সদ্য বুয়েটে সুযোগ পাওয়া সবাইকে অশেষ অভিনন্দন। অভিনন্দন অন্যদেরও। তাদের জন্য হয়তো অন্য কোথাও আরো ভালো কিছু আছে, আরো মানানসই কিছু। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় স্থান পেয়েছিলাম ১৬। ভর্তির রোল ছিলো ২৫২। তার আগে পড়েছি বগুড়া সরকারী শাহ সুলতান কলেজে। ১৯৯২এর উচ্চমাধ্যমিকে পেয়েছিলাম ৮৬১ নম্বর। মেধা তালিকার সর্বশেষ জনের নম্বর থেকে ২৫ কম। নিচের কাহিনী যথেষ্ট লম্বা। এক অতি নগন্য বালকের সেই সময়ের কিছুটা উচ্চাভিলাষ আর অতি আত্মবিশ্বাস আছে, সেই জন্য আগাম ক্ষমাপ্রার্থী।

ছোটবেলায় দেখতে গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সলিমুল্লাহ হল আর বুয়েটের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলাম। বাবা বলেছিলেন এইটা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি। এইখানে অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ে।

তাদের খুব একটা বাইরে দেখা যায় না। রাজনীতি বা খেলাধুলায় তারা নেই। তারা পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। উচ্চমাধ্যমিকের পদার্থের ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় ফজলুর রহমান স্যার বলেছিলেন তোমাদের মতো ছেলেদের বুয়েটে পড়া উচিৎ। কিন্তু বুয়েট কী? জানলাম বুয়েটই হলো সেই ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি।

ছোটবেলা থেকে গণিতে ভালো ছিলাম। ইচ্ছা ছিলো গণিত নিয়ে পড়বো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবার এক বন্ধু গণিত পড়তেন, সারাদিন খালি অংক করতেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হন। উচ্চ শিক্ষার্থে বাইরে যান।

সেই স্বপ্ন মনে গেঁথে গিয়েছিলো। মাঝখানে হঠাৎ করে বুয়েট, ইঞ্জিনিয়ারিং ঢুকে গেলো। মনে প্রচণ্ড দ্বিধা। তার ওপর মেধা তালিকায় সবাই দেখি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়। একদিকে আশৈশব লালিত গণিতের স্বপ্ন, আরেকদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং আর কম্পিউটারের ঝলকানি।

গা ঝাড়া দিয়ে ঠিক করলাম বুয়েটে পড়তে হবে। বাবা নিরুৎসাহিত করলেন। বললেন ওইখানে পড়লে তোমার চোখের চশমা আরো ভারি হয়ে যাবে।

তখন কথা বলতে পারতাম না তেমন। প্রতিবাদে কেবল কাঁদলাম। তিনি আর কিছু বললেন না। শুরু হলো আমার প্রস্তুতি নেওয়া।

বগুড়া শহরে গেলাম খোঁজ খবর করতে। জানলাম সবাই নানা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছে। চেনা জানা কেউ কেউ ঢাকা গিয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা হিসাব দিলো কোচিং ফী কতো, মাসে তাদের কত খরচ।

সেই সব আর্থিক হিসাব আমাদের সামর্থ্যের অনেক বাইরে। আমার পক্ষে কোনো কোচিং করা সম্ভব না। বগুড়ায়ও না, ঢাকায়ও না। তারপরেও একদিন বগুড়ার এক কোচিং সেণ্টারে গেলাম। একজন পড়াচ্ছিলেন।

মাত্র কয়েক মিনিটের ভেতরে আমি তার ভুল বের করলাম। তিনি আমাকে বাইরে নিয়ে এসে জামার ভেতর থেকে একটা খাতা বের করলেন। আমি বুঝলাম বগুড়ায় কোচিং করে কোনো লাভ নাই।

তাহলে উপায়? বইয়ের দোকানে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষার একটা গাইড কিনলাম। সে সময় বগুড়ায় কেবল কংক্রিট গাইড পাওয়া যেতো। কংক্রিট গাইডের লেখকদের ভেতরে একজন ছিলো এহতেশাম নেওয়াজ স্যার। তিনি তার সময়ে রাজশাহী বোর্ডে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়েছিলেন।

