(এক সন্ধ্যায় চা খাইতে খাইতে আমার ছোটবোন আমাকে প্রশ্ন করলো,
— কুয়েট বললে কেউ চিনে না কেন?
— চেনা কি জরুরী নাকি?
— না সবাই প্রথম শুনলে বুয়েট ভাবে। এরপর খুলনা বললে চিনে না।
— না চিনলে সমস্যা কি?
— সবাই কেমন জানি অবজ্ঞা করে বলে, ” অহ খুলনা “
— তোমার কি মান সম্মানে লাগে নাকি?
— না কিন্তু এতো ভালো ইউনিভার্সিটি, কেউ চিনে না কেন?
— তোমাকে কে বলসে ভালো ইউনিভার্সিটি?
— জানি না, এতো প্যাঁচাও কেন তুমি? বিরক্ত লাগে !
. . সেদিন কোন এক বড় ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় আমাদের সবার দাওয়াত ছিল। বেকারদের দাওয়াত খাবার নিয়ম নাই, আমি এসব নিয়ম যথাযথ ভাবে মেনে চলি।
. . ছোটবোন রাতে বাসায় এসে আমার সাথে গল্প করতেসে। ঐখানে সবাই খুব জ্ঞানী মানুষজন ছিল। কম বেশি সবাই বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার, সবাই আমার বাপের কলিগ না হইলে বস টাইপ কেউ। এদের একজন আর্কিটেক্ট। আর্কিটেক্ট পলাশ, বসুন্ধরা সিটির আর্কিটেক্ট। একজন ব্যারিস্টার। উনাদের ছেলে মেয়েরাও ছিল। ছেলে মেয়েরাও মোটামোটি সবাই বুয়েট নাহলে মেডিকেলের ছাত্র ছাত্রী। এদের একজন আমার ছোটবোনকে জিজ্ঞেস করসে তোর ভাই কই থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করসে। কুয়েট বলার পর চিনে নাই। সে সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ছাত্রী।
. . আমি অবাক হই নাই, আমি শুনে হাসলাম। এগুলা অনেক পুরানো অভিজ্ঞতা। ছোটবোনের জন্য নতুন। সে খুব অবাক হয়। আমাকে হাসতে দেখলে সে আরও ক্ষেপে যায়। তার ভাই যে আসলে খুব নামকরা কোন জায়গার ছাত্র না, এটা মেনে নেয়া তার জন্য কষ্টকর। আহারে বেচারা, আমার বেশ মায়া হয়। স্কুল কলেজ দুইটাই একনামে দেশের সবাই চিনত। লাইমলাইট এঞ্জয় করার সৌভাগ্য হইসে অনেকদিন। বয়স হবার পর বুঝলাম এইগুলা খুব একটা মিন করে না। কুয়েট কে চিনল বা কে চিনল না তাতে আমার আসলে কিছুই আসে যায় না।
. . আমার ধারণা আমি রিজনেবল মানুষ। আমার ভার্সিটি চেনা না চেনা নিয়ে ইস্যু নাই। আমার প্রশ্ন জাজমেন্ট নিয়ে। আমরা খুব সহজেই কাউকে তার ইন্সটিটিউশান দিয়ে বিচার করে ফেলি।
” আপনি প্রাইভেটের? “,
” আপনি বি আই টি’র? ”
আমরা শুধু জাজ করলে সমস্যা ছিল না, আমরা আমাদের ছোটদেরও এটা শিখাই। আমি দেখসি কুয়েটের মত ভার্সিটি নিয়ে মানুষের কি পরিমাণ আইডেন্টিটি ক্রাইসিস কাজ করে।
. . আমি ভাবতেও পারি না তাহলে ইস্টার্ন বা ড্যাফোডিল ভার্সিটির ছাত্রদের কতটা সম্মান দেয়া হয়। কুয়েটে যারা পড়ে তাদের বেশিরভাগের এমন একটা ধারণা থাকে যে সে একটুর জন্য বুয়েটে চান্স পায় নাই অথবা ভালো সাবজেক্ট পায় নাই, সে অন্যদের চেয়ে ভালো।
