পুরো টার্কিতে মোট প্রদেশ আছে ৮১টা। প্রতিটি প্রদেশে আছে অসংখ্য শহর। পুরো টার্কি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনে ৫-৬ গুণ বড়।

প্রতিটি শহরে অন্তত ১টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কোনো শহরে আবার ৫-৭ টা বা তারও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

একই ভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি কমপক্ষে ২টি, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ৪-৫টি বা তারও বেশি গভর্নমেন্ট স্টুডেন্ট ডরমিটরি আছে।

ডরমিটরিগুলো প্রতিটি ইউনিভার্সিটির নিকটে বা ইউনিভার্সিটির সীমানার মধ্যে অবস্থিত। গভর্নমেন্ট ডরমিটরিগুলোর সাথে য়্যুনিভার্সিটির প্রশাসনিক কোনো সম্পর্ক নেই।

য়্যুনিভার্সিটি য়্যুনিভার্সিটির জায়গায়, আর পুরো দেশের ডরমিটরিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় কেন্দ্রীয় ভাবে।

যে সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করে সে সংস্থার তার্কিশ নামকে সংক্ষেপে KYK– কায়েকা বলা হয়। ইংরেজিতে পূর্ণরুপ Higher Education Student Loan and Housing Board।

২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনের তথ্যমতে পুরো টার্কিতে গভর্নমেন্ট ডরমিটরি আছে ৭৫৮ টি, যদিও প্রতিবছর এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সবগুলো ডরমিটরি সরকারি এই সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। ডর্মগুলো থেকে ছাত্রদেরকে রেজাল্ট ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য অনুসারে কায়েকা বৃত্তি ও লোন দেয়া হয়।

তাছাড়া প্রতিটি ডরমিটরিতে অসংখ্য সেলফ ডেভেলাপমেন্ট কোর্স থেকে শুরু করে ছাত্রদের নানা সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়ার সুযোগ আছে।

আমি যখন বছরের শুরুতে আমার ডর্মে নতুন আসি, গুণে গুণে ৩২টা ভিন্ন ভিন্ন কোর্স অফার করা হয়েছিল আমাদেরকে।

এর মধ্যে ভায়োলিন বাজানো শেখা থেকে শুরু করে হ্যান্ডিক্রাফট, ক্যালিওগ্রাফি, ক্যারাতে, জার্মান ভাষা শিক্ষা কোর্স সবই ছিল। প্রতিটি কোর্সে ৫-৬ জন ছাত্র হলেই সেটা শুরু করা হত।

এবং প্রতিটি কোর্সই একদম ফ্রি! ডরমিটরিতে সিট নেয়ার পরপরই প্রত্যেককে একটি করে আইডি কার্ড দেয়া হয়, আর ডর্মে ওঠার সময় ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নেওয়া হয়।

যেটা জমা থাকে হেডকোয়ার্টারের ডেটাবেজে। ডর্ম থেকে বের হওয়ার সময়, ঢোকার সময় সবসময় ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রেস করে ঢুকতে হয়। খাবার নেয়ার সময়ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রেস করে খাবার নিতে হয়।

আর এ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাদের অনলাইন ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন সিস্টেমের মাধ্যমে। তারপর কায়েকা থেকে বাহিরে গিয়ে রাত যাপনের জন্য আপনাকে ছুটি নিতে হবে।

আর আপনি চাইলেই এই ছুটি ইন্টারনেট থেকে নিয়ে নিতে পারবেন।

তারজন্য আপনার কায়েকার ওয়েবসাইটে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। আর রাত যাপন করতে না চাইলে ছুটি নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

সাধারণত রাত ১১টার ভিতরে কায়েকায় প্রবেশ করার নিয়ম। আর ছুটি নিয়ে বাহিরে গেলে যখন তখন প্রবেশ করতে পারবেন।

তবে সবথেকে মজার ব্যাপার হলো, আপনি যদি পুরো টার্কির কোনো একটা কায়েকা বা গভর্নমেন্ট ডর্মে সিট পান, তাহলে পুরো টার্কি আপনার জন্য গেস্ট হাউসে পরিণত হবে। ব্যাপারটা আরেকটু ভেঙে বলি।