তিনি তখন বুয়েটে কম্পিউটার কৌশলের ছাত্র। তার নাম দেখে গাইড বইয়ের ওপর ভরসা হলো। কংক্রিট গাইড উল্টিয়ে পাল্টিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কীভাবে ভর্তি পরীক্ষা হয়, কী রকম প্রশ্ন আসে।

আমার মাথায় ঢুকে গেলো ৬০টি প্রশ্ন ১৮০ মিনিট সময়। প্রতিটি প্রশ্নে ৩ মিনিট। প্রস্তুতি নিতে হবে প্রতি প্রশ্নে ২ মিনিট ৩০ সেকেণ্ড ধরে। কিছু সময় বাঁচিয়ে কঠিন প্রশ্নে কাজে লাগাতে হবে। চিন্তা করলাম প্রশ্ন আসবে সব উচ্চমাধ্যমিকের বই থেকে।

হয়তো একটু ঘুরিয়ে দেবে, সংখ্যা বদলে দেবে। কোনো কিছু বাদ দেবো না। এমনিতেও আমার অভ্যাস বইয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার। সে সময় লোকে বেছে বেছে পড়তো। পদার্থে এবছর ৬ অধ্যায়, পরের বছর অন্য ৬ অধ্যায়। গণিতে লগ, সূচক, দ্বিপদী, বিন্যাস সমাবেশ এগুলো বাদ।

আমি সেখানে সব বইয়ের সব অধ্যায় আগেই পড়ে ফেলেছি। আমি অবশ্য কেবল সূত্র মুখস্থ করেই সারতাম না। ছোটবেলা থেকেই বদ অভ্যাস ছিলো প্রতিটি টপিকের মূলনীতি ধরে নিজে নিজে সূত্র বের করা। ভয় হতো সূত্র যদি ভুলে যাই তাহলে তো সব বরবাদ। কাজেই সূত্র বের করা জানতে হবে।

শুরু হলো আমার ব্যাপক লড়াই। পড়ার চেয়ার-টেবিলতো ছিলো না। বিছানায় শুয়ে-বসে সারাদিন পড়তে থাকি। কেবল খাওয়া-দাওয়া, গোসল, টয়লেট, ঘুমের সময় বাদ।

এভাবে কতদিন পার হয়েছে, হঠাৎ একদিন মনে হয়েছে অনেক দিন বাড়ির বাইরে যাইনা। একেকবার হিসাব করে দেখি ৩-৪ সপ্তাহ। তখন কেবল বাইরে গিয়ে একটু হাওয়া খেয়ে আসি।

এই করতে করতে সব বইয়ের সব কিছু দুইবার শেষ করলাম। তারপর শুরু করলাম ঘড়ি ধরে ধরে করা। একটা অধ্যায়ে ২০টা প্রশ্ন আছে, ৬০ মিনিটে শেষ করতে হবে।

দেখলাম হচ্ছে না। বুঝলাম অংক করার সময় প্রতিটি ধাপ লেখা যাবে না। সময় বেশি লাগবে। সুতরাং নানা কলা-কৌশল বের করতে থাকলাম: কী করে মাঝখানে এক বা দুইধাপ লাফ দিয়ে পরের লাইন লেখা যায়।

তারপরও হচ্ছিলো না। তখন ঠিক করলাম ক্যালকুলেটর পুরো নখের ডগায় থাকতে হবে, সব রকম ফাংশন ব্যবহার করা জানতে হবে। এটাও বুঝলাম ক্যালকুলেটর ব্যবহার যতো এড়ানো সম্ভব, সময় ততই বাঁচানো যাবে।

শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম কিছু যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ মুখস্ত থাকতে হবে। মনে পড়ে দুই-তিন অংকের গুণফল ক্যালকুলেটর দিয়ে করার আগেই মনে মনে আমি করে ফেলতে পারতাম। এছাড়া বিশেষ অংকের বিশেষ ধাপ ইত্যাদিতো মুখস্তই ছিলো।

সে সময় আমি আরেকটা বিষয় খেয়াল করি অনেক অংকই একটা সাধারণ নিয়মে করা যায়, তাতে সময় বেশি লাগে। আবার সেই অংক করার জন্য একটি বিশেষ নিয়মও আছে, আর তাতে সময় কম লাগে। তো প্রতিটি অংকের বিশেষায়িত নিয়ম আবিষ্কারের নেশা আমায় পেয়ে বসেছিলো।

