ফরিদপুর জেলা প্রশাসন আয়োজিত ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা ২০১৮ তে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সেরা উদ্ভাবকের পুরষ্কার অর্জন করেছে দেশের আধুনিকতম প্রকৌশল শিক্ষালয় ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সেইসাথে সরকারের সেবাগুলো মানুষের কাছে সহজে উপস্থাপন শাখায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে আরেক শিক্ষার্থী।
চালকবিহীন ও নিঃশব্দে চলা উড়োজাহাজের (ড্রোন) মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বোমা হামলার কথা শোনা যায়। কিন্তু তাকে কিভাবে ভালো কাজে ব্যবহার করা যায়, সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে একটা বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ শুরু করে দুটো টিম। যাদের একটি হল কোয়াডকপ্টার ও আরেকটি বিমান আকৃতির চালকবিহীন উড়োযান।
কোয়াডকপ্টার আসলে কী
কোয়াডকপ্টার মূলত একটি উড়ন্ত যান। কোয়াডকপ্টারটি চারটি ব্রাশলেস ডিসি মোটর ও প্রপেলার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি সাধারণ উড়োজাহাজের মতো ‘রোল’, ‘পিচ’ ও ‘ইও’ অক্ষ বরাবর চলতে পারে। চারটি মোটরের গতি পরিবর্তন করে এটি তিন অক্ষ বরাবর ঘোরানো যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় এটি যেকোনো একটি জায়গায় ভেসে থাকতে পারে। এ অবস্থাকে বলা হয় ‘হোভারিং’। চারটি মোটরের গতি পুরোপুরি সমান থাকলে পুরো ক্রাফটটি ভূমির সঙ্গে সমান্তরাল অবস্থায় থাকে।
এয়ারক্রাফটটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রয়েছে একটি আইএমইউ বোর্ড। এতে আছে থ্রি-এক্সিস জাইরো, এক্সেলরোমিটার ও ম্যাগনেটোমিটার। এক্সেলরোমিটারটি তিন অক্ষ বরাবর এয়ারক্রাফটটির এক্সিলারেশন সম্পর্কিত তথ্য মেইন প্রসেসরে পাঠায়। জাইরোস্কোপ সেন্সরটি তিন অক্ষ বরাবর কপ্টারটির হেলানো অবস্থা সম্পর্কে প্রসেসরে তথ্য পাঠায়। এ কারণেই কোয়াডকপ্টার একটি নিদিষ্ট অক্ষ বরাবর নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে স্থির থাকতে পারে।
রিয়েল টাইম ডাটা রিডিং এবং তা ব্যাখ্যা করার জন্য এতে ‘পিআইডি কন্ট্রোলার’ ব্যবহার করা হয়েছে। সফটওয়্যারটি তথ্য পর্যালোচনা করে কপ্টারটির অবস্থান বুঝতে পারে। সফটওয়্যার থেকেই প্রসেসরের মাধ্যমে মোটরগুলোকে সিগন্যাল পাঠানো হয়। মোটরগুলো প্রসেসরের পাঠানো নির্দেশানুযায়ী গতি পরিবর্তন করে। পুরো বিষয়টি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
যা দিয়ে তৈরি
কোয়াডকপ্টারটি তৈরিতে একাধারে প্ল্যাস্টিক, ০.৫ অ্যালুমিনিয়াম ও কার্বন ফাইবার বার ব্যবহার করা হয়েছে। চারটি ১২.৫ ইঞ্চি বার একটি আরেকটির সঙ্গে ৯০ ডিগ্রি কোণ করে বসানো হয়েছে। এ চারটি বারের মধ্যবিন্দুতেই কোয়াডকপ্টারটির ভারকেন্দ্র। এ ভারকেন্দ্র থেকে মোটর চারটি সমান দূরত্বে লম্বালম্বিভাবে বসানো হয়েছে। প্রপেলার এর দৈর্ঘ্য ১০ ইঞ্চি। এই অ্যালুমিনিয়াম শিট, ব্যাটারি ও ল্যান্ডিং গিয়ার, স্পিড কন্ট্রোলার, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, জিপিএস, থ্রি-এক্সিস এক্সেলরোমিটার, জাইরো প্রভৃতি ঢাকা থেকে আনতে হয়েছে। ফরিদপুরে এবস না থাকায় বেশ কয়েকবার ঢাকায় আসা যাওয়া করতেও তাদের বেগ পেতে হয়েছে। উন্নতমানের ব্যাটারি সংগ্রহ করতেই খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। এর মধ্যে ছিলো লিপলিমার ৩৫০০ ৩ সেল ক্লাস ৩০, ESE 400। ব্যবহার করা হয়েছে আরডুইনো চিপসেট। এতে বেশ কয়েকবার যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪০০ কেভি একেকটি মোটরের দাম ৮০০ টাকা করে ৪টি । ২০০ কেভি মোটর ৭০০ টাকা করে ৬ টি। থ্রি-এক্সিস এক্সেলরোমিটার ও জাইরো সংগ্রহ করতে খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। অন্যান্য খরচ তো আছেই। সব মিলে খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকার কিছু বেশি।