এখন আপনার যেকোনো একটা কায়েকার আইডি কার্ড থাকলে আপনি অন্য যেকোনো শহরের কায়েকাতে গিয়ে সেটা দেখালেই আপনি সেই কায়েকাতে সর্বোচ্চ ২ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত গেস্ট হিসেবে থাকতে পারবেন।

এভাবে করে যেকোনো শহরের যেকোনো কায়েকাতে গিয়ে সুবিধামত থাকতে পারবেন।

যাওয়ার আগে উক্ত কায়েকা কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ফোন দিয়ে জানিয়ে যেতে হবে।

আপনি যাওয়ার সাথে সাথে ১ দিনের জন্য থাকলেও আপনাকে নতুন বেড কাভার, বালিশ কাভার এবং ব্লানকেট কাভার দিয়ে একটি সিট দেয়া হবে। ডরমিটরির ক্যান্টিনে খাবেন অ্যাজ ইউজুয়াল আপনি আপনার ডর্মে যেভাবে খেতেন।

সবকিছু আপনার ডর্মের মতই। তবে খাবারের পুরো টাকাটা আপনাকে পরিশোধ করতে হবে। স্কলারশিপের আওতায় বিনামূল্যে খাবার শুধু আপনি আপনার ডর্মেই পাবেন।

অন্য ডর্মগুলোতে গেলে আবাসন ফ্রি কিন্তু খাবার ফ্রি নয়। এই নিয়ম না করলে এক শহরের ছাত্ররা অন্য শহরের কায়েকাতে গিয়ে যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে। যেটি আবার বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে।

সাধারণত ডর্মগুলোতে দুই বেলার খাবার দেয়া হয়। সকালের এবং রাতের। দুপুরের খাবার সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন থেকে খেতে হয়।

কায়েকাতে থাকার জন্য আবেদন করতে হয়। যেকোনো ছাত্র কায়েকাতে থাকার জন্য আবেদন করতে পারে।

কায়েকাতে থাকার খরচ খুব সামান্য। কায়েকাভেদে খরচও সামান্য ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে সর্বনিন্ম খরচ হলো মাসিক ২৮৫ লিরা এবং সর্বোচ্চ খরচ হলো ৩৪০-৫০ লিরা।

অর্থাৎ, বাংলাদেশি টাকায় ৩৫০০ টাকা থেকে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে কায়েকাতে ১ মাস থাকার জন্য। যা সার্বিক দিক বিবেচনায় খুবই অল্প টাকা।

বিশেষত Turkey এর মত একটি OCD কান্ট্রিতে সরকারি ডর্মের খরচ হিসেবে খরচটা নিতান্তই কম। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেও খরচটা খুবই অল্প।

বহির্বিশ্বে পড়তে ইচ্ছুক যেকারো পক্ষেই এই খরচ বহন করা সম্ভব। তবে যারা স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করে কিংবা কায়েকার পক্ষ থেকে স্কলারশিপ পায় তাদেরকে কায়েকা কর্তৃপক্ষকে কোনো প্রকার টাকা পরিশোধ করতে হয় না।

প্রতিটি কায়েকাতে গেস্ট স্টুডেন্টদের জন্য সবসময় নির্দিষ্ট কিছু সিট বরাদ্দ থাকে। আর প্রতিটি কায়েকার পরিবেশ, ব্যবস্থাপনা এটার কথা নাইবা বললাম।

তবে শহরভেদে কায়েকাগুলোর কিছু কিছু বিষয় আলাদা হয়। যেমন রুমের আয়তন, লোক সংখ্যা ইত্যাদি।

মেট্রোপলিটন শহরগুলোর কায়েকাগুলোতে স্পেস সাধারণত একটু কম থাকে। বাকিগুলোর পরিবেশ এক কথায় অসাধারণ।

প্রতিটি রুমে ১টি ফ্রিজ, খাট, পড়ার জন্য আলাদা টেবিল, চেয়ার ও জিনিসপত্র রাখার জন্য বড় লকার, প্রতিটি রুমের জন্য একটি অ্যাটেস্টেড বাথরুম, কায়েকাতে যদি একের অধিক বিল্ডিং বা ব্লক থাকে তাহলে প্রতিটি বিল্ডিং এ একটি করে মসজিদ, পুরো কায়েকাতে একটি বড় কনফারেন্স রুম, স্পোর্টস রুম, আলাদা ডাইনিং হল এবং সকলের জন্য ফ্রি ওয়াইফাই এগুলো হলো প্রতিটি কায়েকার কমন বৈশিষ্ট্য।

