আজ থেকে ২০ কিংবা ২৫ বছর আগে শিক্ষকের লেকচার শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত শিক্ষার্থীরা। কখন আসবে প্রিয় শিক্ষক?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বর্তমান উপস্থিতির হার শিক্ষকদের অনেকাংশে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত করে। প্রত্যেক শিক্ষক চাই তাঁর ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রিরা পরিপুর্ণ থাকুক এবং মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করুক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে শতভাগের মাত্র পঞ্চাশ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী ক্লাসে উপস্থিত থাকে এবং এই পঞ্চাশ ভাগের মাত্র দশ ভাগ ছাত্র-ছত্রী মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে।

বাকীরা ক্লাসে আসে শুধুমাত্র উপস্থিতি নেওয়ার জন্য। যদিও প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একজন ছাত্রের ক্লাসে উপস্থিতির হার ৭০ শতাংশ না হলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি নেই। তারপরও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যাচ্ছে না।

“শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে আসে না” এমন শিরোনামে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইতিহাস ও প্রাণ রসায়ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক মিলে একটি কলাম লিখেছিলেন দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায়।

কলামে তাঁরা শিক্ষার্থীদের মতামত গুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং শিক্ষার্থীদের জায়গা থেকে মতামতগুলোকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য মন্তব্যগুলো হুচ্ছে অনাকর্ষণীয় ক্লাস লেকচার, পাওয়ার পয়েন্টের ক্লাস( ডিজিটাল ফাঁকিবাজি), ফেসবুক,ইউটিউব,নেটফ্লিক্স এর প্রতি শিক্ষার্থীদের আসক্তি এবং সর্বশেষ চাকরির পড়াশোনা।

তবে শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে যায় না এর অন্যতম কিছু কারণগুলো তাঁরা তুলে ধরেননি যা শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

শিক্ষার্থীদের ক্লাসে না যাওয়ার প্রথম কারণ হচ্ছে সঠিক সময়ে ক্লাসে শিক্ষকের অনুপস্থিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক এই মহামারী রোগে আক্রান্ত। এটি খুবই সাধারণ একটি বিষয় মনে হলেও শিক্ষার্থীদের ক্লাসে না যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো এই মহামারী রোগ।

কোন এক শিক্ষক বললেন আগামীকাল সকাল নয়টা তিরিশে আমি তোমাদের ক্লাস নেবো। ছাত্র-ছাত্রীরা রীতিমতো ক্লাসে উপস্থিত হলো। কিন্তু ক্লাসে এসে দেখে স্যার ততখনে আসে নাই। মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে স্যার বলে আমি এখনি আসছি। স্যার দশটা পাঁচে ডিপার্টমেন্টে ঢুকলেন ।

ছাত্র-ছাত্রীরা ভাবলেন এবার বুঝি স্যার ক্লাসে ঢুকবে। কিন্তু না স্যার মিটিং এর জন্য অফিসে ঢুকে পড়লেন, বললেন মিটিং এর পর এগারটায় ক্লাস নেবো। তা শোনে কিছু ছাত্র-ছাত্রী বেরিয়ে পড়লেন কেউবা নাস্তা করার জন্য, কেউবা ব্যক্তিগত কাজের জন্য। আবার এগারটায় সব শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত। এগারটা তিরিশ বাজে তারপরও স্যারের মিটিং শেষ হয়নি।

ঠিক এগারটা পঁয়তাল্লিশে অফিস থেকে বের হয়ে স্যার বললেন বারটায় সিনেটে একটা সেমিনার আছে, আমি একটা তিরিশে ক্লাস নিবো। ঠিক একটা তিরিশে স্যার জানিয়ে দিলেন আমি আসতে পারছিনা দুইটা তিরিশে ক্লাসে নেবো। স্যার দুইটা পঁয়তাল্লিশে ক্লাসে ঢুকলেন, এসে দেখে মাত্র পয়ত্রিশ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত আছে।

বিস্ময়কর হচ্ছে এই পয়ত্রিশ শতাংশ সিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখে স্যার/ম্যাডাম উপস্থিতরত শিক্ষার্থীদের আচ্ছামত বকা দিলেন। কারণ স্যার ক্লাস নিবেন বলেও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত ছিল না। এভাবে একদিন, দুইদিন,তিনদিন, চারদিনের মাথায় স্যার যদি বলে দশটায় ক্লাস নিবো তাহলে শিক্ষার্থীরা দশটা তিরিশে ক্লাসে আসে। তখনও শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ক্লাসে পান না।