আমার প্রস্তুতির শেষদিকে আমি কংক্রিট গাইডে থাকা মডেল টেস্ট দিতে শুরু করি ঘড়ি ধরে ধরে। এর ভেতরে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলো। ঢাকায় গিয়ে ভর্তির ফরম জমা দিয়ে এলাম।

বুয়েট চত্বরে সে সময় অপরিচিত কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলো সানরাইজের মেধা তালিকায় আমার অবস্থান কতো। আমি জবাব দেবো কি, সানরাইজের মেধা তালিকা কী তাই জানিনা। তারা গর্বভরে জানান দিলো কার অবস্থান কতো।

সে সব শুনে আমার ভয় ভয় করতে লাগলো, আমি কি আসলেই এখানে টিকবো। ঠিক করলাম যতো কম মানুষের সাথে কথা বলা যায় ততই আমার মনোবল ভালো থাকবে।

ভর্তি পরীক্ষার ক্রমিক কত আসতে পারে আগে থেকে কোনো ধারণা ছিলো না। উচ্চমাধ্যমিকে মেধা তালিকায় তো স্থান ছিলো না। ঢাকায় কত কত ভালো কলেজ, নটরডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ।

সে সবের ভীড়ে বোঝা মুশকিল। বগুড়ায়ই তো আজিজুল হক কলেজ আমার কলেজ থেকে ভালো। বুয়েটে আসন তো ৫১০, সেখানে ক্রমিক ২৫২ মানে কী? হালকার ওপরে বুঝতে পারলাম টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এর ভেতর থেকেও তো অনেকে ভর্তি পরীক্ষায় খারাপ করে ঝড়ে পড়বে।

আর সেটা যে আমি না কে বলবে। তার ওপর মনের ভেতর গোপনে দুঃসাহস আছে কম্পিউটার কৌশল। বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগে গিয়ে টিভির মতো কী সব জানি দেখলাম। দেখা করলাম ইলেক্ট্রিক্যালের শাহনেওয়াজ স্যারের সাথে। তিনি কি উপদেশ দিয়েছিলেন মনে নাই।

ভর্তি পরীক্ষার দিন আসন পড়েছিলো লাইব্রেরীতে। তেমন কিছু মনে নাই। পুরোপুরি ঘোরের ভেতরে ছিলাম। লেখা শুরু করার দেড় ঘণ্টা পর একবার মাথা তুলে দেখি সবাই ব্যস্ত। আমিও পরের মুহূর্তেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরীক্ষা শেষে দেখলাম মোটামুটি ৫৮টা প্রশ্নে হাত দিতে পেরেছি।

কতগুলো সঠিক হয়েছে তাতো জানিনা। মাথা পুরো ফাঁকা ফাঁকা, কিছুই কাজ করে না। নজরুল হলে এক ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি শুনে বললেন কম্পিউটারে হয়ে যাবে। এমন ভাব যে তিনি নিশ্চিত। আমি নিজে কিছু বুঝতে পারছিলাম না।

সপ্তাহখানেক পরে বাড়িতে কাকে যেন বলেছিলাম কম্পিউটার পেয়েও যেতে পারি। কেন যেন ধীরে ধীরে মনের ভেতরে জোর পাচ্ছিলাম।

বুয়েটে সেবার ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দেয় প্রায় দিন দশেক আগে। সেই খবর বগুড়ায় পৌঁছায়নি সাথে সাথে। তখনকার দিনে টেলিফোন ছিলো না তেমন। ফলাফল দেওয়ার নির্ধারিত দিন পার হওয়ার পরে আমরা খোঁজ করতে শুরু করি।

নানা মারফতে খবর নিয়ে সন্ধ্যায় বাবা ফিরলেন। জানলাম ১৬তম হয়েছি। পরের দিন আমরা আবার ফোন করে সেটা নিশ্চিত হলাম। শেষ হলো আমার ভর্তি যুদ্ধ।

লেখক: MA Hakim
CSE
Former Assistant Professor, BUET

যোগ দাও হতে চাইলে BUET’ian গ্রুপে 

বুয়েটের সব বিষয়ের Review

 বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক রিভিউ পড়তে ভিজিট করো এই লিংক 

সাব্জেক্ট ভিত্তিক রিভিউ পড়তে ভিজিট করো এই লিংক

এডমিশন নিয়ে যেকোনো জিজ্ঞাসায় যোগ দাও আমাদের ফেসবুক গ্রুপে