Paul Tibbets যিনি ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সোমবার সকাল ৮ঃ১৫ মিনিটে জাপানের হিরোশিমা শহরের উপর পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমা হামলা চালান। এতে তাৎক্ষণিক ভাবে মারা যায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ এবং আহত হয়ে পরবর্তীতে আরো ১০ হাজার মানুষ মারা যায়।
২০০২ সালের ৬ আগস্ট বৃটিশ সংবাদপত্র The Guardian এই Paul Tibbets এর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে । সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন Studs Terkel।
পল টিব্বেটস্ ( P)ঃ হেই..এটা সংশোধন করো… আমার বয়স মাত্র ৮৭, তুমি বলেছ ৮৯!
স্টাডস্ টারকেল (★)ঃ আমি জানি! দেখ, আমার ৯০ এবং আমি কিন্তু তোমার চেয়ে তিন বছর এগিয়ে আছি। যাহোক, দুপুরের খাবারটা ভালো মতোই সারা হলো। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, আমরা রেস্টুরেন্টে বসে আছি, অনেকেই পাশে দিয়ে যাচ্ছে, অথচ কেউ জানেনা আপনি কে ছিলেন! কিন্তু এক সময় আপনি ‘Enola Gay’ নামের বিমানটি জাপানের হিরোশিমা’র আকাশে উড়িয়েছেন- আগস্ট ৬, ১৯৪৫ রবিবার এবং এটা ছিল পারমাণবিক বোমা, ইতিহাসে প্রথম। ঐ নির্দিষ্ট সময়টি তখন সারা পৃথিবীর সবকিছুকে বদলে দিয়েছিল। আপনি ছিলেন সেই বিমানের পাইলট।
P: হ্যাঁ, আমিই ছিলাম পাইলট।
★ এবং পরে বিমানটির নাম রাখা হয় Enola Gay…
P: আমার মা, Enola Gay Haggard, আমার বাবা কখনোই আমাকে বিমান উড়ানোর বিষয়টি সমর্থন করতেন না। সে বিমান এবং মোটরসাইকেল অপছন্দ করতো। যখন আমি কলেজ পাশ করলাম এবং তাদেরকে বললাম যে, আমি সেনাবাহিনীর বিমান চালক পদে যোগদান করতে যাচ্ছি।
তখন বাবা বললো- আমি তোমাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছি, গাড়ি কিনে দিয়েছি, টাকা দিয়েছি বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরতে…কিন্তু এখন কি হলো? তুমি নিজেই তোমার হর্তাকর্তা! যদি তুমি নিজেই নিজেকে মেরে ফেলতে চাও, তাহলে যাও, আমি তাতে বাঁধা দিচ্ছিনা। তারপর শান্ত ভাবে মা শুধু বললেন- পল, যদি তুমি বিমান উড়াতে যাও, তাহলে তুমি ঠিক কাজটিই করতে যাচ্ছ… এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই হল!
★ তুমি চিকিৎসক হতে চেয়েছিলে?
P: না, আমার বাবা চাইতেন আমি চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করি এবং চিকিৎসক হই।
★ ১৯৪৪ সালে আপনি ছিলেন টেস্ট পাইলট (বিমান বানানোর পর প্রথম যিনি আকাশে উড়িয়ে পরীক্ষা করেন), B-29 বোমারু বিমান নির্মাণ প্রকল্পে।… তো কখন জানানো হলো যে- আপনাকে একটি “বিশেষ কাজ” দেওয়া হয়েছে?
P: সেপ্টেম্বর ১৯৪৪, আমি একটি B-29 বিমান উড়িয়ে মাত্র ল্যান্ড করেছি। একজন লোক আমাকে এসে বললো- আমাকে সেকেন্ড এয়ারফোর্স কমান্ডার General Uzal Ent কলোরাডো স্প্রিং (একটি এলাকা) থেকে ফোন করে জানিয়েছেন, আগামীকাল সকাল নয়টায় তার কার্যালয়ে আপনাকে তার সাথে দেখা করতে বলেছেন।
আপনার কাপর-চোপর, B-4 ব্যাগপত্র সাথে নিয়ে যাবেন কেননা আপনার আর ফিরে আসা হবেনা। আমি এটা নিয়ে চিন্তিত ছিলামনা – এটা ছিল অন্য সব কাজের মতোই আরো একটি। পরদিন সকালে আমি তার কার্যালয়ে পৌছাই। Lansdale নামের এক লোক আমার সাথে দেখা করলেন, আমার সাথে সাথে জেনারেল এন্ট এর কার্যালয়ে গেলেন এবং পিছনে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
সেখানে নীল রংয়ের স্যুট পরিহিত একজন লোক ছিলেন, US Navy’র ক্যাপ্টেন William Parsons- যে আমার সাথে হিরোশিমা’র আকাশে উড়েছিল এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আণবিক পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নরম্যান রামসি উপস্থিত ছিলেন। নরম্যান বললেন- ওকে, আমরা “সেটা” পেয়ে গেছি যেটাকে আমরা ম্যানহাটন প্রজেক্ট বলি। আমরা যেখানে একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা সেই বস্তু পেয়ে গেছি কিন্তু যতোক্ষণ আমাদের সাথে বিমান যুক্ত না হচ্ছে ততক্ষণ আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছিনা।