এর বাহিরেও অনেক সময় অনেক কায়েকাতে আরও বেশি কিছু থাকতে পারে।

চার বিছানার একটা রুম

সাধারণত দুই ধরণের রুম থাকে প্রতিটি কায়েকাতে। ৪ ও ২ সিট বিশিষ্ট রুম। ৪ সিটের রুমগুলোতে ব্যাচেলর্স ও মাস্টার্সের ছাত্ররা এবং দুই সিটের রুমগুলো শুধু পিএইচডি স্টুডেন্টদের জন্য বরাদ্দ থাকে।

কায়েকার ওয়াইফাই ব্যবস্থাও কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আপনি আপনার কায়েকার ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড দিয়ে সারা দেশের সবগুলো কায়েকার ওয়াইফাই ব্যবহার করতে পারবেন।

আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া প্রতিটি ডরমিটরিই একেবারে ছাত্র রাজনীতি ও Ragging মুক্ত।

রুম ও পুরো ডর্ম পরিস্কারের জন্য সর্বদা লোক নিয়োজিত আছে।

প্রতিদিন সকালে অথবা ১-২ দিন পর পর সকালে এসে আপনার রুম, বাথরুম সবকিছু পরিস্কার করে দিয়ে যাবে।

কাপড়-চোপড় পরিস্কারের জন্য প্রতিটি ডরমিটরিতে থাকে আলাদা রুম। যেখানে অসংখ্য ওয়াশিং মেশিনে সকল ছাত্রের ময়লা কাপড় পরিস্কার করে শুকিয়ে দেয়া হয়। তাও আবার একেবারে বিনামূল্যে! শুধু কাপড় পরিস্কারের লিকুয়িড ডিটারজেন্ট আপনার দিতে হবে।

একটি ডর্মে একাধিক ব্লক থাকলে ভাগ করা থাকে, সপ্তাহে কোন দিন কোন ব্লকের কাপড় পরিস্কারের তারিখ।

দুই নেড বিশিষ্ট পিএইচডি ছাত্রদের রুম

নির্ধারিত দিনে সকালে গেলে বিকাল বেলা পরিস্কার শুকনো কাপড় ফেরত পাবেন। দুপুর বেলা বা বিকাল টাইমে ময়লা কাপড় দিলে সেগুলো ফেরত পাবেন পরবর্তী দিন।

একটা দেশ শুধু Proper Management এবং সেটা Implement এর মাধ্যমে কতটা ছাত্র বান্ধব হতে পারে সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো টার্কি।

একজন য়্যুনিভার্সিটি ছাত্রের জন্য এই ধরণের সমন্বিত সিস্টেম কতটা মূল্যবান সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্য কোনো শহরে গিয়ে হোটেল ভাড়া করা বা অন্য কারো বাসায় থাকার কোনো ঝামেলা নেই।

সবাই স্বাধীন ভাবে যেখানে খুশি সেখানে চলাচল করতে পারে। এ থেকে আমাদের বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনেক কিছু শেখার আছে।

বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্র রাজনীতি বিদায় করা ও Ragging এবং গণরুমের মত অসুস্থ-অমানবিক সংস্কৃতি বিদায় করে পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবী।

শীতকালে আমার ডরমেটরির একাংশ

সর্বশেষ আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও উপসংহার হলো, এরকম সুন্দর সমন্বিত আবাসন ব্যবস্থা একটি দেশের ছাত্রদের আবাসন জনিত সকল সমস্যার সমাধান করে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সাহায্য করে।

যেখানে ছাত্রদের পড়াশোনার কাজ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সকল কাজে অন্য কোনো শহরে গিয়ে আবাসন নিয়ে কারো কোনো প্রকার চিন্তা করতে হচ্ছে না।

যা তাদেরকে পড়াশোনার প্রতি আরও মনোযোগী করে তুলবে।

লেখক: নাঈম মুছা।