ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” সম্পন্ন একটি উপগ্রহ নিয়ন্ত্রিত মেশিনগান ব্যবহার করে। রিভল্যুশনারি গার্ডের এক কমান্ডার এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গত ২৭শে নভেম্বর তেহরানের কাছে আবসার্ড শহরে কনভয়ের মধ্যে মোহসেন ফখরিযাদেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী ফাদাভি স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, একটি পিকআপের ওপর লাগানো অস্ত্রটি শুধুমাত্র ফখরিযাদেকে টার্গেট করে একাধিক রাউন্ড গুলি চালায়।

এই বিশেষ সক্ষমতার কারণে গোলাগুলির সময় ফখরিযাদের পাশে তার স্ত্রী থাকলেও তিনি কোন আঘাত পাননি।

ইরান এই হামলার পেছনে ইসরায়েল এবং নির্বাসিত বিরোধী গোষ্ঠীকে দোষারোপ করে আসছে।

ইসরায়েল এখন পর্যন্ত এ ঘটনার দায় স্বীকার বা অস্বীকার করেনি।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিযাদের হত্যার দৃশ্য দেখানো হয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী ফাদাভি জানিয়েছেন, একটি রিমোট-কন্ট্রোলড মেশিনগান থেকে মোহসেন ফখরিযাদের গাড়িতে ১৩ টি গুলি ছোঁড়া হয়।

ফখরিযাদেকে কীভাবে হত্যা করা হল?

ইরানের আবসার্দ শহরে গাড়িতে করে যাত্রা করার সময় কীভাবে এই বিজ্ঞানীকে গুলি করে হত্যা করা হল তা নিয়ে ইরানের কর্তৃপক্ষ নানা বিতর্কিত বিবরণ প্রকাশ করছে।

হামলার দিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল যে, ফখরিযাদের দেহরক্ষীদের সাথে বেশ কয়েকজন বন্দুকধারীর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়।

ইরানের একটি প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল যে “তিন থেকে চারজন ব্যক্তি, যাদের সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তারা নিহত হন”। নিসান ব্র্যান্ডের একটি পিকআপ ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হয়েছিল বলেও জানানো হয়।

ফখরিযাদের জানাজায় এক বক্তব্যে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রধান বলেন, অনেক দূর থেকে এই হামলা চালানো হয়েছিল, “বিশেষ পদ্ধতি” এবং “বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম” ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়। তবে তিনি এর চাইতে বেশি কোন ব্যাখ্যা দেননি।

রিভল্যুশনারি গার্ডের উপ-কমান্ডার জেনারেল ফাদাভি রোববার তেহরানে এক অনুষ্ঠানে বলেন যে “নিসান পিকআপের ওপর একটি মেশিনগান লাগানো ছিল, যা ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। ওই মেশিনগানটি ইনটেলিজেন্ট স্যাটেলাইট সিস্টেম অর্থাৎ উপগ্রহ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। যেটা ফখরিযাদের ওপর জুম ইন করে হামলা চালায়।”।

তিনি বলেন, “মেশিনগানটি ফখরিযাদের মুখের দিকে এমনভাবে টার্গেট করেছিল যে তার স্ত্রী মাত্র ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি) দূরে থাকা সত্ত্বেও, তিনি গুলিবিদ্ধ হননি”।

জেনারেল পুনরায় উল্লেখ করেন যে, “ঘটনাস্থলে কোনও মানব হামলাকারী উপস্থিত ছিল না।”

তিনি বলেন, হামলার সময় মোট ১৩টি গুলি ছোঁড়া হয় এবং সমস্ত গুলি নিশান পিকআপের ওপর বসানো সেই অস্ত্র থেকে ছোঁড়া হয়েছিল”।

ওই ঘটনায় ফখরিযাদের নিরাপত্তা প্রধানের মাথায় চারটি গুলি লাগে। কারণ তিনি বিজ্ঞানীকে বাঁচাতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন”।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, এই হত্যার প্রতিশোধ নেবেন বলে অঙ্গীকার করেন এবং এর পেছনে যারা রয়েছে তাদের “চূড়ান্ত শাস্তি” দাবি করেন।

শুক্রবার, ইসরায়েলের পাবলিক রেডিওতে জানানো হয় যে, ইসরায়েলের কয়েকজন সাবেক পরমাণু বিজ্ঞানীদের দেশটির নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সাবধান থাকার ব্যাপারে সতর্ক করেছে।

ওই বিশেষজ্ঞরা ডিমোনার একটি পরমাণু চুল্লিতে কাজ করতেন। ওই চুল্লিটি নেগেভ মরুভূমির ভেতরে অত্যন্ত গোপন একটি পরমাণু প্রকল্প।

ইসরায়েলি সরকার এই প্রতিবেদনের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেনি।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের নাগরিকদের মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে বলেছে। “ইরান” ইস্যুতে ঝুঁকির মুখে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন সতর্ক বার্তা দেয়ার পরদিনই ওই প্রতিবেদনটি সামনে আসে।

কেন বিজ্ঞানীকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে?

মোহসেন ফখরিযাদে ইরানের রেভল্যুশনারি অফ ডিফেন্সিভ ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর প্রধান ছিলেন, যা ফার্সি ভাষায় সংক্ষেপে এসপিএনডি নামে পরিচিত।

ইসরায়েল ও পশ্চিমা নিরাপত্তা সূত্র বলছে যে তিনি ইরানের পরমাণু কর্মসূচির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।

তারা বিশ্বাস করে যে এই পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক “প্রজেক্ট আমাদ” নামে একটি গোপন কর্মসূচী পরিচালনা করছিলেন, যা ইরানের একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক বোমা নিয়ে গবেষণা চালানোর জন্য ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা জানিয়েছে ওই প্রকল্পটি ২০০৩ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

তবে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু ২০১৮ সালে বলেন যে তার দেশ যেসব গোপন নথিপত্র পেয়েছে, সেখানে এটা স্পষ্ট যে, ফখরিযাদে এমন একটি কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছেন যা গোপনে আমাদ প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

ইরান জোর দিয়ে বলেছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ এবং তারা কখনই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেনি।

বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন যে, ফখরিযাদেকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পঙ্গু করার জন্য হত্যা করা হয়নি। বরং তাকে হত্যার মূল কারণ ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পরে ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ত হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটা বন্ধ করা।

তথ্যঃ বিবিসি বাংলা। প্রকাশঃ ৭ ডিসেম্বর