. . কেন ভাই? তোমার যদি কুয়েট বা নিজের ভার্সিটি ভালো না লাগে সেটার স্পেসিফিক কারণ থাকুক, অন্য কোন ভার্সিটি বা প্রতিষ্ঠান তোমার মাপকাঠি হয় কিভাবে? চাইলেই ঐ কুয়েট বা তোমার ভার্সিটি থেকেই সবার চেয়ে আলাদা এবং সম্মান আদায় করে নেয়ার মত কাজ করা যায়। তোমার আশেপাশেই তোমার পরিচিতরাই করসে, করতেসে। তুমি তোমার না পাওয়া নিয়ে এত ব্যাস্ত যে তোমার সেগুলা চোখে পড়ে না। খুব স্বাভাবিক। কারণ তোমার বাবা মা তোমাকে শিখাইসে, বি বি এ পড়ে গাধার বাচ্চারা, অমুক বি বি এ পড়ে মানে সে গাধা, অমুক ঢাকা ভার্সিটিতে পালি সংস্কৃত পড়ে, মানে কোথাও চান্স পায় নাই, গাধা। অমুক প্রাইভেটে পড়ে, পাবলিকে টিকে নাই, গাধা। তুমি পড়াশুনা করো নাইলে এদের মত গাধা হবা। কুয়েট রুয়েট চুয়েট তো বি আই টি, এখানকার ইঞ্জিনিয়াররা তো সেকেন্ড ক্লাস ইঞ্জিনিয়ার। হাজার হাজার মানুষ কোথাও না পড়ে অসাধারণ কাজ করে যাচ্ছে যাদের সবাই চিনে কিন্তু তখন কেউ খোজ নেয় না সে কোথাকার ছাত্র। . . হাজার হাজার মানুষ আপনার আমার জীবনে পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে যাদের সেই পার্থক্যের কারণ সে নিজে, আপনি যখন প্রতিষ্ঠানকে সেই কৃতিত্ব দেন, ঐ মানুষটার মেধাকে অসম্মান করা হয়। রাস্তায় এক রিকশাওয়ালা রিকশা চালাচ্ছিল। বাবা ছেলেকে দেখায় বলল, ” পড়াশুনা করো বাবা, পড়াশুনা না করলে এদের মত রিকশা চালাইতে হবে। ” কোন বাবা ছেলেকে বলে নাই, ” পড়াশুনা করো বাবা, পড়াশুনা করলে তুমি এদের উপকার করতে পারবা। ” থার্ড সেমিস্টারে থাকতে আমার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আমাকে জিজ্ঞেস করসিল, — তুমি খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের না? ঐখানে কি বি এস সি ডিগ্রী দেয়? আমি হেসে বলসিলাম, ” জি না, ডিপলোমা দেয়, পলিটেকনিক। ” আমার এক ফোঁটাও রাগ লাগে নাই। যে ৩০ বছর পিছায় আছে, তার জন্য আমার করুনা হইতে পারে, রাগ কেন হবে? . . ৫০ থেকে ৮০ এর দশকে বড় হওয়া একটা অশিক্ষিত এবং স্বার্থপর প্রজন্ম বাবা মা হবার ফলাফল আজকের এই সমাজ। এদের সন্তান এদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস। . . এরা এদের বাচ্চাদের মানুষকে সম্মান করা শিখায় নাই, স্কুল কলেজ ভার্সিটি সোশ্যাল স্ট্যাটাস টাকা এগুলাকে সম্মান করা শিখাইসে। বাচ্চাকে ক্যাসিনোর টেবিলের চিপস এর মত বন্ধক রেখে এরা নিজেদের অক্ষমতা ঢাকার চেস্টা করে গেছে, যাচ্ছে এবং যাবে। এই দলে আমার আপনার সবার বাবা মা আছে।
. . দুঃখিত আমি ছোটবেলা থেকেই বেয়াদব।
Courtesy: Rafid Al Zahur ভাই , CE 2K10, KUET