সেই গাছটাকে কি বাঁচানো গেলো ?
এক গ্রামে কাঁচা রাস্তার পাশে দুইশো বছরের পুরনো একটা বটগাছ আছে। সরকার শতকোটি টাকার প্রজেক্ট পাশ করেছে, সেখানে কংক্রিটের পাকা রাস্তা হবে। মটর চলবে এই পথে।
কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো গ্রামের কিছু লোক। বেশীরভাগই প্রবীণ।
তাঁদের স্মৃতির সাথে এই বটগাছ জড়িত। তাঁরা গাছ কেটে রাস্তা বানাতে চায় না। কিছু উটকো তরুণ দা কুড়াল নিয়ে রেডি। কাছ কেটে তারাই রাস্থা বানাবেই।
গাছ কাটতে এসে দেখে গ্রামের কিছু প্রবীণ গাছ আঁকড়ে ধরে আছে। তাঁদের কথা- গাছ কাটার আগে, আমাদের কেটে ফেলো। এক বুড়ো গামছা দিয়ে নিজের শরীর গাছের সাথে আটকে রেখেছে।
পরে কি গাছটি কাটা হয়েছিলো ? নাকি রাস্তার কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ?
এই অংশের কাছাকাছি জবাব পেয়েছি ইন্টারনেটে পাওয়া কিছু ছবি দেখে।
অনেক আগে দেখেছিলাম, দীর্ঘ একটি সোজা পথ এক জায়গায় বাঁকা হয়ে গেছে, যেখানে একটি গাছ। গাছের পর আবার রাস্তা সোজা হয়ে গেছে।
আজ খুঁজতে গিয়ে সেই ছবিটি পেলাম না, কিন্তু কাছাকাছি বিষয়ের কয়েকটি ছবি দেখেছি।
সামান্য কিছু গাছকে আমল দিতে গিয়ে সড়কের পথ বদল হয়েছে। সড়কও হয়েছে, গাছও থেকেছে।
এ কথাগুলো মনে হলো আমাদের টিএসসি নিয়ে সম্প্রতি বেশ কিছু কথাবার্তা দেখে।
বিষয়টা এমন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ হাজার ছাত্র-শিক্ষকের মিলনকেন্দ্র হিসাবে গ্রিক মাস্টার আর্কিটেক্ট কন্সতান্তিন এপোস্তলো দক্সিয়াদিস (ডক্সিয়াডিস নামে আমাদের কাছে পরিচিত। আমি তাঁর নাম প্রথম মুখস্ত করি ১৯৮৪ সালে, স্থাপত্যে ভর্তি পরীক্ষার আগে। জেনারেল নলেজ শাখায় বাংলাদেশের বিখ্যাত স্থাপনার স্থপতিদের নাম লিখতে চাওয়া হত। তাঁর ডিজাইনের টিএসসি বিখ্যাত স্থাপনা হিসাবে গাইড বইতে প্রথম পড়ি)
যে কমপ্লেক্সটি বানিয়েছিলেন তা পুরো ভেঙে নতুন করে বহুতল বিশিষ্ট নতুন ও আধুনিক ছাত্র-শিক্ষক মিলনকেন্দ্র বানানো হবে, যা ৪০ হাজার ছাত্রশিক্ষকের মিলনকেন্দ্রের চাহিদা মেটাবে।
এটা এভাবে করে ফেলার জন্য উন্মুখ কিছু বুদ্ধিজীবী ও সরকারি কর্তা আর তা বিরোধিতা করছেন আরো বেশি সংখ্যক মানুষ, তাঁদের অধিকাংশই স্থপতি ও পরিবেশবিদ।
পুরনো টিএসসি ভেঙ্গে ফেলার আগে কিছু কথা মনে করাতে চাই।
এই কমপ্লেক্সের ডিজাইনার একজন মাস্টার আর্কিটেক্ট। গেলো শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো ইসলামাবাদের মাস্টার প্ল্যান করার জন্য। তিনি রিও ডি জেনেরিওর মাস্টার প্ল্যানও করেছিলেন।
সেসময়ের পূর্বপাকিস্তানে তিনি গোটা চারেক কাজ করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র, কুমিল্লার বার্ড, হোম ইকোনমিক্স কলেজ, নায়েম – এই কমপ্লেক্সগুলো তিনি যখন ডিজাইন করেন, ষাটের দশকের প্রথম দিকে তখনও এই অঞ্চলে মাজহারুল ইসলাম ছাড়া কোন স্থপতির কাজে দেশীয় উপাদানের প্রয়োগ ঘটে নাই।