কোয়াডকপ্টারটি কোনো জায়গায় তাৎক্ষণিক ভিডিও ও ছবি পাঠাতে সক্ষম। এটিকে এক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পাঠিয়ে দূর-নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিতে সেখানকার বাস্তব অবস্থা জানা সম্ভব। কোনো অনুসন্ধানী কাজে যেমন_আগুন লাগা কোনো ভবনের কক্ষে কে, কী অবস্থায় আছে তা এ কোয়াডকপ্টারের সাহায্যে জানা যেতে পারে। পাশাপাশি ছবিও সংগ্রহ করা যেতে পারে। এই ড্রোনের মূল বৈশিষ্ট্য এটি যেকোনো ভীড়ের মধ্যকার মানুষের সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে এবং অপরিচিত কেউ আসলে সিগন্যাল দিতে পারবে। যা সিক্রেট মিটিং এ ব্যবহার উপযোগী। এছাড়া এটি সেন্সর ব্যবহার করে চলার পথের বাধা এড়িয়ে ভিন্ন পথে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবে।
এ কোয়াডকপ্টারটি নিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছে। এখন এ কোয়াডকপ্টার পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালানোর জন্য কাজ চলছে। এই পুরো প্রকল্পটি হয়েছে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব অণুপ্রেরণায়। সেইসাথে ছিলো সিভিল ডিপার্ট্মেন্ট এর অধ্যাপক মিজানুর রহমানের সার্বিক তত্বাবধান ও আর্থিক সহায়তা। নির্মাতা জানান এ ধরনের কাজে অনেক অর্থের প্রয়োজন। সেজন্য সরকারের উচিৎ এসব গবেষণা ধর্মী কাজে বেশী অণুদান দেয়া।
কলেজের শিক্ষক নাজমুল হাসান নির্মিত লাইন ফলোয়িং রোবট এর মূল কাজ হল মানুষের প্রবেশের অনুপযোগী স্থানে গিয়ে উদ্ধারকার্য সম্পাদন করা। এক্ষেত্রে কিছু নির্দেশা অনুযায়ী রোবটটি তার টাস্ক সম্পাদন করতে সক্কম।
এ বিষয়ে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন , নতুন কিছু করার ভাবনা থেকে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের ভাবনায় এই যুগোপযোগী প্রযুক্তিকে দেশীয় কাজে লাগানোর অনুপ্রেরণা থেকেই ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা এগিয়ে যাচ্ছে। খুব বেশী দূর নয়, যখন এই কলেজই হবে দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং জগতের নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিষ্ঠান । আমরা সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। এই প্রকল্পটি কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়নি। তবে ভবিষ্যতে আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক কাজে এমন প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বপ্ন দেখি।
দেশীয় বাজারের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করা কাঠামো এবং মাইক্রো কন্ট্রোলারের প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে এই কাজগুলোর সমাধান করা হয়েছে। আমাদের দেশে এখনও এই প্রযুক্তির চর্চা ও উন্নয়ন সেভাবে শুরু হয়নি। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে উদ্ভাবনের খরচ এবং যন্ত্রাংশের স্বল্পতা।
Civil Engineering Department, Faridpur Engineering College