তিনি আমাকে বিস্তারিত বর্ণনা করছিলেনব সেটা সম্ভবত ৪৫-৫০ মিনিট ধরে, তারপর তারা চলে গেল।
জেনারেল এন্ট আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন-” কয়েকদিন আগে General Arnold (Commander general of the army air corps) আমাকে তিনটি নাম প্রস্তাব করেছিলেন।” ঐ দুজন ছিলেন পূর্ণ কর্নেল, আমি ছিলাম ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল। তিনি (এন্ট) আমাকে বললেন-” আমাকে জেনারেল আর্নল্ড যখন জিজ্ঞেস করলেন কে পারমাণবিক অস্ত্রটি সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারবে?” সে কোন প্রকার দ্বিধা না করে বললো- ” Paul Tibbets পারবে এই কাজ।” আমি বললাম ধন্যবাদ স্যার।
তিনি (জেনারেলএন্ট) আমাকে এঁকে একেঁ বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপারটা কি ঘটতে যাচ্ছে, আমাকে একটি সংস্থার সাথে কাজ করতে হবে এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে কিভাবে ইউরোপে এবং জাপানে পারমাণবিক বেমা ফেলা যায়।
★ চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো তারা কি ইউরোপেও পারমাণবিক বোমা ফেলতো! আমরা এটা জানতাম না।
P: আমার প্রতি দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী তেমনই মনে হয়েছে। ইউরোপ এবং জাপানে একসাথে ফেলার পরিকল্পনা হয়েছিল ‘গোপনীয়তা রক্ষা’ সমস্যার কারণে। কারণ পৃথিবীর একপাশে ফেললে অন্য পাশে না ফেলে (প্রকাশ না করে) থাকতে পারবেনা।
যাহোক তিনি (এন্ট) আমাকে বলেছিলেন তোমাকে B-29 দিয়েই এটা শুরু করতে হবে। তিনি আমাকে বলছিলেন-“এখানে কেউ তোমাকে (ফেলার ব্যাপারে) কিছু বলতে পারবেনা, কেননা কেউ এটার ব্যবহার সমন্ধে কিছু জানেনা, যদি আমাদের তোমাকে কোন সাহায্য করার কিছু থাকে তাহলে বলো আমরা সেটা করবো”
আমি বললাম ধন্যবাদ স্যার। তিনি বললেন- পল, খুব সাবধানে দায়িত্বটি পালন করতে হবে। কেননা যদি তুমি সফল হও তাহলে সম্ভবত তুমি হবে “বীর” আর যদি বিফল হও তাহলে সম্ভবত তোমার জীবন কাটাতে হবে জেলে।
★ আপনি কি পারমাণবিক বোমার শক্তি সমন্ধে জানতেন? আপনাকে এ সমন্ধে কি কিছু বলা হয়েছিল?
P: না। আমি সে সময় কিছু জানতাম না। আমাকে তিনি বলেছিলেন- যাও, ঘাঁটিতে ঘুরে দেখ এবং আমাকে ফোন করে জানাও তুমি কোনটি চাও। গ্রান্ড আইল্যান্ড, নেব্রাস্কা ঘাঁটিতে যাওয়ার পর P-47 এর একজন পাইলট আমাকে বললো- আপনি পরিপূর্ণ একটি Mechine shop পাচ্ছেন, সবাই qualified, তারা সবাই জানে তাদের কি করতে হয়। এটা একটি সুন্দর জায়গা।
★ এবং এখন আপনি আপনার ক্রু’দের নির্বাচন করবেন!
P: হ্যাঁ, আসলে মনে মনে এটা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। Tom Ferebee ( এনোলা গে-এর বোমা নিক্ষেপকারি), Theodore Van Kirk (নেভিগেটর, নেদারল্যান্ড থেকে আগত) এবং Wyatt Duzenbury (ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার)
★… আপনি এখন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ম্যানহাটন প্রজেক্টের জেষ্ঠ্য বিজ্ঞানী রবার্টের মতো!
P: আমার যতোদূর মনে পড়ে, আমি ম্যানহাটন প্রজেক্টের প্রধান কার্যালয়ে তিনবার গিয়েছিলাম। এবং প্রত্যেক বার দেখেছি বিজ্ঞানী রবার্ট অফেনহেইমার (Robert Oppenheimer) নিবিষ্ট মনে তার কাজ করছেন। পরে দেখলাম তার মতো একজন তুখোড় মেধাবী একজন যুবক নিরবিচ্ছিন্ন ধূমপায়ী (chain smoker) এবং নানান স্বাদের মদ পান করছে, আর সে মোটা লোকদের খুবই ঘৃণা করতো। ম্যানহাটন প্রজেক্টের জেনারেল ইন চার্জ General Laslie Groves ছিলেন মোটা মানুষ এবং তিনি আবার ধূমপান ও মদপান খুব ঘৃণা করতেন। আমি এই প্রথম দেখেছি দুজন বেখাপ্পা লোক একসাথে মিলেমিশে কাজ করে!
