে যেতে পারে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে ধরুন একটি ব্যাংকের লক্ষাধিক কাস্টমারের একাউন্টস এবং অন্যান্য অসংখ্য তথ্য থাকে।
এই তথ্যগুলিকে ব্যাকাপ রাখতে হয়। কোন কারনে যদি ব্যাংকের যাবতীয় তথ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে এই ব্যাকাপ তথ্য থেকে পুরটায় ফিরিয়ে আনা যায়।
আবার ধরুন জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সারাদেশের সকল জনগণের নাম, ঠিকানা, ছবি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট সহ নানা স্পর্ষকাতর তথ্য নিরাপদে রাখতে হবে। এর জন্য দরকার ডাট সেন্টার।
আর বিশ্বের সর্বাধুনিক টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার এখন বাংলাদেশে। গাজিপুরে নির্মিত হয়েছে এটি।
২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে টেস্ট রানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশের টায়ার ৪ ডাটা সেন্টারের।
এর ক্ষমতা ২ পেটাবাইট। এক পেটাবাইট প্রায় ১০ লক্ষ গিগাবাইটের সমান। সেই হিসাবে এই সেন্টারের বর্তমান ক্ষমতা ২০ লক্ষ গিগাবাইট।
শুধু তাই নয়। ভবিষ্যতে এর ক্ষমতা ৫০ পেটাবাইট পর্যন্ত বাড়ানো হবে।
একটি দেশের নাগরিকদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ন্যাশনাল আইডির তথ্য সহ মহা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলি সংরক্ষনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এই ডাটা সেন্টার।
বর্তমানে বাংলাদেশের টায়ার ৩ একটি ডাটা সেন্টার রয়েছে যার ক্ষমতা প্রায় সম্পূর্ণ ব্যাবহার করা হয়ে গেছে।
মিলিটারি গ্রেডের টায়ার ৪ ডাটা সেন্টার বিশ্বের তথ্য সংরক্ষণের জন্য সব থেকে নিরাপদ।
চীনের শেনঝেন ভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জেডটিই করপোরেশনের দায়িত্বে নির্মিত হয়েছে পার্ক ও ভবন, ডাটা সেন্টার ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিসিপিআই), আইটি সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার এবং ফোর টায়ার ডাটা সেন্টারের ওঅ্যান্ডএম সার্ভিস।
বাংলাদেশের প্রথম টায়ার ফোর ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার নির্মাণের সফলতার জন্য সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ‘ডিসিডি এশিয়া প্যাসিফিক অ্যাওয়্যার্ডস ২০১৯’ – এ টিম অব দ্য ইয়ার পুরস্কার পেয়েছে জেডটিই করপোরেশন।
এ প্রকল্পের মূল অংশ হিসেবে ডিসিপিআই নকশা ও নির্মাণ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আপটাইম ইনস্টিটিউটের টায়ার ফোর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যার রিল্যায়াবিল্যাটি লেভেল হবে ৯৯.৯৯৫ শতাংশ পর্যন্ত।
তথ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে ডাটা সেন্টারটি নির্মাণ করা রয়েছে অত্যাধুনিক শক-প্রুফ, ফ্লাড-প্রুফ এবং এক্সপ্লোশন-প্রুফ ডিজাইনে।
এ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন বিশ্বসেরা পণ্য ও সেবাদানে জেডটিইর সক্ষমতারই প্রমাণস্বরূপ।
আপটাইম ইনস্টিটিউটের টায়ার ফোর সনদপ্রাপ্ত এ ডাটা সেন্টারটি মিশন ক্রিটিক্যাল অপারেশনে সহায়তা প্রদানে সর্বোচ্চ পরিমাণে অ্যাভেইলাবিলিটি ও রিসাইলেন্স রয়েছে।
এটা দেশের প্রথম জাতীয় ডাটা সেন্টার যার আপটাইম টায়ার ফোর ডিজাইন সার্টিফিকেশন ও ফ্যাসিলিটি সার্টিফিকেশন রয়েছে।
এবং এ ডাটা সেন্টার আপটাইম টায়ার ফোর ফ্যাসিলিটি সার্টিফিকেশন পাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ডাটা সেন্টার এবং বিশ্বের সপ্তম টায়ার ফোর ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার।
এই পুরো প্রকল্প ১৫১৬ কোটি টাকা ব্যায়ে তৈরি করেছে। ডিজিটাল দুনিয়ায় এটা বাংলাদেশের বলিষ্ঠ পদার্পণ বলা যায়।
সরকারি অর্থে ও চীনের কারিগরি সহায়তায় নির্মিত ডাটা সেন্টারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। সেসময় প্রধানমন্ত্রী এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং এটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
২০১৮ সালের জুন মাসে এর কাজ শেষ করার মেয়াদ ধরা হলেও তা কিছুটা সময় পিছিয়ে শেষ হয়। আর ২৮ নভেম্বর, ২০১৯ থেকে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে ।
দেশে স্থাপন করা জাতীয় ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার থেকে বছরে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অনেক অর্থ সাশ্রয় হবে বলেও বলা হয়েছে।
রেফারেন্স:
- কমজগত
- ইত্তেফাক
- কিউরিয়াস ওয়ার্ল্ড
- Wikipedia