জোর কূটনৈতিক চেষ্টা, বায়োডাইভার্সিটি ও জলবায়ু ঝুঁকির ব্যাকগ্রাউন্ডে ভারতকে পর্যাপ্ত ও বিশদ চ্যালেঞ্জ না করে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নালিশ কিংবা সালিশে না গিয়ে তিস্তায় পানি আসবে না তাই বিকল্প অবকাঠামো পরিকল্পনা করার বা তা নিয়ে একমুখী কিছু ভাবার চিন্তায় সমস্যা আছে।

ভারত জল দিবে না, ধরেই ডেল্টা পরিকল্পনা, পানি পরিকাঠামোর নকশা করা যায়, কিন্তু মৌলিক সমস্যা হচ্ছে এতে করে অন্য যে নদীগুলোতে শুকনো মৌসুমে যৎসামান্য জল আসে তাও বন্ধ হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। ভারত ধরেই নিবে বাংলাদেশকে পানি না দিলেও চলবে। তাই বলি- বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী।

আন্তর্জাতিক নদীর জলবন্টন নিয়ে ভারতকে চ্যালেঞ্জ করার ব্যাকগ্রান্ড তৈরিতে বাংলাদেশকে কিছু স্টেপে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন সাজাতে হবে। পানি প্রবাহ মেজারমেন্ট প্রসেস, রেকর্ড ডুকুমেন্টেশান উন্নত করতে হবে। সালিশি ভিত তৈরি করতে আন্তর্জাতিক নদীর পানির পরিমাপ, কম প্রবাহ, একেবারেই প্রত্যাহারকৃত প্রবাহের তথ্যের মানসম্পন্ন রেকর্ড, বাঁধ খুলা জনিত বন্যায় প্রতি বছর আর্থিক ক্ষতির তথ্য মানসম্পন্ন অডিট পূর্বক নিয়মিত চিঠি পাঠিয়ে যেতে হবে যৌথ নদী কমিশন, ভারতীয় পানি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এমনকি তা কোন কাজে না আসলেও। এসবের রেফারেন্স পরবর্তিতে আন্তর্জাতিক সালিশি কাজে আসবে।

ক। বাংলদেশের উচিৎ “কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি” ফোরামে নালিশ করা। ভারত যে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে ক্রমাগত স্যালাইন পেনিট্রেশন করে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র নষ্ট করছে, বাংলাদেশ ডেল্টায় স্বাদু পানির মাছের আবাসস্থল নষ্ট করছে, একতরফাভাবে বন্যার পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের বন্যা তৈরি করে, প্রাণ ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ তৈরি করে, ক্রমাগত ফ্ল্যাশ ফ্লাডে বনের গাছ এবং পশুর আবাসন নষ্ট করে, কৃষির ফসল ভাসিয়ে দেয়, বাণিজ্যিক মৎস্য চাষ বাঁধাগ্রস্ত করে,কিংবা নদী সিল্টেড আপ করে ফেলে এইসব ক্রিটিক্যাল ব্যাপারকে অত্যন্ত ডকুমেন্টেড ওয়েতে উপস্থাপনা করতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পরিবেশ ফোরামে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

খ। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশন, রামসার কনভেনশন, ইন্টারন্যাশনাল ওয়েট ল্যান্ড কনভেনশন। এসব কনভেনশনের আলোকে কিছু ফোরাম রয়েছে , আছে কিছু চুক্তি ও অঙ্গীকার। এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নদী ও নদীর পানি নিয়ে আরগুমেন্টগুলো করা সম্ভব।

গ। বায়োডাইভারসিটি কনভেনশনের যে ফোরাম রয়েছে, সেখানে বলা সম্ভব যে ভারত পানি প্রত্যাহার করছে বলে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বলতে পারে, ভারত পানি প্রত্যাহার করার কারণে আমাদের যে বিশ্বঐতিহ্য রয়েছে, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ঘ। রামসার কনভেনশনে বাংলাদেশ বলতে পারে, ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করার কারণে দেশের ওয়েটল্যান্ডগুলোর ওপর এর প্রভাব পড়ছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ ফোরামগুলোর কাছে এগুলো অবশ্যই তুলে ধরা যেতে পারে।