★ তাদের দুজনের মধ্যে কি পারষ্পরিক ব্যাক্তিগত কোন শত্রুতা ছিল?
P: তারা কেউ সেটা প্রকাশ করতো না, যার যার কাজ করে যেতো।
★ বিজ্ঞানী রবার্ট অফেনহেইমার কি আপনাকে বোমার ধ্বংসাত্মক বিষয়টি বলেছিল? আপনি কিভাবে জানলেন?
P: না বলেননি। আমাকে অধ্যাপক ড. রামসি শুধু বলেছিলেন- তোমাকে একটি বিষয় শুধু বলতে পারি যে আমরা 20000 টন TNT শক্তির একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছি। আমি জীবনে কখনো ১ পাউন্ড শক্তির বিস্ফোরণ দেখিনি! এমন লোকও দেখিনি যে কিনা ১০০ পাউন্ড শক্তির বিস্ফোরণ দেখেছে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম এটা কি ভয়াবহ নারকীয় ধ্বংসলীলা সাধন করতে যাচ্ছে।
★ ২০০০০ টন! এটা কতোগুলো বিমান ভর্তি বোমার শক্তির সমান?
P: আমার মনে হয়, যুদ্ধের সময় পুরা ইউরোপে যতো বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল সবগুলোর মিলিত শক্তির চাইতেও বেশি ছিল ঐ দুটি পারমাণবিক বোমার শক্তি।
★ তো, অধ্যাপক রামসি আপনাকে এর (ধ্বংসলীলার) সম্ভাব্যতা সমন্ধে বলেছিল?
P: তখন পর্যন্ত এসব ছিল তাত্ত্বিক বর্ণনা, তথাপি উনি বলেছিলেন কি ঘটতে যাচ্ছে। তখন আমি এটা বলতে চাচ্ছিলাম যে আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমি তাকে বলতে চাচ্ছিলাম যে আমরা যখন বোমাটি ফেলবো তখন সেখান থেকে ফিরে আসবো কিভাবে! তাকে বলেছিলাম- আমরা যখন ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় বোমা ফেলেছি তখন ফেলার পর সোজা সামনের দিকে চলে গেছি- সেটা তো বোমার প্রতিক্রিয়ার আওতার (trajectory) মধ্যেই ছিল।
কিন্তু এখন কি করা উচিত? তিনি আমাকে বললেন- তুমি সোজা সামনের দিকে উড়ে যেতে পারবে না কেননা সেটা (এলাকা) ঠিক বিস্ফোরণের উপর এবং কেউ কোনদিন জানতে পারবেনা তুমি সেখানে ছিলে! [মানে বোমা বিস্ফোরণের পর আঘাতের ঢেউয়ে (shock wave) নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে]
তিনি বললেন যে আমাকে ধেয়ে আসা আঘাত ঢেউ (expending shock wave) থেকে Tangent কোণে মোড় নিতে হবে। আমি বললাম ভালো, আমার পদার্থ বিজ্ঞান এবং ত্রিকোণমিতি সমন্ধে ধারণা আছে। কিন্তু এই অবস্থায় Tangency (tan x কোণ) কি? তিনি বললেন যে কোন দিকে 159 ডিগ্রি কোণ, যতো তাড়াতাড়ি পারো 159 ডিগ্রিতে মোড় নাও, তাহলেই বিস্ফোরণ স্থল থেকে সবচেয়ে বেশি দূরত্বে থাকতপ পারবে।
★ কতো সেকেন্ডের মধ্যে আপনি সেই মোড় নিতে পেরেছিলেন?
P: আমি ১৫০০ ফুট উপর থেকে অনেক প্রশিক্ষণ বোমা (Practice bomb) ফেলে বুঝার চেষ্টা করে দেখেছি যে 159 ডিগ্রি মোড় নিতে 40-42 সেকেন্ড সময় লাগে। আমি তাড়াতাড়ি ওয়েন্ডোভার ফিরে গেছি এবং বিমান চালিয়ে উপরে নিয়ে গেছি। ২৫ হাজার ফুট উপরে গিয়েছি, মোড় নেওয়ার চর্চা করেছি, একটু একটু একটু করে 40 সেকেন্ডের মধ্যেই মোড় নেওয়া আয়ত্ত করেছি।
লেজ নাটকীয় ভাবে কাঁপতে ছিল এবং আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এটা না আবার ভেঙে যায় কিন্তু হাল ছাড়িনি। এটা ছিল আমার লক্ষ্য এবং ‘তার আগ পর্যন্ত’ আমি দিনের পর দিন চর্চা চালিয়ে গেছি সে বিষয়ে কোন কথা মনে না করে। আমি পারবো 40-42 সেকেন্ডের মধ্যেই, সব সময়! সুতরাং যখন সেই দিনটি এলো….
★ সাক্ষাৎকারটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় আজ এর প্রথম অংশ প্রকাশ করলাম, ইনশাআল্লাহ পরবর্তী অংশটুকু শীঘ্রই প্রকাশ করবো।
Masud Alam
06-8-20
Abu Dhabi city
UAE