এভাবে ১ম বর্ষ, ২য় বর্ষ পার হয়ে যায়। ৩য় বর্ষে এসে একজন শিক্ষার্থী বুঝতে পারে কোন শিক্ষক ক্লাস নিবেন আর কোন শিক্ষক ক্লাস নিবেন না। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বুঝতে শিখে ক্লাস না করলেও পরীক্ষা দেওয়া যায়। ফলে ষাট শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী আর ক্লাস করেন না।

ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে শিক্ষার্থীরা পারসিভ( Perssive) করতে থাকে সময় গুরুত্বহীন যা তাদের কর্মজীবনে বিরাট একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একজন শিক্ষক যদি বেঞ্চভর্তি ছাত্র-ছাত্রির উপস্থিতি দেখতে চাই তবে সেটা সম্ভব। যখন ৪র্থ বর্ষে পড়ি তখন এক ম্যাডাম সঠিক সময়ের এক মিনিট পড়ে কোন শিক্ষার্থী ক্লাসে ঢুকলে তাকে উপস্থিতি দিতেন না আর পাঁচ মিনিট পড়ে ক্লাসে ঢুকতে দিতেন না।

ম্যাডামের ক্লাসে নব্বই শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকতো। যদিওবা বেঞ্চ ভর্তি শিক্ষার্থী না পাওয়ার পিছনে শিক্ষকেরা বরাবরই শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করে থাকেন।

শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন, আর শিক্ষার্থীরা মনোযোগ সহকারে তা শুনছে এবং তা খাতায় তুলে নিচ্ছে, আলোচনার বিষয় “International Politics”। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। স্যার ফোনটা রিসিভ করেই কথা বলতে লাগলেন জোরে জোরে দীর্ঘ পনের মিনিট। ফোনটা রেখেই আলোচনার বিষয় “International Politics” পরিবর্তে একই ডিপার্টমেন্টেরই শিক্ষক ড. জেফরি বেগ (ছদ্দ নাম)।

স্যার সম্পর্কে অজানা বিষয় জেনে শিক্ষার্থীরা কখনো হাসসে আবার কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলছে এই ভেবে, কিভাবে স্যার কাজটা করতে পারলেন, তাঁকে তো আমি অনেক শ্রদ্ধা করতাম । (বলে রাখা ভাল বিষয়টি খুবই সামান্য ছিল যা শিক্ষার্থীদের অজানা, কিন্তু তাঁর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল নয় বলে বিষয়টিকে এমন ভাবে উপস্থাপণ করা হয়েছে যার ফলে শিক্ষার্থীরা তাঁকে দুশ্চরিত্র বলে ধারণা করছে)।

পবর্তীতে ড. জেফরি বেগ স্যার যখনই ক্লাসে ঢুকেন তখনই তার অনৈতিক কথাগুলো মনে পড়ে ফলে আস্তে আস্তে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ উঠে যায়। তাঁর ক্লাসের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হতে থাকে, শেষমেশ তাঁর ক্লাসে আর করি না। আবার ড. জেফরি বেগ স্যারও ক্লাসে অন্য কোন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সামনে দুশ্চরিত্র বলে মন্তব্য করে। এভাবে একজন, দুজন, তিনজন করে সব শিক্ষকের সম্পর্কে অনৈতিক কথা শুনতে শুনতে কখন যে শিক্ষকের প্রতি সন্মান ও শ্রদ্ধাবোধ উঠে যায় তা কোন শিক্ষার্থীরই জানা নেই।

এই লেখাটি লেখার কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধু বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দীর্ঘ পাঁচ বছরে আমি আজও এমন কোন শিক্ষক পাইনি যাকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মেনে চলব।আমাদের ক্যাম্পাসে ৮০০-১১০০ জন শিক্ষকের মধ্যে শুধুমাত্র ২০-৩০ জন শিক্ষক পাবেন যাদেরকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করেছে( অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও এর ভিন্নতা নয়)।

অথচ একটি প্রাইমারি স্কুলে যেখানে ১০-২০ জন শিক্ষক থাকে সেখানে ২-৩ জন শিক্ষক থাকে যাঁদেরকে শিক্ষার্থিরা আদর্শ শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সন্মান করে শুধুমাত্র একটা ভীতি জায়গা থেকে, যদি স্যার ফেল করে দেই কিংবা যদি নাম্বার কম দেই ।আর একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর এই সম্পর্কও ক্লাসে না যাওয়ার পিছনে অন্যতম একটি কারণ।