ক্রমান্বয়ে এই কাজ গুলো কয়েক বছর ধরে করলে কিছু ফল আসবে, অন্তত ভারতীয় প্রশাসনে কিছু সচেতনতা আসবে। একেবারেই ফল না এলে এইসব করেস্পন্ডেন্সের আলোকে পানি হিস্যার দাবী নিজে জাতিসংঘে যাবার লিখিত ইঙ্গিত দিয়ে যৌথ নদী কমিশনের গুরুত্ব ফিরানোর স্ট্রাটেজি নিতে পারে।

এতে চূড়ান্তভাবে জাতিসংঘে পানি বিষয়ক নালিশ করতে বাংলাদেশের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি হবে।

ঙ। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে পানির অধিকারের জন্য ক্রমাগত নাগরিক আন্দোলনের উপস্থিতিও ভারতকে ভাবিয়ে তুলবে, যেমনটা তুলেছে নেপালের সামাজিক আন্দোলন গুলো।

পর্যাপ্ত কূটনৈতিক ও সালিশি তৎপরতা না চালিয়ে, সামাজিক আন্দোলনের ভিত তৈরি না করে ভারতের কাছ থেকে প্রাপ্য পানির হিস্যাটা ছেড়ে দেওয়ার জনমনস্তত্ব তৈরীর প্রকল্প অগ্রহণযোগ্য। তবে একটা দীর্ঘ্য লড়াইয়ের পরে সম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে পরাজিত হলে পরে বিকল্প অবকাঠামো নিয়ে ভাবার যৌক্তিকতা আসবে, সেটা অনেক পরের বিষয়। কিন্তু বাাংলাদেশ তো সাধারণ পানি চাহিদাটাই জানাচ্ছে না স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কের অভিমানে!

আজকে ডিফেন্স রিসার্চ ফোরাম থেকে ছড়ানো চায়নার তৈরি করা এক অতিরঞ্জিত টাইপের ভিডিও দিয়ে ভারতকে ক্ষেপানো হচ্ছে বলে মনে হয়! অথবা এটাও হতে পারে এমন কাজ ভারতকে অন্য দিকে ব্যস্ত রাখার চীনা কৌশল।

তিস্তার পাড় বাংলাদেশের সবচাইতে দরিদ্র এলাকা গুলার একটা। সেখানে ব্লক বাই ব্লক শিল্প হবে, হেন তেন হবে। কৌশলগত অবকাঠামোতে বন্যা পরিস্থিতি খুব খারাপ হতে পারে বলে, ভারতের মাথা নষ্ট বলেই মনে হচ্ছে!

তিস্তায় চীনা বিনিয়োগ ভারতকে চাপে ফেলার কৌশলও হতে পারতো! কিন্তু অবাক করার বিষয় আঞ্চলিক বিষয়াবলীতে ব্যাপক চাপে থাকার সময়ে ভারতীয় বিদেশ সচিব যখন বাংলাদেশকে কাছে পেতে উড়ে এসেছেন বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে, তখনও জলবন্টন এবং তিস্তার মত মৌলিক ইস্যুকে উঠানো হল না, এজেন্ডায়।

দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি এমন দাস সুলভ হীনমান্যতায় ভরে উঠে কিভাবে?

গত এক দশকে জেয়ারসি’র মিটিং হচ্ছে না।সর্বশেষ ২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকটি হয়েছিল। ওই বৈঠকেই তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ঐকমত্যে এসেছিল দুই দেশ। কিন্তু ওই চুক্তিটি আজও স্বাক্ষরিত হয়নি।

মমতার রাজ্য সরকারের আপত্তির ঠুনকো অযুহাতের নসিহত দিলেও আদতে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কারণে শুষ্ক মৌসুমে শত ভাগ পানি প্রত্যাহার করে তিস্তা নদীহত্যার সব আয়োজন সেরেছে খোদ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারই।

এই এক দশকে বাংলাদেশ সরকারও মুখ খুলে পানির অধিকার চায়নি তার রাজনৈতিক প্রভুর কাছে! এই হীনমান্য পানি ব্যবস্থাপনাকে ধিক্কার জানাই।

– ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
পুরকৌশলী