ঔপনিবেশিক স্থাপত্যধারা থেকে বেরিয়ে এসে এই দেশের মাটি, জলবায়ু, দেশীয় নির্মাণসামগ্রির সৎ-ব্যবহার তাঁর কাজের মধ্যে উঠে এসেছিল। তিনি বৃষ্টিবাদলের দেশের জন্য দিয়েছিলেন ঢালু ছাদ, দোচালা ঘরের কংক্রিটিয় রূপ।
যেখানে ইটের ব্যবহার করেছেন, তা প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে না দিয়ে ইট দেখিয়ে দিয়েছেন। কংক্রিটের বীম, কলাম কংক্রিটের রূপে থেকেছে। টিএসসির মিলনায়তনের বাইয়ের সবুজ চত্বরে ছাত্রছাত্রীরা আড্ডা দেবে, তার জায়গা রাখা।
করিডোরটাকে এমন প্রশস্থ করে রাখা যাতে সেটাও একটা আড্ডার জায়গা হতে পারে। আর মাঠ থেকে করিডোরের মেঝটাকে সেই উচ্চতায় রাখা যাতে এর প্রান্তটুকুও বসার জায়গা হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
এখন নাকি ভেঙ্গে ফেলা হবে এ জায়গাটি!
১২ তালা দালান হবে ছাত্র-শিক্ষক মিলনকেন্দ্র। ৪০ হাজার ছাত্রশিক্ষক বলে কথা।
কেন ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি জায়গার অভাব?
৪০ হাজার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যে আয়তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে, এমন আয়তন পৃথিবীর আর কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ? সেখানে কি এরকম একটি স্থাপনা রেখে দেবার নজির নাই ?
দেশে কি এই নিয়ে চিন্তা করার মতো স্থপতি বা পরিবেশবিদ নাই ?
সবাই কি সরকারি ?
আর সরকারকেই বা এই বুদ্ধি দিচ্ছেন কোন মোটাবুদ্ধির পরামর্শক ?
ঢাকা হচ্ছে দেশের বুক, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে হৃদপিণ্ড, টিএসসি হচ্ছে তার অলিন্দ-নিলয়। এর সাথে সকল নাগরিকেরই আত্মার সম্পর্ক। এমন একটা অতিস্পর্শকাতর স্থাপনার নির্মানের আগে আরো বেশি ভাবার দরকার আছে।
শাহবাগ থেকে টিএসসি হয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত যে জায়গাটুকু আছে তার মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য একটা আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত নকশা-প্রতিযোগিতা ডাকা হতে পারে।
দেশ-বিদেশের স্থপতিরা সম্মিলিত ভাবে অংশগ্রহণ করে প্রস্তাবিত প্রকল্পের মডেল উপস্থাপনা করবেন। তা ১৫ দিনের জন্য রেখে দেয়া হবে জাতীয় যাদুঘরের প্রদর্শণশালায়। সর্বশ্রেণির নাগরিকেরা প্রত্যক্ষ করে মতামত দেবেন।
ডিজাইনাররা উন্মুক্ত মিলনায়তনে তাঁদের ধারনা উপস্থাপন করবেন। এর পরে যথাযথ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্নদের নিয়ে গঠন করা কমিটির রায়ে নির্বাচিত হবে যথাযথ ডিজাইন।
সেখানেই নির্ধারিত হয়ে যাবে ডক্সিয়াডিসের নকশায় করা টিএসসির ভাগ্য। আর ঢাকার নাগরিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ হাজার ছাত্রশিক্ষক পাবেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উপহার, পুরনোদের কাছে ফিরে যাবে তাঁদের সোনালী সময়ের স্মৃতি।
লেখকঃ শাকুর মাজিদ
চলচিত্র নির্মাতা