আবার কোন কোন শিক্ষক ক্লাসে এতটাই খারাপ ভাষা ব্যবহার করে যা ঐ শিক্ষকের ক্লাস না করলে বোঝা যায় না। কোন কোন শিক্ষক যখন আরেকজন শিক্ষককে বদনাম করে কিংবা কোন শিক্ষার্থীকে বকা দেন তখন হারামজাদা, নির্লজ্জ, বেয়াদব এমনকি শূয়রের বাচ্চা মত শব্দ ব্যবহার করতে তাঁদের মুখে কিছুতেই বাঁধে না।

যা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখে বেমানান। শিক্ষকের এমন শব্দচয়ন একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষনকে অনেকাংশে বিব্রত করে ফেলে। ফলে সেই শিক্ষকের ক্লাসের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনীহা সৃষ্টি হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষকও পাওয়া যায় যাদেরকে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করলেই রেগে যায়। উল্টো ধমক দিয়ে তাকে বসিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে আর কখনো প্রশ্ন না করার জন্য সাবধান করে দেওয়া হয়। যা শিক্ষার্থীর মাঝে এক ধরণের ভীতি কাজ করে। এই ভীতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। একটা পর্যায়ে সে শিক্ষক ক্লাসে ঢুকলেই ঐ শিক্ষার্থী ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ে।

এছাড়াও শিক্ষকের ক্লাসের লেকচার ছাত্রদের কাছে আকর্ষণীয় নয়। কিছু কিছু শিক্ষক তাঁর ছাত্রত্তকালীন লেকচার শীট থেকে লাইন বাই লাইন পড়তে থাকেন এবং তা ছাত্রদের লিখে নিতে বলেন। আবার কিছু কিছু শিক্ষক বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ পরীক্ষার এক মাস আগে এসে বলবে কালকে তোমাদের এই এই বিষয়ে প্রেজেন্টেশন নিবো এবং এর জন্য ২৫ মার্ক বরাদ্দ।

অথচ এই বিষয়ে এর আগে তিনি কোন ক্লাস নেননি। যদি না পড়িয়ে প্রেজেন্টেশন কিংবা পরীক্ষা নেওয়া যায় তাহলে বেঞ্চ ভর্তি শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কিভাবে কামনা করেন। ডিজিটাল ফাঁকিবাজি যাকে পাওয়ার পয়েন্ট বলা হচ্ছে।

একটার স্লাইড বোঝার আগেই আরেকটি স্লাইড, এভাবে ক্রমাগত চলছে। দুতিনটা স্লাইড দেখানোর পর ক্লাস শেষ। আবার যেখানে পাওয়ার পয়েন্ট প্রয়োজন যেমন বিজ্ঞান অনুষদের ডিপার্টমেন্টগুলোতে সেখানে পাওয়ার পয়েন্ট ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়।

শিক্ষার্থীদের ক্লাসে না যাওয়ার পিছনে আর একটি কারণ হচ্ছে চাকরির পড়াশোনা। ৩য় বর্ষে পা দিতেই একজন শিক্ষার্থী বোঝে ফেলে ডিপার্টমেন্টের পড়া পড়ে তার ভাল চাকরি মেলবে না। তাই তার কাছে ক্লাস করার চেয়ে চাকরির পড়াশোনাটা বেশি গুরুত্বপুর্ণ হয়ে যায় যার ফলে সে আর আগের মত ক্লাস করে না।

এরকম একটা পরিস্থিতে আমাদের খুব গভীরভাবে ভাবতে হবে। এজন্য শিক্ষকদের অবদানটা একটু বেশি। কিভাবে পড়ালে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বাড়ানো যাবে সেদিকে নজর দিতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজনে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে । শিক্ষার্থীদের আগ্রহ এবং পছন্দের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

শিক্ষার্থীদেরও বুঝতে হবে জীবনকে আরও সুন্দর এবং রঙিন করার জন্য ক্লাস, শুধুমাত্র উপস্থিতির জন্য নয়। শিক্ষকদের ইতিবাচক প্রচেষ্টায় তরুণদের আবার ফিরিয়ে আনতে পারে ক্লাসরুমে। সময়ের দাবিতে আসুন আমরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে একটি বন্ধুত্বের সাঁকো নির্মাণ করি যেখানে থাকবে অফুরন্ত ভালবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ, সন্মান এবং ক্লাসরুম হয়ে উঠুক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মিলনমেলার জায়গা।

নানওয়াই মুরুং

শিক্ষার্থী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়